News update
  • Roof collapses at Dominican Republic nightclub, killing 98 people     |     
  • Netanyahu-Trump meet reveals unexpected gaps on key issues     |     
  • Move to prolong Interim Govt in name of keeping Yunus in power: Manna     |     
  • Billionaire Backers Turn Critics of Trump’s Tariff Plan     |     

বাংলাদেশে মাত্র দু’জন কথা বলেন যে ভাষায়

গ্রীণওয়াচ ডেস্ক বিবিধ 2024-02-21, 2:53pm

iaduayd8iu-7118d5d42481f54d77bb6ebd1edb55b91708505593.jpg




“আমরা দুই বোন আছি। আমরা মারা গেলে এই ভাষাও শেষ হয়ে যাবে। আমাদের দুই বোনের মতো কেউ আর কথা বলতে পারবে না।” চা শ্রমিক ক্রিস্টিনা কেরকেট্টার এ আক্ষেপ যেন বাংলাদেশ থেকে একটি ভাষা হারিয়ে যাবার ঘোষণা দিচ্ছে।

তার বড় বোন ভেরোনিকা কেরকেট্টার আক্ষেপ, “এখন যদি আমরা দুই বোন মারা যাই এই ভাষাও শেষ আমাদের সাথে সাথে। আর কেউতো বলতে পারে না।”

ক্রিস্টিনা ও তার বোন ভেরোনিকা কেরকেট্টা খাড়িয়া ভাষা নিয়ে বলছিলেন। তাদের কথায় স্পষ্ট বোঝা যায়, খাড়িয়া ভাষা বাংলাদেশে কতটা হুমকির মুখে রয়েছে।

খাড়িয়া ভাষাটি পারসি ভাষা হিসেবেও পরিচিত। খাড়িয়া সমাজ প্রধান, ভাষা গবেষকরা জানান বাংলাদেশে এই দুই বোনই কেবল অনর্গল খাড়িয়া ভাষায় কথা বলতে পারেন।

শ্রীমঙ্গলের রাজঘাট চা বাগানের অদূরে বর্মাছড়া খ্রিস্টান পাড়ায় দুই বোন ক্রিস্টিনা কেরকেট্টা ও ভেরোনিকা কেরকেট্টার বসবাস। তাদের পিতামাতা এসেছিলেন ভারতের রাঁচি থেকে। মা-বাবার কাছে খাড়িয়া বলতে শিখলেও এ ভাষায় লেখাপড়ার কোনো সুযোগ ছিল না তাদের।

এখন পাড়া-প্রতিবেশী কিংবা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে প্রয়োজন অনুসারে বাংলা, সাদরি এবং বাগানি ভাষায় কথা বলেন।

এর কারণ- পরিবার পরিজন, পরবর্তী প্রজন্ম, পাড়া, গ্রামে কোথাও খাড়িয়া ভাষায় কথা বলার মতো মানুষ নেই। মাতৃভাষার চর্চা, বইপত্র এবং সংরক্ষণের অভাবে বাংলাদেশ থেকেই হারিয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে ভাষাটির।

বাংলাদেশে সিলেট অঞ্চলের ৩৫টি চা বাগানের গ্রামে তিন থেকে পাঁচ হাজারের মতো খাড়িয়া জনগোষ্ঠী রয়েছে।

খাড়িয়া সমাজ প্রধান জহরলাল পাণ্ডে জানান, হাতে গোনা দশ-পনেরজন খাড়িয়া ভাষার গুটিকয়েক শব্দার্থ জানেন এবং কিছু কিছু বোঝেন। সব মিলিয়ে কিন্তু বাংলাদেশে খাড়িয়াদের মুখের ভাষা হিসেবে এটি এখন মৃতপ্রায়।

“আমাদের পূর্বপুরুষরা এসেছে ঝাড়খণ্ড রাজ্যের রাঁচি থেকে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে, বাগানের জীবিকা নির্বাহের খাতিরে। ওরা যে ভাষাটা নিয়ে আসছে সেটা প্রয়োগ করতো। আমরা এখন বুঝতে পারতেছি কিন্তু কীভাবে ভাষাটি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বাঁচিয়ে রাখবো সেটাতো জানি না। যেমন এখন এরা দুইজন (ক্রিস্টিনা ও ভেরোনিকা) আছে। এই দুইজন যদি চলে যায় তাহলে বাংলাদেশে এই ভাষাটা থাকবেও না।”

খাড়িয়া ভাষা কেন হারিয়ে যাচ্ছে?

ক্রিস্টিনা ও ভেরোনিকা কথা বলতে পারলেও খাড়িয়া ভাষায় লিখতে বা পড়তে পারেন না। এ ভাষায় কোনো বইপত্র বা শিক্ষার ব্যবস্থা বাংলাদেশে নেই। এছাড়া চা বাগানের পাড়াগুলোয় মিশ্র জাতির বসবাস থাকার কারণে সেখানে এখন বাগানে প্রচলিত ভাষা এবং বাংলায় প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে।

ক্রিস্টিনা বলছিলেন, “বাচ্চারা স্কুলে যায়। বাংলাভাষায় পড়ালেখা করে। বাংলা কথা বলে। বাংলা ভাষা ভালবাসে।”

বর্মাছড়া গ্রামের শিশুরা যে স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা পায় সেখানে অন্তত আটটি নৃ-গোষ্ঠী রয়েছে। বর্মাছড়া শিশু শিক্ষাকেন্দ্রে শতাধিক শিক্ষার্থীর মধ্যে খাড়িয়া শিশু আছে ১৮-২০টি। স্কুলে গিয়ে দেখা গেল তাদের পাঠদান হচ্ছে বাংলায়।

এই স্কুলের দুজন শিক্ষিকাও খাড়িয়া সম্প্রদায়ের। তারাও খাড়িয়া ভাষায় কথা বলতে পারেন না। তাদেরই একজন লিজা নানোয়ার বলেন, আমরা এখানে খুব সংখ্যালঘু।

“আমরা জন্ম থেকেই ভাষাটা শুনিনি। দু’একজন পারে, তারা বাড়িতে ব্যবহার করে। আমরাতো সামগ্রিকভাবে এটা পাইনি। মৌখিকভাবে শুনেছি। বই আমি দেখিনি। বলতে গেলে আমরা হারিয়েই ফেলছি ভাষাটাকে। আর এখানে স্কুলে আমাদের পড়ানোর মাধ্যম হলো বাংলা। এই অবস্থায় আমরা বুঝতে পারি আমরা আসলে অনেক কিছু হারিয়েছি।”

খাড়িয়া সম্প্রদায়ের আরেকজন শিক্ষিকা গীতা বলেন, “মাঝে মাঝে লজ্জিত বোধ করি। আমিও যদি ভাষাটা পারতাম। কথা বলতে পারতাম, পড়তে পারতাম, নাচ-গানও করতে পারতাম।!

ভাষা সংরক্ষণের দাবি

ভারতের উড়িষ্যা এবং ঝাড়খণ্ডে খাড়িয়া ভাষা প্রচলিত আছে। সেখানে এ ভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা আছে। আছে বইপত্র এবং ব্যাকরণও। কিন্তু বাংলাদেশে এই ভাষা সংরক্ষণ বা পাঠদানের ব্যবস্থা নেই।

ক্রিস্টিনা বলছিলেন, বাংলাদেশে খাড়িয়া জাতি পাবেন। কিন্তু এই ভাষা আর পাবেন না।

“আমাদের জাতি আছে ভারতে। তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারি না। দেখা করতে পারি না। আমাদের ভয় করে। আমাদেরতো পাসপোর্ট নাই। সেরকম টাকা নাই তাই করতে পারি না।”

খাড়িয়া ভাষা বাঁচিয়ে রাখার জন্য নাতি-নাতনির সঙ্গে এ ভাষায় কথা বলেন সত্তরোর্ধ ভেরোনিকা কেরকেট্টা। তিনি বলেন, “এই ভাষায় যেন বইপত্র হয়। আমাদের ছেলেমেয়েরা শিক্ষিত হচ্ছে। তারা বই পেলে পড়ালেখা করে এই ভাষা বুঝতে পারবে।”

মাতৃভাষায় জ্ঞানার্জনের সুযোগ না থাকাতে ভাষাটি বাংলাদেশ থেকে বিপন্নপ্রায় হিসেবেই দেখেন ভাষা গবেষকরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাশরুর ইমতিয়াজের পিএইচডির বিষয় ভাষা সংরক্ষণ। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, খাড়িয়া ভাষা বাংলাদেশে বিপন্ন ভাষাগুলোর একটি।

“এ ভাষাটার সর্বশেষ দু’জন ভাষী আছেন। তারা যদি হারিয়ে যায় তাহলে একই সঙ্গে হারিয়ে ফেলবো যে খাড়িয়া ভাষা বাংলাদেশে এসেছিল কীভাবে। এই সাড়ে তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার মানুষের নিজস্ব ইতিহাস, সংস্কৃতি, গল্প কিংবা ধারণা- সবকিছু হারিয়ে যাচ্ছে।”

মি ইমতিয়াজ বলছেন, যেহেতু ভারতে খাড়িয়া ভাষা ও ব্যাকরণ সংহত আছে তাই ভারতের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমেও এ ভাষা টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা যায়।

“ভাষাটাকে যদি আমরা সংরক্ষণ করি সেক্ষেত্রে আমরা শুধু ভাষাটাকেই সংরক্ষণ করছি না বরং ওই সমগ্র মানুষের যাবতীয় গল্প, ইতিহাস আমরা সেগুলো জেনে থাকতে পারছি। তাই অন্যান্য বিপন্ন ভাষার মতো আমার মনে হয় খাড়িয়া ভাষাটা সংরক্ষণ করাটা এই সময়ে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।”

এ ধরনের ভাষা টিকিয়ে রাখতে যে পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় ভাষাবিজ্ঞানের ভাষায় সেটিকে বলা হয় ল্যাঙ্গুয়েজ রিভাইটালাইজেশন অর্থাৎ ভাষার পুনরুজ্জীবিকরণ।

মি. ইমতিয়াজ বলেন, “একেবারে নবীন পর্যায়ে যে খাড়িয়া শিশুরা আছে তারাও বাংলা বর্ণমালা শিখছে। সুতরাং প্রথমত আমাদের প্রয়োজন খাড়িয়া ভাষার একটা পূর্ণাঙ্গ ব্যাকরণ এবং বাংলাদেশের মানুষের উপযোগী করে সেই খাড়িয়া ভাষার ব্যাকরণটিকে প্রস্তুত করা।”

“এরপরে প্রয়োজন হবে খাড়িয়াভাষী শিশুদের উপযোগী করে বইপুস্তক প্রণয়ন করা। তাদের মধ্যে গল্প বলা এবং ভাষাটা যাতে সর্বক্ষেত্রে প্রয়োগ হয় সেজন্য যদি ব্যক্তি পর্যায়ে স্থানীয় পর্যায়ে এবং সরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহণ সম্ভব তাহলে এ ধরনের ভাষা রিভাইটালাইজেশন বা পুনরিজ্জিবীকরণ সম্ভব”, যোগ করেন মি. ইমতিয়াজ।

মাতৃভাষা টিকিয়ে রাখার দাবি ভেরোনিকা কেরকেট্টারও। বলেন, “আমিতো খাড়িয়া ভাষা জানি। আমি সব বলতে পারি। বুঝতে পারি। এখন আপনারা বইপত্র ছাপান, টিভিতে দেখান। এই বইপত্রে লেখা আর টিভিতে দেখে আমাদের ছেলেমেয়েরা যেন শিখতে পারে, বলতে পারে।”

দুই বোনোর সঙ্গে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে ক্রিস্টিনা আক্ষেপ করে বলছিলেন, “এখন আমার বোন আছে, আমার সঙ্গে কথা বলে। আমার বোন যদি আমাকে ছেড়ে চলে যায়, আমি কার সঙ্গে কথা বলবো?”বিবিসি নিউজ