সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে জীবন নামের ইঞ্জিনের বে-সুরা ছন্দের তালে তালে এগিয়ে যেতে চান কেউ কেউ। ওরা থামেনা। শত বাধাও যেন হারাতে পারেনা তাদের। ঝিনাইদহের হেমেলা খাতুন তাদেরই একজন। ভ্যান চালক স্বামীর অকাল মৃত্যুতে এতটুকু ভেঙ্গে পড়েননি তিনি। ৫ সন্তানের দায়িত্ব এখন তার। পাশে কেও নেই।
হেমেলা খাতুন। ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার উমেদপুর ইউনিয়নের বাহির রয়েড়া গ্রামের পশ্চিম পাড়ার বাসিন্দা। গ্রামের মৃত আব্দুল গনি শেখের সাত সন্তান। স্বামী ইয়াজুল ইসলাম বড় ছিলেন। হতদরিদ্র দিন মজুর বাবার সংসারে ছোট বেলা থেকেই কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে তাকে (ইয়াজুল ইসলাম)। এক বেলা খাবার জুটেছে কিংবা জুটেনি তার। বিয়ের পরে বাবার সংসার থেকে আলাদা হতে হলো তাকে। ইয়াজুল ইসলামের নিজের সংসারও বড় হতে লাগলো। নিরক্ষর হেমেলা- ইয়াজুল দম্পত্তির ঘরে একে একে মেধাবী চার মেয়ে এক ছেলে সন্তানের জন্ম হলো। গ্রামের রাস্তা-ঘাট ভালনা। শৈলকুপা উপজেলা শহরে প্যাডেল (পায়ে চালানো) রিকসা ভ্যান চালিয়ে ,অন্যর জমি বর্গা নিয়ে, গরু ছাগল পালন করে মোটা মোটামুটি সংসার চলছিল তাদের। সংসারে অভাব ছিল। তাতে কি? ছিল ভাল লাগা-ভালবাসা। কষ্টের মাঝেও এগুচ্ছ স্বপ্ন আকড়ে ধরেছিলেন হেমেলা- ইয়াজুল দম্পত্তি।
বড় মেয়ে রিমা খাতুন। আইয়ে পাশের পরে বিয়ে হয়ে গেছে। ঢাকাতে জামায় -মেয়ে বে-সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। মেজ মেয়ে কানিজা খাতুন। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাসে (অর্নাস) তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। সেজ মেয়ে (তৃতীয় সন্তান) তাছলিমা খাতুন। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যানিটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। ছোট মেয়ে চাঁদনী খাতুন। এইচ,এস,সি পাশ করেছে। একমাত্র ছেলে আরাফাত ইসলাম। বয়স মাত্র চৌদ্দ বছর। স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় হাফেজি পড়ে। দিন মুজুরী করে, ভ্যান চালিয়ে ছেলে মেয়েদের পড়া লেখার খরচ জোগাড় করা কঠিন হয়ে পড়েচিল। ইয়াজুল ইসলাম এনজিও থেকে ঋন নিয়ে কিনেন ব্যাটারী চালিত একটি ইজিবাইক। স্বচ্ছলতা ফেরাতে বাড়ির কিনারে ১০ কাঠা জমিতে রোপণ করেন বোরো ধান পরিশ্রমের ঘাম গায়ে (শরীরে) শুকাতে থাকে তার (ইয়াজুল ইসলাম)।
হেমেলা খাতুন কম কিসে? গরু ছাগল, হাঁস মুরগী পালতে থাকেন। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়েদের পড়া লেখা যেন মাঝ পথে আটকে না যায়। সব কিছু ঠিক ঠাকই ছিল। সময়ের সাথে পাল্লা দিতে থাকা হার-না মানা এই দম্পত্তির নিরব গল্প অবশেষে প্রকাশ্যে বেরিয়ে এলো। দিনটি ছিল ২০২২ সালের ১৪ আগষ্ট। সকাল অনুমান ৮টা ৩০ মিনিট। সেসময় উঠানে রান্নার কাজে ব্যস্ত ছিলেন হেমেলা খাতুন। বারান্দায় সুইচ বন্ধ করতে গিয়ে বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট হয়ে লুটিয়ে পড়েন ইয়াজুল। সেখানে ইজিবাইকের ব্যাটারীতে চার্জ দেওয়া ছিল। মুমুর্ষ অবস্থায় উদ্ধার করে শৈলকুপা উপজেলা হাসপাতালে নেওয়া হলো তাকে। মা আছিরণ নেছার (ইয়াজুল ইসলামের মা) কান্নায় কেঁপে উঠলো হাসপাতাল এলাকা। স্বজনদের আহাজারিতে বাতাস ভারী হলো। কাজ হলোনা। ইয়াজুলের জীবন নামের রেল গাড়িটা থেমে গেলো। কর্তব্যরত ডাক্তার জানালেন ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়েছে তার।
নিমিষেই নিভে গেলো হেমেলা খাতুনের সুখের প্রদীপ। প্রায় ৭ মাস পার হতে যাচ্ছে। হেমেলার চোখের জল শুকিয়ে গেছে। হৃদয় জুড়ে স্বামীর স্বপ্ন। নিরক্ষর এই নারী জীবন সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়লেন। ইতোমধ্যে স্বামীর লাগানো ১০ কাঠা জমির বোরো ধান নিজেই কেটেছেন। সেই ধান মাড়াই করে ঘরেও তুলেছেন। লাগিয়েছেন ভুট্টা। নিজেই ওই জমিতে সেচ দিচ্ছেন। বিক্রির করছেন গাভীর দুধ। মিশিনে সেলাই করছেন গ্রাম্য নকশি কাথা। হার না মানা এই নারীর জীবনের গল্প গোটা অঞ্চলে ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া দুই মেয়ে সহ ৫ সন্তানের পড়া লেখা বন্ধ হতে দেননি। প্রতিবেদকের কাছে মলিন মুখে কথা গুলো বলছিলেন হেমেলা খাতুন। এ সময় চোখের জল ধরে রাখতে পারছিলেন না। বার বার আচঁলে মুখ লুকানোর চেষ্টা করছিলেন। অর্থাভাবে যে কোন সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে মেয়েদের পড়া লেখা। এমন অজানা আতংক ভর করেছে তাকে।
ইয়াজুল ইসলামের বৃদ্ধ মা কষ্টের দিন গুলোর কথা তুলে ধরতে ধরতে বললেন, নাতীরা (ছেলের সন্তান) খুব মেধাবী। সহযোগিতা পেলে পড়া লেখা চালিয়ে যেতে পারবে তারা।