Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman
- আতিকুল ইসলাম
১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট ভারত বিভক্তির দিনে বৃহত্তর খুলনা জেলাকে, পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশের পরিবর্তে দিল্লি শাসিত পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করা হলে বর্তমান খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা এই তিনটি জেলা ভারতে অন্তর্ভুক্ত থেকে যায়। এই সময় বৃহত্তর খুলনা জেলায় মুসলমান ছিল ৪৯ শতাংশ। ১৪ই আগস্টের সরকারি ঘোষণার পর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সহ বৃহত্তর খুলনা জেলার সর্বত্র উত্তোলন করা হয় অশোক চক্র সম্বলিত ত্রিরঙা ভারতীয় পতাকা। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে স্বাধীন বাংলার নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলাকে পরাজিত ও খুন করার পর থেকে পরাধীন বাংলায় মুসলমানরা ব্যবসা-বাণিজ্য, সরকারি চাকুরী ও শিক্ষা সংস্কৃতিতে হিন্দুদের তুলনায় পশ্চাৎপদ হয়ে পড়ে। অন্যান্য অঞ্চলের মত বৃহত্তর খুলনায়ও হিন্দু জমিদার ও সমাজপতিদের নির্যাতন ও শোষণের শিকার ছিল দরিদ্র ও অশিক্ষিত মুসলমানেরা। ফলে সঙ্গত কারণেই ভারত-ভুক্তির পর খুলনার মুসলিম জনগোষ্ঠী উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ে। তাদের এমন অসহায় পরিস্থিতিতে তৎকালীন খুলনা জেলা মুসলিম লীগের সভাপতি, ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে খুলনা সদর আসন থেকে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পদে নির্বাচিত সদস্য খান এ সবুর, হতাশ খুলনাবাসীকে আশার বাণী শুনিয়ে জমিদার শৈলেন ঘোষের ষড়যন্ত্র ছিন্ন করে ও বর্তমান ডিসি পদমর্যাদায় তৎকালীন ডি.এস, এম.এন বসাকের হুলিয়া মাথায় নিয়ে আত্মগোপন করে কোলকাতা চলে যান। মুসলিম লীগ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ ও বাউন্ডারি কমিশনের কর্তাদের সাথে দীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে তিনি খুলনা সম্পর্কে তাদের পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করান। ১৮ই আগস্ট ১৯৪৭ অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে বলা হয় যে, বাউন্ডারি কমিশন তাদের পূর্ব সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে খুলনা ও গুরুদাসপুর জেলা দুটোকে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করেছে।
KHan A Sabur
বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদের প্রভাবশালী মুসলিম লীগ সদস্য খান এ সবুর সেদিন ব্যর্থ হলে বৃহত্তর খুলনা জেলা তথা বর্তমান তিনটি জেলা আজো ভারতের সঙ্গে যুক্ত থাকত, বাংলাদেশের সঙ্গে নয়। এমন অবিশ্বাস্য ও যুগান্তকারী অবদানের জন্য কৃতজ্ঞ খুলনাবাসী ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার মহানায়ক ও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি খান এ সবুরকে খুলনার দুটি ও সাতক্ষীরার একটি আসন মোট তিনটি আসন থেকে নির্বাচিত করেন। সেদিন পর্যন্ত এদেশের সংসদ নির্বাচনে খান এ সবুরই প্রথম বিরোধী দলের প্রার্থী যিনি তিনটি আসনে নির্বাচিত হয়ে ইতিহাস গড়েছেন। তার ঐতিহাসিক অবদানকে খুলনাবাসী আজও স্মরণ রেখেছে বলেই তার ইন্তেকালের দশ বছর পর খুলনা শহরের প্রধান সড়কটির নামকরণ করেছেন ‘খান এ সবুর সড়ক’।
১৯৬২ ও ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে খুলনাবাসী তাকে দুবার পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত করেন। অসাধারণ বাগ্মী ও দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান খান এ সবুর ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী পদমর্যাদায় পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সংসদ নেতা এবং কেন্দ্রীয় যোগাযোগ মন্ত্রী ছিলেন। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত খুলনার সকল উন্নয়নের পেছনে রয়েছে তার তর্কাতীত অবদান এবং মূলত তিনিই আধুনিক খুলনা ও মংলা বন্দরের রূপকার।
নবাব খাজা সলিমুল্লাহর উদ্যোগ ও প্রস্তাবে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে ডিসেম্বর ঢাকার শাহবাগে গঠিত হয় নিখিল ভারত মুসলিম লীগ। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে ১৬ জানুয়ারি কলকাতার ৫৩ নম্বর চৌরঙ্গী রোডস্থ নিজ বাসভবনে তার ইন্তেকালের পর বাংলা তথা ব্রিটিশ শাসিত সর্ব ভারতীয় মুসলিমদের রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ করার নবাবের যে লালিত স্বপ্ন ছিল তা বাস্তবায়িত করতে মুসলিম লীগের চাঁদ-তারা খচিত পতাকা হাতে পর্যায়ক্রমে এগিয়ে আসেন বাংলার ক্ষণজন্মা কিছু নেতা। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন নবাবের ব্রেন-চাইল্ড হিসাবে খ্যাত এ.কে ফজলুল হক, সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, খাজা নাজিমউদ্দীন, মাওলানা আকরাম খাঁ, ফজলুল কাদের চৌধুরী, পণ্ডিত আবুল হাসিম, খান এ সবুর, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ। পরবর্তীতে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে গেলেও উল্লেখিত নেতাদের মধ্যে সর্বদা বজায় ছিল হৃদ্যতা, ভাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ যা ছিল তৎকালীন রাজনৈতিক শিষ্টাচারের এক অনন্য নিদর্শন।
পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশটি ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ নামে স্বাধীন হওয়ার পর অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে খান এ সবুরকেও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে বঙ্গবন্ধুকে তিনি একটি চিরকুট পাঠান। তারিখ বিহীন এই চিরকুটে লেখা ছিল, “স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আমার ছোট ভাই, আর আমি সেই দেশের কারাগারে এক অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বন্দী। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। ইতি-খান এ সবুর“। এই চিরকুট হাতে নিয়ে বঙ্গবন্ধু তৎকালীন সময়ে তার রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদকে নির্দেশনা দেন। এ সম্পর্কে আসাদুজ্জামান নূরের নেয়া এক সাক্ষাৎকারে তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, “বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সেই রাতে আমার পুরনো মাজদা গাড়ীটি নিয়ে আমার এপিএস ঢাকা কারাগার থেকে খান-এ-সবুর কে তার ধানমন্ডির বাসায় পৌঁছে দেয়“ -(সূত্র: আসাদুজ্জামান নূর সম্পাদিত বেলা অবেলা সারাবেলা) -পৃষ্ঠা ৫৭২-৭৩)। আদালতে জামিনের আদেশের আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক জীবনের বড় ভাই খান এ সবুরকে কারাগার থেকে বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করেন, কারাগারের কাগজপত্রে আজও তিনি হয়ত কারারুদ্ধ হয়েই আছেন। কারাগার থেকে মুক্ত হবার পর খান এ সবুর যাতে তার সকল সম্পত্তি ফিরে পান, বঙ্গবন্ধু সে ব্যবস্থাও নিয়েছিলেন। সুখরঞ্জন দাস তার “মুজিব হত্যার ষড়যন্ত্র“ গ্রন্থে বলেছেন, “শেখ মুজিবকে হত্যার পর আইউব খানের মন্ত্রীসভার প্রাক্তন সদস্য ও মুসলিম লীগ নেতা খান এ সবুর হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, শেখ মুজিবকে নৃশংস ভাবে খুন করা হয়েছে একথা কেউ ভুলবে না, তাদের ক্ষমা নেই। স্বেচ্ছায় গদি ছাড়, নাহলে যে জনতাকে নিরস্র মনে করেছ, তারাই তোমাদের হাত থেকে শাসন ক্ষমতা ছিনিয়ে নিবে“। [সূত্র-মুজিব হত্যার ষড়যন্ত্র, পৃষ্ঠা-১৩]।
খান এ সবুর যখন বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্য তখন শেখ মুজিবুর রহমান কোলকাতা ইসলামিয়া কলেজের প্রভাবশালী উদীয়মান ছাত্রনেতা এবং বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সাবেক সম্পাদক, অখণ্ড বাংলার শেষ মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বিশ্বস্থ ও ঘনিষ্ঠ সহকর্মী। কোলকাতা কেন্দ্রিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে কেন্দ্র করেই খান এ সবুর ও শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে তখন থেকেই গড়ে উঠে বড় ভাই ও ছোট ভাই সুলভ হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক যা রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকলেও আমৃত্যু উভয়েই রক্ষা করে গেছেন। আজ ২৫ জানুয়ারি ২০২৩ মহান রাজনীতিবিদ খান এ সবুরের ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।
- আতিকুল ইসলাম, সদস্য, স্থায়ী কমিটি, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ