News update
  • OIC Deeply Regrets UNSC Failure to Accept Palestine as UN Member      |     
  • Retaliatory spiral in Middle East must end, says UN chief      |     
  • Rakhine State once again becomes a battleground: UN HR Chief      |     
  • No political case filed against BNP men: PM Hasina     |     
  • Iran fires at attack drones near Isfahan air base, nuke site     |     

রাষ্ট্রভাষা বিতর্ক – ইতিহাসের পাতা থেকে

মতামত 2022-02-21, 3:15pm

kazi-azuzul-huq-8736fd5a4a2a301b06ef38bd52a766511645434935.jpg

Kazi Azuzul Huq. Taken from his facebook profile



কাজী আজিজুল হক

১৯৫১ সালের ২৪ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘পাকিস্তান জিন্নাহ আওয়ামী লীগ’। 

১৯৫২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সিন্ধুর হায়দ্রাবাদ শহরে সোহরাওয়ার্দী সাহেব বলেন, 

যে আদর্শের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেই আদর্শ অনুসারে একমাত্র উর্দুই হওয়া উচিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।

এটা তিনি বলেছিলেন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির দু’দিন পরে। অর্থাৎ ঢাকায় ছাত্র-মিছিলে গুলি চলার পরে। সোহরাওয়ার্দী বললেন উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা! 

শেখ নজরুল লিখেছেন :

ভাষা আন্দোলনের পথিকৃত ছিল তমুদ্দুন মজলিস। তমুদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠা ১৯৪৭ সালের ১সেপ্টেম্বর,অর্থাৎ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে গণকের মতো আবুল কাসেম ভবিষ্যদ্বাণী করেন মুসলিম লীগ একটি ওয়াদা ভঙ্গকারী দল এবং এর নেতারা ইসলাম সম্পর্কে কিছু জানেন না। অথচ সেই দলের তখনকার সভাপতি  মওলানা আকরম খাঁ ও সহ-সভাপতি মওলানা আবদুল্লাহিল কাফি ছিলেন দেশ-বিখ্যাত আলেম। 

তমুদ্দুন মজলিসের  প্রতিষ্ঠাতা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের তরুণ প্রভাষক আবুল কাসেম। আবুল কাসেম ছাত্র-জীবনে কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠন ছাত্র ফেডারেশনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন এবং কমিউনিস্ট পার্টির লোকজনের সাথেই চলাফেরা করতেন। 

পরবর্তীতে আমরা দেখেছি যে, ভাষা আন্দোলনের সকল কলকাঠি কমিউনিস্টদের নিয়ন্ত্রণেই ছিল।

তমুদ্দুন মজলিস প্রথম দিকে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কথা বললেও ভাষার রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে এটা পুরোপুরি রাজনৈতিক দলেই পরিণত হয়। রাজনীতিতে তমুদ্দুন মজলিসের গুরু ছিল মওলানা ভাসানী। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ লিখেছেন, পূর্বাপর মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর রাজনৈতিক মতবাদের অনুসারী হওয়ার ফলে আমরা যখন ভাষা আন্দোলনে যোগদান করেছিলাম তখন আমাদের উদ্দেশ্যেও ছিল সে ভাষার পার্থক্যের ভিত্তিতে আমরা একটা স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে সমর্থ হব। 

প্রকৃতপক্ষে তমুদ্দুন মজলিস সেকালেই পাকিস্তান ভাঙতে চেয়েছিল। অন্তত তমুদ্দুনের, মওলানা ভাসানীর নেতৃত্ব কবুল তা-ই প্রমাণ করে। এ কারণেই তখন তমুদ্দুন মজলিসের নেতা-কর্মীদের কমিউনিস্ট বলা হতো।

বিশিষ্ট গবেষক ও বুদ্ধিজীবী ফাহমিদ-উর-রহমান তাঁর রচিত আ মরি বাংলা ভাষা বইয়ে লিখেছেন: 

মুসলিম লীগ তো তমুদ্দুনকে কমিউনিস্ট হিসেবেই জানতো। অনেকের মতে এটা ছিল কমিউনিস্ট পার্টির পকেট। সেকালে কমিউনিস্ট পার্টি গণ-আজাদি লীগ, যুব লীগ, পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন পকেট সৃষ্টি করে রাজনীতি করতো। তমুদ্দুনও ছিল কমিউনিস্ট পার্টির এ রকম একটি পকেট মাত্র। তমুদ্দুন খোলাখুলি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেয়নি। কিন্তু তাদের অনেক সিদ্ধান্তই কমিউনিস্ট পার্টির চিন্তাভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল-এতে কোনো সন্দেহ নেই।

বিশিষ্ঠ গবেষক এবনে গোলাম সামাদ লিখেছেন:

আমাদের একদল কথিত প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী জিন্নাহ সাহেবের সমালোচনা করে চলেছেন উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার দাবির জন্য। কিন্তু তিনি যে কেবল উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলেন, তা কিন্তু নয়। ১৯৫১ সালের ২৪ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘পাকিস্তান জিন্নাহ আওয়ামী লীগ’। ১৯৫২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সিন্ধুর হায়দ্রাবাদ শহরে সোহরাওয়ার্দী সাহেব বলেন, যে আদর্শের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেই আদর্শ অনুসারে একমাত্র উর্দুই হওয়া উচিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এটা তিনি বলেছিলেন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির দু’দিন পরে। অর্থাৎ ঢাকায় ছাত্র-মিছিলে গুলি চলার পরে। সোহরাওয়ার্দী বললেন উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা! 

 সোহরাওয়ার্দীর পুরো বিবৃতিটি পাওয়া যায় মার্ক্সবাদী ইতিহাসবিদ বদরুদ্দীন উমরের বিখ্যাত 'পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি' শিরোনামের গবেষণাতে। সেখানে উল্লেখিত হয়েছে-

পশ্চিম পাকিস্তানের হায়দরাবাদ শহর থেকে শহীদ সোহরাওয়াদী ঢাকার ঘটনাবলী সম্পর্কে একটি সংবাদপত্র বিবৃতি প্রদান করে গুলি বর্ষণে নিহতদের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। বিবৃতিটিতে তিনি আরও বলেন যে,

"আমি একদিকে শুনছি ছাত্ররা শান্ত ছিল এবং অন্যদিকে শুনছি তারা পুলিশের প্রতি ইট পাটকেল নিক্ষেপ করেছিলো। সুতরাং প্রশ্ন ওঠে, পুলিশ ঘটনাস্থলে কি করছিলো এবং আইনসঙ্গতভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শনের জন্য তাহারা কেন শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল করতে দেয় নাই। এখন নয়, অনেকদিন পুর্বে যখন পূর্ব বাংলায় প্রথম বিতর্ক বিক্ষোভ শুরু হয়েছিলো তখনই একটি জনসভা ও সংবাদপত্র বিবৃতি মাধ্যমে জানিয়েছিলাম যে, যেভাবে এবং যে নীতির ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেই অনুযায়ী পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হওয়া উচিত। 

কিন্তু একই সঙ্গে আমি বলেছিলাম যে বাংলা পাকিস্তানের জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশের, বস্তুতঃপক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা হওয়ায় উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তানের উপর চাপিয়ে না দিয়ে তাকে একটি বাধ্যতামূলক দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে শিক্ষা দেওয়া উচিত, যাতে কালে কালে জনগণ উর্দুর সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠলে এবং সরকারী কর্মচারীরা তা স্বাভাবিকভাবে পড়তে ও লিখতে পারলে তখন উর্দু তার গৌরবজনক আসনে প্রতিষ্ঠিত হবে। সমস্যাটির প্রতি এই হলো একমাত্র বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গী। উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হতে হবে এই মর্মে ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের ক্ৰমাগত ঘোষণার ফলে প্রতিক্রিয়াই সৃষ্টি হয় যার দুঃখজনক পরিণতি আজ আমরা দেখছি। তাছাড়া পূর্ব পাকিস্তানে উর্দু শিক্ষার জন্য যখন কিছুই করা হচ্ছে না তখন এ প্রশ্নটি উত্থাপনের অর্থ কি হতে পারে?"

সোহরাওয়ার্দীর এই বিবৃতি নিয়ে সেসময় বেশ সমালোচনা হয়।এমনকি আওয়ামী মুসলিম লীগের কেউ কেউ তাকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন। উল্লেখ করা জরুরী যে, সোহরাওয়ার্দী ১৯৫১ সাল থেকে "পাকিস্তান জিন্নাহ আওয়ামী লীগ" নামে একটি দল গঠন করে পশ্চিম পাকিস্তানে কাজ করছিলেন। যে দল পরবর্তীতে আওয়ামী মুসলিম লীগের সাথে মিশে গিয়ে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করে।

( বদরুদ্দীন উমর, 'পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি' (তৃতীয় খন্ড), সুবর্ণ, ১৯৮৪, পৃ.৩৯৪)

এবনে গোলাম সামাদ আরও লিখেছেন:

আমাদের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা জানেন না যে, পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ জহিরও বলেছিলেন, উর্দুই হওয়া উচিত পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। অর্থাৎ দক্ষিণপন্থী ও বামপন্থী দৃষ্টিকোণ ভাষার প্রশ্নে হয়ে উঠেছিল একই। মার্কসবাদীরা বিশ্বাস করেন, শ্রমিক শ্রেণীরা করবে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। এই উপমহাদেশে শ্রমিকেরা হিন্দু-উর্দু যতটা বুঝতেন, বাংলা তা বুঝতেন না। বাংলার মানুষ মূলত ছিলেন কৃষিজীবী। মার্কস যে অর্থে শ্রমজীবী কথাটা তার বিখ্যাত কমিউনিস্ট মেনুফেস্টোতে বলেছেন, বাংলার কৃষকেরা সেই সংজ্ঞায় পড়েন না। তাই তাদের ভাষাকে নির্ভর করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব অসম্ভব। সারা উপমহাদেশে কমিউনিস্টরা হিন্দি ভাষায় আওয়াজ তুলেছিলেন,

ইয়ে আজাদি ঝুট্টা হ্যায়

লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়।

ব্রিটিশ আমলে ভারতে উর্দুকে সব মুসলমান সমর্থন করেছেন রাষ্ট্র বা সাধারণ ভাষা করার জন্য। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায় ১৯৩৮ সালে এ কে ফজলুল হক All India Muslim Educational Conference-এর সভাপতির ভাষণে বলেন, স্বাধীন ভারতের সাধারণ ভাষা (Lingua Franca) হতে হবে উর্দু। ফজলুল হক সাহেবের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। কিন্তু তিনি সমর্থন করেন উর্দুর দাবিকে।

অন্যদিকে ১৯৪০ সালে নাগপুরে হিন্দি সাহিত্য সম্মেলনে মহাত্মা গান্ধী বলেন, উর্দু ভাষার বিকাশ হয়েছে মুসলিম নৃপতিদের পৃষ্ঠপোষকতায়। ভাবি স্বাধীন ভারতে উর্দুর আরো বিকাশ করতে হলে তার দায়দায়িত্ব হলো মুসলমানদের, অন্যদের নয়। মহাত্মা গান্ধীর মাতৃভাষা হিন্দি ছিল না, ছিল গুজরাটি। তিনি তার বিখ্যাত সর্বদ্বয় নামক বই লিখেছেন গুজরাটি ভাষায়। অর্থাৎ ব্রিটিশ আমলে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল হিন্দি-উর্দুর বিতর্ক। বাংলার দাবি সেখানে ছিল অনুপস্থিত।

১৯৪৮ সালে জিন্নাহ সাহেব যখন বলেন, উর্দুকেই করতে হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, তখন তিনি তা বলেছিলেন পুরাতন ঐতিহ্যকে অনুসরণ করে। এ সময় হিন্দিকে ভারতের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বিষয়টি ছিল সাবেক ব্রিটিশ ভারতের মধ্যে উদ্ভূত রাজনীতির জের। এটা নতুন কিছু ছিল না। জিন্নাহর মাতৃভাষা ছিল মহাত্মা গান্ধীর মতোই গুজরাটি। তিনি তার প্রথম জীবনে রাজনৈতিক প্রবন্ধ রচনা করেন মাতৃভাষা গুজরাটিতে। তিনি গুজরাটি বলতে ও লিখতে পারতেন। তিনি উর্দু ভাষায় মোটেও পারদর্শী ছিলেন না। উর্দু বলতেন ভাঙা ভাঙা ভাবে। ১৯৪৮ সালে তিনি ঢাকায় উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সমর্থনে যে বক্তৃতা দেন, তা দিয়েছিলেন বিশুদ্ধ ইংরেজি ভাষায়; উর্দু ভাষায় নয়।