Food - good food display. Creative Commons
মাছে- ভাতে বাঙালি এ ভূখণ্ডের একটি জনপ্রিয় প্রচলিত প্রবাদ। একসময় এ অঞ্চলের মানুষের গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ আর ক্ষেতে থাকত সোনালি ফসল। কালের বিবর্তনে গ্রামে আর পুকুর দেখা যায় না। মিঠা পানির সেই সুসাধু মাছের স্হান দখল করে নিয়েছে চাষের হাইব্রিড মাছ। গোয়াল ভরা গরু আজ আর গ্রামের গৃহস্থ বাড়িতে দেখা যায় না। প্রযুক্তিগত উন্নতির কারণে আমাদের জীবন অনেক বদলে গেছে। গ্রামে গ্রামে এখন আর নবান্নের উৎসব হয় না। শহুরে মানুষরা নিজেদের ঐতিহ্যকে জানান দিতে নবান্নের উৎসব করে। পিঠাপুলির আয়োজন করে কিছু আলোচনা হয়। এর মাধ্যমে আমরা বাঙালি, এটা জানান দেয়।
কবি বিভূতি দাস তাঁর ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ কবিতায় লিখেছেন ‘মাছে ভাতে বাঙালি, নিরামিষে মন উঠছেনা এটা সেটায় ভরছে পেট,রসনা কিন্তু মানছে না। গ্রামের মানুষেরা বাজারে আড্ডায় সিঙ্গারা, পিয়াজু, সমুচা খায় আর শহরের মধ্যেবিত্ত এবং উচ্চবিত্তরা পিৎজা, বার্গার, তন্দুরি, চিকেন ফ্রাই, ফ্রেন্স ফ্রাইসহ আরও নানা রকম ফার্স্ট ফুড না হলে তাদের চলে না। আর এসব খাবার গ্রহণের মাধ্যমে আমরা আমাদের অজান্তেই শরীরের অনেক বড়ো ক্ষতি করে ফেলছি। বাঙালি চিরকালই ভোজন রসিক। তা সেকালই হোক কিংবা একালই হোক। সব যুগেই বাঙালির
খাবারের সুনাম রয়েছে। আমরা যতটা না আদর্শ খাদ্য গ্রহণে সচেতন আর চেয়ে অনেক বেশি মুখরোচক খাদ্যের প্রতি বেশি দুর্বল। আমরা একবার ভেবেও দেখিনা কি খাচ্ছি, এতে আমাদের শরীরের উপর কি প্রভাব ফেলছে।
বিশ্বজুড়ে এখন পুষ্টিবীদরা খাবার গ্রহণের জন্য সুপার ফুডের উপর গুরুত্ব দিচ্ছেন। তাহলে আমাদের জানতে হবে সুপার ফুড কী,বিজ্ঞানীদের মতে সুপার ফুড হলো এমন এক ধরনের খাদ্য, যাতে উদ্ভিাজাত পুষ্টি উপাদান বেশি পরিমাণে থাকে যা আমাদের দেহের জন্য খুব উপকারী। এতে অ্যান্টিঅক্সিজেন, অন্থোসায়ানিন, ভিটামিন সি, বিভিন্ন মিনারেল, ডায়োটারি ফাইবার থাকে বলে দেহের ক্ষয়পূরণ, পুষ্টিসাধন ও রোগ প্রতিরোধসহ নানা উপকার করে। সুপার ফুড আমাদের ইমিউন ফাংশন বৃদ্ধি করে এবং রোগ প্রতিরোধে বা অগ্রগতির সম্ভাবনা হ্রাস করে
স্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনে সহায়তা করে। সুপার ফুড সম্পর্কে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, - সুপার ফুড খাবারের এক একটি বিভাগ যা সুপার - স্বাস্হ্যকর। তবে প্রতিটি স্বাস্থ্যকর খাবার সুপার ফুড নয়। ‘প্রতিটি সুপার ফুডের বিশেষ পুষ্টিগুণ রয়েছে। এসব বিশেষ পুষ্টিগুনের কারণে মানব শরীরের হার্টের সমস্যা, ক্যান্সার প্রতিরোধ, প্রদাহ হ্রাস, কোলেস্টেরলকে নিয়ন্ত্রণে রাখাসহ একটি শক্তিশালী ইমিউন সিস্টেম তৈরি করে। সুপার ফুডে বিশেষ যে সব পুষ্টিগুণ থাকে তার মধ্যে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস অন্যতম। অ্যান্টিঅক্সিডেন্টসের প্রাকৃতিক যৌগগুলো মানব শরীরের কোষকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। যার ফলে হৃদরোগ, ক্যানসারের মতো জীবন হরণকারীসহ অন্যান্য রোগের ঝুঁকি কমিয়ে দেয়। সুপার ফুডে প্রচুর খনিজ পদার্থ থাকে। আমাদের শরীরের খনিজ পদার্থ মূলত অজৈব পদার্থ, এগুলো ছাড়া শরীরের পক্ষে কর্মচঞ্চল রাখা একেবারেই অসম্ভব। খনিজ লবন দেহের অস্থি, দাঁত এনজাইম ও হরমোন গঠনে সাহায্য করে। ক্যালসিয়াম দাঁত ও হাড় গঠনে, রক্ত জমাট বাঁধতে, স্নায়ু ব্যাবস্থায় সুষ্ঠু কাজ করতে সহায়তা করে। আয়োডিন থাইরয়েড গ্রন্থির কাজ ও বিপাকের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনে সহায়তা করে। ভিটামিন হচ্ছে এক ধরনের জৈবিক উপাদান যা আমাদের শরীরে একেবারে তৈরি হয় না বা দরকারের চেয়ে কম তৈরি হয়। আমাদের দেশের মানুষ খাবারের ভিটামিন নিয়ে সবচেয়ে বেশি
চিন্তিত থাকে। অথচ এই উপাদানটি আমাদের শরীরে খুব অল্প পরিমাণ লাগে। তবে এটা ধারাবাহিকভাবে শরীরে যোগান দিতে হয়। এই ভিটামিনের ঘাটতি হলে শরীরে নানারকম সমস্যা দেখা দেয়। বিজ্ঞানীরা তের প্রকার ভিটামিনের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছে। ভিটামিন শরীরে বিভিন্ন কোষের স্বাভাবিকতা রক্ষার কাজে সহায়তা করে।
রক্তের কাজ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ভিটামিনের অভাবে রাতকাণা, রক্তসল্পতা, চর্মরোগ, রিকেট ও অস্টিওম্যালিসিয়া (হাড়ের রোগ) ও স্নায়ুরোগ দেখা যায়। আবার অধিক ভিটামিনের প্রভাবে শরীরে যে সব সমস্যা দেখা যায় সেগুলো হলোঃ ভিটামিন-এ এর আধিক্যের কারণে হাইপারভিটামিনসিস, ভিটামিন-বি১ এর কারণে তন্দ্রাভাব, ভিটামিন-বি৩ এর কারণে লিভারে বিরূপ প্রভাব, ভিটামিন-বি৫ এর কারণে বমি বমিভাব ও ডায়রিয়া এবং ভিটামিন-ই এর কারণে হার্ট ফেইলিউর হয়ে থাকে। এছাড়াও সুপার ফুডে থাকে ফাইবার, ফ্ল্যাভোনয়েডস এবং
স্বাস্থ্যকর চর্বি। ফাইবার শরীরের কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে, হৃদরোগ প্রতিরোধ করে এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিসে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ করে।
ফ্ল্যাভোনয়েডসে এন্টিইনফ্লেমেটরি এবং অ্যান্টি- কার্সিনোজেনিক বৈশিষ্ট্য আছে। এগুলো উদ্ভিদে পাওয়া যায় স্বাস্থ্যকর চর্বি হলো মনোস্যাচুরেটেড ও পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট। একে ভালো চর্বি বলা হয়। এটি আমাদের শরীরে কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে এবং হৃদরোগ এবং স্ট্রোক প্রতিরোধ করে।
আমাদের আশেপাশে সস্তায় যে সব সুপার ফুড পাওয়া যায় সেগুলো খুব সহজেই আমরা, আমাদের খাদ্য তালিকায় রাখতে পারি। আপেল, কমলা, ড্রাগণ ফল এগুলো সুপার ফুড কিন্তু দাম বেশি হওয়ায় সাধারণ মানুষ সব সময় এগুলো কিনতে পারে না।
তবে এর বিকল্প হিসেবে কলা, পেয়ারা, পেঁপে, জাম, আনারস, গাজর খুব সহজেই কম মূল্যে এগুলো সংগ্রহ করা সম্ভব। বাদাম, টকদই, কম চর্বিযুক্ত দুধ, ডিম, কুমড়া, হলুদ সবজি-ফল সুপার ফুড হিসেবে স্বীকৃত। গাঢ় পাতাযুক্ত সবুজ শাকসবজিতে ভিটামিন এ, সি এবং ই প্রচুর পরিমাণে থাকে। এসব শাকসবজি ক্যান্সার প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এছাড়াও এসব শাকসবজিতে ভিটামিন -কে এবং ফোলেট থাকার কারণে হাড় ও হৃদরোগের ঝুঁকি কমিয়ে দেয়। দারুচিনি আমাদের দেশের সকল মানুষের কাছে একটি পরিচিত মসলা। এটি মানবদেহের প্রদাহ, রক্তের শর্করার পরিমাণ এবং কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে। চিয়া বীজ মেক্সিকো
এবং গুয়েতেমালার একটি ফুলের বীজ। এই বীজে ফাইবার, প্রোটিন এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের পাশাপাশি ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন ও জিঙ্ক পাওয়া যায়। এগুলো কম ক্যালোরিযুক্ত খাবার যা মানুষের জন্য খুবই সহায়ক। আদা, রসুন, হলুদ, কুমড়া, মসুরের ডাল, পালং শাক, মূলা শাক, শালগম, বাধা কপি, মটরশুঁটি এ সবই সুপার ফুড। মানব শরীরের জন্য উপকারী। আমলকি, আখরোট অ্যভোকাডা, ব্লুবেরি, এক্সটা ভার্জিন অয়েলের উপকারিতা সম্পর্কে আমরা কমবেশি জানি।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে প্রতিবছর শুধু খাবারের কারণেই এক কোটিরও বেশি মানুষ মারা যায়। আমাদের দেশে এমনিতেই পুষ্টি বৈষম্য রয়েছে, যা নিরসনে কাজ করছে সরকার। সুপার ফুড একই সাথে স্বাস্থ্যকর এবং রোগবালাই প্রতিরোধকারী।তাই সুস্থ থাকার জন্য শরীরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয় উপদান সুপার ফুড ।সুস্বাস্থ্য ও রোগ প্রতিরোধের মাধ্যমে স্বাস্হ্যকর দীর্ঘ জীবন পেতে হলে ফার্স্ট ফুড নয় সুপার ফুডকে বেছে নিতে হবে।
২৮.১১.২০২২ পিআইডি