বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে এমনটা জানা গেছে। গভর্নর হয়ে প্রধান কোন কোন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবেন- এ নিয়ে সময় সংবাদকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বিস্তারিত জানিয়েছেন এ অর্থনীতিবিদ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, জুলাইয়ে খাদ্য-বহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতিসহ ভোক্তা মূল্যসূচক আগের মাসের তুলনায় ১ দশমিক ৯৪ বেসিস পয়েন্ট বেড়ে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছাড়িয়েছে ১৪ শতাংশ যা ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
অর্থনীতির এমন টালমাটাল অবস্থায় গভর্নর হিসেবে তার প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে মূল্যস্ফীতি সামাল দেয়া- এমনটা উল্লেখ করে আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘যেকোনো মূল্যে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে হবে। এটি যত দ্রুত কমিয়ে আনা যায় ততই মঙ্গল। বিশেষ করে সরবরাহ এবং চাহিদা দুই দিক থেকে সামঞ্জস্য রেখে এ কাজটি করতে হবে।’
বিগত কয়েকদিনে সরবরাহ ব্যবস্থা যেভাবে বিঘ্নিত হয়েছে তাতে করে এটি আদৌ সহজ হবে কী না- এমন প্রশ্নের জবাবে মনসুর বলেন, ‘অস্বীকার করার উপায় নেই, সরবরাহ খাতে বড় রকমের বিঘ্ন হয়েছে। তবে ভ্যালু চেইনের জায়গা থেকে ধীরে ধীরে এ অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন হচ্ছে। দেশের অর্থনীতির অবস্থা স্থিতিশীল হচ্ছে যা সরবরাহ সংকট কাটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’
এছাড়া চাহিদার দিকটি ঠিক রাখতেও মুদ্রানীতিতে পরিবর্তন আনা হতে পারে বলে মত দিয়ে মনসুর বলেন, ‘দুটি দিকেই পরিবর্তন আনা হবে। পদ্ধতি মেপে কাজ করা গেলে আগামী মাসগুলোতে মূল্যস্ফীতি ধীরে ধীরে কমে আসবে।’
মূল্যস্ফীতি ছাড়া দেশের ব্যাংক খাতে বর্তমানে বড় একটি সমস্যা আকাশচুম্বী খেলাপি ঋণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, মার্চের শেষে এসে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকায়, যা এযাবতকালে সর্বোচ্চ।
খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারে গভর্নর হিসেবে কী ব্যবস্থা নেবেন জানতে চাইলে মনসুর বলেন, ‘এটি ব্যাংকখাতে বহুদিনের পুঞ্জীভূত সমস্যা। এই সমস্যাকে অস্বীকার করে এড়িয়ে যাওয়ার কিছু নেই। খেলাপি কমাতে সবার আগে কী কী কারণে খেলাপি হচ্ছে, খেলাপির প্রকার এবং ধরণ কী সেটি নিরূপণ করতে হবে। এরজন্য ব্যাংকিং কমিশন বা এই ধাঁচের কোনো একটি কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কমিশনের কাঠামোগত কাজের মাধ্যমে পরবর্তীতে খেলাপি হওয়া ঋণ কমিয়ে আনা সম্ভব।’
এ ধরনের কর্মকাণ্ডে কেমন সময় লাগতে পারে জানতে চাইলে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘ব্যাংক কমিশন ছয়-সাত মাসের মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ রোডম্যাপ দিতে পারলে ঋণ আদায়ে বা খেলাপি কমাতে পুরোদমে কাজ করা যাবে। তবে খেলাপি কমাতে সরকারকে বড় রকমের ভর্তুকি দিতে হতে পারে। শুধু সরকার নয়, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকেও এ বিষয়ে আর্থিক এবং কারিগরি সাহায্য নেয়া যেতে পারে।’
বর্তমান ব্যাংকিং খাতে দুর্বল ব্যাংকের সংখ্যা অন্য সময়ের চেয়ে সর্বোচ্চ। এর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দুর্বল ব্যাংক একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত পর্যন্ত নিয়েছিল। নতুন গভর্নর হিসেবে এ ব্যাপারে করণীয় প্রসঙ্গে মনসুর বলেন, ‘তিনটি মাধ্যমে দুর্বল ব্যাংকের এসব সমস্যা সমাধান করতে হবে। প্রথমত, ছোট যেসব ব্যাংক একেবারেই দুর্বল এবং অচল হয়ে পড়েছে, এগুলোকে অপসারণ করা যেতে পারে। বাকি দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূতকরণ করতে হবে। এছাড়া পুঁজি সংকটে যেসব ব্যাংক ভুগছে সেখানে পুঁজির যোগান দিয়ে ব্যাংকগুলোকে আগের শক্তিশালী অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায় কি না- এ নিয়েও কাজ করতে হবে। বিশেষ করে সংকটে ভোগা ব্যাংকগুলোতে নতুন উদ্যোক্তা যারা বিনিয়োগে আগ্রহী তাদেরকে নিয়ে আসতে হবে।’
শুধু বেসরকারি না সরকারি ব্যাংকগুলোও তারল্য সংকট থেকে শুরু করে নানা ধরনের অনিয়মে জর্জরিত। সরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রে সংস্কারমূলক কী কী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে জানতে চাইলে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘সব সংস্কার একটি মাপকাঠির মধ্যে করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি যেই ব্যাংকই হোক না কেন সেই ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ, ব্যবসায়ী সমাজ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং সরকার- সবাইকে নিয়ে কাজ করে সমাধানের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। একপাক্ষিক কাজ দিয়ে সমাধান আশা করা যায় না।’ সময় সংবাদ