News update
  • World Ozone Day Highlights Progress and Future Action     |     
  • DG Health Services gives 12 directives to treat dengue cases     |     
  • Stock market shows recovery as investors back: DSE chairman     |     
  • BB to appoint administrators to merge troubled Islami banks     |     
  • Bangladesh Bank allows loan rescheduling for up to 10 years     |     

অরুচি

শরীফা চৌধুরী সাহিত্য 2025-07-04, 12:46am

sharifa-chowdhury-dd99ee312f793f5edae867bc952989ee1751568399.jpg

Sharifa Chowdhury



জামিলউদ্দীন খেতে পারছেন না আজ উনচল্লিশ দিন হলো। ভীষণ অরুচি ধরেছে খাবারে। বড়কুল গ্রামের অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থ জামিলউদ্দীন। গ্রামের লোকজন তাকে মোড়ল এর মত দেখে।

জোড়া পুকুর নিয়ে দুই প্রস্থের বিশাল বসতবাড়ি জামিলউদ্দীন এর । তার পিতৃপুরুষ পূবপাড়ার যেই আদি ভিটা তে ছিল, এই নয়া বাড়ি সেই ভিটার তিন গুণ বড়। বংশের শেষ এবং একমাত্র পুত্রসন্তান হওয়ায় বিপুল সম্পদের মালিক সে। ডিঙ্গাখালী বাজার থেকে সোজা মাটির যে কাঁচা রাস্তাটা বড়কুল গ্রামের দিকে চলে গেছে, সেটার শেষ মাথায় একটা ছোট দরগা বানানো। সেই দরগার উঁচু ঢিবি থেকে দাঁড়ালে জামিলুদ্দীন এর জোড়া পুকুর এর ওপারে তার দোচালা আলগ ঘর টা চোখে পরে।এই গায়ে বৈঠক ঘরকে বাংলা ঘর বা আলগ ঘর ই বলে। বাড়িতে নতুন কেউ এলে আগে এখানেই বসে। বাড়ির কামলারা রাতে এই ঘরেই ঘুমায়। জোড়া পুকুর দু’টি পেরুতেই সামনে পড়ে খলা। অনেক খানি জায়গা জুড়ে খালি ময়দান, যেখানে ধানের মৌসুমে ধান শুকানোর কাজ হয়।খলার একপাশে সারাবছরের আনাজপাতির ক্ষেত, তার শেষ মাথায় গোয়াল ঘর, হাঁস-মুরগির খোঁয়াড়। অন্য পাশে বাঁশের ঝাড়, এ পথ ধরে একটু আগালেই মসজিদ ।জামিলউদ্দীন নিজের অর্থে আর জায়গায় বানানো মসজিদ।

আলগ ঘর পেরিয়ে মূল বাড়ী। প্রথমে প্রশস্ত উঠান। উঠানের প্রবেশ পথে পুরাতন গন্ধরাজ লেবু গাছের ঝোঁপ। মৌমাছির পাল সারাক্ষণ বুদ হয়ে থাকে লেবু ফুলের সুবাসে। উঠানের মাথায় বড়ঘর, মানে মূল বাড়ী, তার ডানে বিশাল রসুইঘর- প্রকাণ্ড বড় বড় চুলা আর হাড়ি নিয়ে এলাহী কাণ্ড চলে রোজ সেখানে। উঠানের বামপাশে রবি শস্য রাখার বিরাট গোছালা ঘর। বাড়ির পিছনে নানান ফলমূলের গাছের বন ঘন হয়ে ঘিরে আছে । আর ঠিক শেষ সীমানায় যেখানে নিচু ক্ষেত নেমে গেছে, সেখানে বয়ে চলছে নদী মিনতি। বর্ষায় চারপাশ ছাপিয়ে দিশেহারা পানি নিচু ক্ষেত ডুবিয়ে উঁচু ভিটা ছুঁই ছুঁই করে। শুকনো মৌসুমে পানি নদীর তলায় খালের মত আকৃতি নেয়।

জমিলুদ্দিন এর বউ সোনাবানু।সোনার মতই রূপ তার। নয়জন সন্তান-সন্ততি, বাড়ীতে আশ্রিত -পালিত আত্মীয়স্বজন, বছর চুক্তি কামলাদের নিয়ে ভরপুর সংসার। গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ, দিগন্ত বিস্তৃত ফসলি জমি, আম-কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, কলার বাগ পুকুরের চারপাশে, বাড়ির উঠানে ফলে বারোমাসি সবজি। জামিলউদ্দীনের জীবন যেনো সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে উপছে পড়ছে। 

সেই জামিলউদ্দীন আজ খাবার মুখে তুলতে পারছেন না কতদিন হয়ে যাচ্ছে। তার বউ সোনাবানু, বৃদ্ধা বিধবা ফুপু খোদেজাবিবি নানান ধরনের পদ বানিয়ে তার সামনে দিচ্ছে প্রতি বেলা।পুকুরের টাটকা কাইক্কা মাছের ভাজী , বিলের তাজা টেংরা মাছের নিকলা (ভুনা), জমির পাশের নিচু ডোবা থেকে ধরা গয়রা (লাঠী) মাছের ভর্তা যা বানানো হয়েছে কাঁচা আদা, পেঁয়াজ, আর বেশি করে সবুজ কাঁচামরিচ ভাজা সহযোগে, মাগুর মাছ দেশী ছোট আলু সাথে লাল মরিচ বাটা দিয়ে ঝোল, নিজেদের পালা বড় লাল মোরগ এর ঝাল তরকারি, ঘন করে জাল দাওয়া কালো গাভীর দুধ সাথে আম কাঁঠালের বাটি ভর্তি রস- এ সব কিছুই নিত্যদিন তার আহারে দাওয়া হচ্ছে। জামিলুদ্দিনের পছন্দের খাবার এ সবই। কিন্তু সে কিছুই মুখে দিতে পারছেনা। চোখের খিদায় পাতে নিলেও এক লোকমা মুখে দিতেই কেমন একটা বোঁটকা গন্ধ পাচ্ছেন। ওখানেই আহারের সমাপ্তি টানতে হচ্ছে। বাড়ির কর্তার এমন অবস্থায় বাড়ির আর সকলে ভীষণ চিন্তিত। 

বেজায় ভোজন রসিক আর সৌখিন মানুষ জামিলউদ্দীন । তার ভোরবেলা টা শুরু হয় ফজরের সময় মসজিদে নামাজ তারপর পুকুরের চারপাশ আর হাওরের খেতে হাঁটাহাটি করে। বেলা কিছুটা বাড়ার আগেই বাড়ী ফিরে হাতমুখ ধুয়ে রসুই ঘরের খাবারের চৌকিতে গিয়ে বসেন। রসুই ঘরে তিন/চার জন কাজের ঝি থাকলেও সোনাবানু নিজে উপস্থিত থেকে সব তদারকী করেন। জামিলউদ্দীন কাজের ঝিদের হাত থেকে কোনোদিন খাবার বাড়া পছন্দ করেন না। সেটা সোনাবানু খুব ভালোমত জানেন বলেই স্বামী জামিলউদ্দীন এর খাবার এর আয়োজনে তিনি সর্বোচ্চ সতর্ক থাকেন যেনো এতটুকুও এদিক সেদিক না হয় কিছু। 

সকাল বেলা ঘরে পাতা দই দিয়ে চিড়া, মুড়ি, কলা বা আম কাঁঠালের রস দিয়ে হালকা নাস্তা সারেন জামিলউদ্দীন । বেলা দুপুর হওয়ার আগে আবার রসুই ঘরে ডাক পরে। গরম ভাত, ঘরে বানানো গাওয়া ঘি, চার/পাঁচ পদের মাছ, উঠানের সবজিক্ষেত থেকে টাটকা তোলা আনাজপাতি দিয়ে রান্না করা তরকারি, ভর্তা, ভাজি দিয়ে আয়েশ করে খেয়ে ওঠেন। তারপর সাদা ধবধবে পাঞ্জাবি, পরিষ্কার লুঙ্গি পরে, চুলের সিথি ঠিক করে বসেন আলগ ঘরের বারান্দার বড় কাঠের চেয়ারটায়।

চেয়ারটা দেখলেই বোঝা যায় এটা তার জন্য বিশেষ ভাবে বানানো- আকারে অনেক বড়, হাতল আর পায়ায় গভীর কাঠের কাজ খোদাই করা। চেয়ারের দুইপাশে সারি করে রাখা কাঠের বেঞ্চ। গাঁয়ের লোকজন এইখানে বসে তার সাথে কথা বলতে আসে, পরামর্শ নিতে আসে। যখনই বারান্দার সামনে দিয়ে গাঁয়ের কোনো মানুষ যায়, জামিলুউদ্দীন খেয়াল করে দেখেন তার কাপড়, চুল ঠিক ঠাক আছে কিনা। তাদের সাজসজ্জা তার মনঃপূত না হলে সাথে সাথে ডেকে কাছে আনবেন। বলবেন- “ কিরে বানেছা, এত আউলা ঝাউলা হইয়া কই যাও, এদিকে আসত দেখি, কাপড়ের গোছ ঠিক করো, হা ঐভাবে পেচ দেও, এইবার ঠিক আছে, যাও।“

আবার কখনও বলবে- “এই যে সুরুজ মিয়া, মাথায় দেখি পক্ষীর বাসা বানাইসো, ইকটু থামো, বেড়ার সাথে দেখো একটা চিরুনি আর আয়না আছে, একটা সিথা তুলো দেহী কেমন হয়, বাহ্ বাক্কা বেটা টা দেহা যাইতাসে এহন!”

মাঝে মাঝে গ্রামের বউ-ঝিরা এসে আনাজের খেত থেকে সবজি নিতে চাইলে তিনি নিজে ক্ষেতে ঢুকে মুলা, ডেঙ্গা (বড় ডাটা), কাঁচামরিচ বা বেগুন যখন যা হয় তুলে দেন।

আবার তিনি সময় সময় ভীষণ রাগী মানুষ ও হয়ে ওঠেন। খাবার খেতে বসে কোনো পদ তার স্বাদমতো না হলে বা সোনাবানুর বদলে কোনো ঝি তরকারির বাটি বেড়ে দিলে কতবার যে সেই খবর পা দিয়ে লাথি দিয়ে ফেলেছেন সোনাবানুর সামনে তার হিসাব নেই। এই জন্য তার খাবারের সময় ঝি চাকর তো দূরে থাক, তার ফুপূজান খোদেজাবিবি ও সামনে আসে না। সোনাবানুই তাই তার রাগের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি দেখেন। খাবারের ব্যাপারে জামিলউদ্দীন চরম খুত খুতে। একবেলার খাবার কোনোদিন ই তিনি আরেকবেলায় খান না। তাইতো বেলায় বেলায় নিত্য নতুন রান্নার ধুম লেগেই থাকে রসুই ঘরে।

 দুপুরটা যখন পড়তে শুরু করে, তিনি সুগন্ধী সাবান, গামছা, আর শুকনো ঝিঙ্গার খোসা দিয়ে বানানো মাজুনি নিয়ে পুকুর ঘাটে যান। পুরনো বিরাট গাছের কাণ্ড আর পাটাতন একটার উপর একটা দিয়ে বানানো ঘাট। আয়েশ করে ঘাটে বসে সময় নিয়ে সুগন্ধী সাবান দিয়ে ডলে ডলে গা ঘষেন।

তারপর পুকুরের টলটলে পানিতে নামেন। বুক পানিতে নেমে কয়টা ডুব দেন পরপর। বয়স হয়ে যাওয়ায় আর সাঁতার কাটেন না পানিতে। বয়স কালে মিনতি নদী সাঁতরে একুল অকূল পার হতেন নিমিষেই।

সোনাবানু ঐদিকে বাড়িতে উঠানের রোদে বড় জলচৌকি পেতে রাখেন। তার উপর রাখেন তামার বাটিতে গায়ে মাখার সরিষার তেল আর চিনির (সিরামিক্স) ছোট বাটিতে পানি, আর একটা শুকনো গামছা। জামিলউদ্দিন পুকুর থেকে গোসল সেরে এসে জলচৌকিতে আসন পেতে বসেন পড়ন্ত দুপুরের মিঠে রোদে। হাতের তালুতে সরিষার তেল আর পানির কয়েক ফোঁটা নিয়ে মিশিয়ে সারা গাঁয়ে মালিশ করেন আরাম করে। মাঝে মাঝে ছেলে মেয়েদের কেউ পিঠে মালিশ করে দেয়, কিন্তু কাজের লোকদের দিয়ে কখনো মালিশ করেন না। সব শেষে ঘিয়া রঙের হাফ হাতার ফতুয়া পরে রসুই ঘরে ঢোকেন দুপুরের ভোজন করতে। সোনাবানু পরম যত্নে তাকে নানান পদের সালুন বেড়ে বেড়ে খাওয়ান।

ভোজনরসিক জামিলউদ্দীন খেতে ভালোবাসেন। তার পরিচিত স্বাদের কোনো তারতম্য এতটুকুও সহ্য করেন না। কোনো তরকারিতে নুন ঝাল ইকটু এলোমেলো হলেই শুরু হয় গণ্ডগোল। সোজা তরকারির বাটি উল্টে ফেলে দিয়ে উঠে চলে আসেন খাবার থেকে। তার সেই রাগ পড়তে পড়তে বিকেল গড়িয়ে রাত গভীর হয়ে আসে। নতুন পদের মাছ তরকারি রেঁধে, স্বাধ ঠিকঠাক হয়েছে কিনা চেখে সোনাবানু ভয়ে ভয়ে যান তাকে খাবারের জন্য সাধাসাধি করতে। রাগের প্রকোপে সোনাবানুর উপর হাত তুলতেও জামিলউদ্দীন এর বাধে না অনেক সময়। সোনাবানু সব সহ্য করে স্বামীর সংসার করে যান পরম মমতায় আর সহিষ্ণুতায়।

সময় সুজুগ পেলেই খোদেজাবিবির মেয়ে নছিমন যে মায়ের সাথে এ বাড়িতেই আশ্রীতা, জামিলুদ্দিন এর তিন মেয়ে হুরমতি, মতিহার, আর হিরন কে নিয়ে সারা বছর খাবার পাপড়া, নানান ধরনের পিঠা পুলি করতে বসে পড়ে। জামিলুদ্দিন এর খুব পছন্দ এসব। তার সবচেয়ে ভালো লাগে চই পিঠা (মেরা পিঠা) খেতে। খোলায় ভাজা নোনতা স্বাদের চই পিঠা শীতের সকালে ঘরে পাতা ঘি দিয়ে খেতে তার দারুন লাগে।

ঐদিকে কামলারা সকাল বিকাল দুবেলা করে নদী পুকুর থেকে জাল দিয়ে নানান ধরনের মাছ ধরে আনে। প্রতিদিন টাটকা মাছ না খেলে জামিলউদ্দীন এর মন ভরে না। তার ভাগিনা রইস, এই বাড়িতেই পালিত আরেকজন, এই সব মাছ শিকারের ওস্তাদ। কামলাদের সেই দেখিয়ে নিয়ে যায় কোথায় কোন মাছ ভালো পাওয়া যাবে।

এইভাবেই এই বাড়ির সমস্ত কার্যকলাপ জামিলউদ্দীন কে ঘিরেই আবর্তিত হয়। সেই বিপুল বাসনা আর ভোজন রসিক লোকটার আজ খাবারের এমন অরুচিতে গোটা বাড়ী যেনো চিন্তায় মগ্ন।

কোনো খাবারেরই তিনি আর স্বাদ পাচ্ছেন না। গাঁয়ের মেয়ে-বৌ রাও এ খবর শুনতে পেয়ে হাতে হাতে করে এটা সেটা নিয়ে জামিলউদ্দীন এর বাড়ী হাজির হচ্ছে। এই যেমন করিমন বুড়ি জানত জামিলউদ্দীন সবুজ লাউ পাতা দিয়ে , রসুন আর কাঁচামরিচ সমেত হিদল (চেপা শুঁটকি) ভর্তা খুব পছন্দ করে। একদিন বুড়ির বাড়ির পাশ দিয়ে হাওরে যাওয়ার সময় ভর্তার গন্ধ পেয়ে জামিলউদ্দীন থেমে গিয়েছিল। বুড়ি কে একদিন বাড়ী ডেকে এনে সোনাবানু কে সেই ভর্তা শিখে নিতে বলেছিল।

সেইদিন অন্য সব তরকারি বাদ দিয়ে শুধু ঐ ভর্তা দিয়ে জামিলউদ্দীন অনেকগুলো ভাত খেয়ে উঠেছিল। করিমন বুড়ি তাই ভাবলো যদি এই স্বাদের ভর্তায় স্বাদ ফেরে জামিলউদ্দীন এর। নাহ। তাতেও কিছু হলো না।

তার খাবারের অরুচি শুরু এক সন্ধ্যে বেলায়। সাপ্তাহিক হাঠের দিন বাজার করে বাড়ি ফিরছিল জামিলউদ্দীন। পিছন পিছন তার জনা তিনেক কামলা ঠেলে নিয়ে আসছিল ছোট ঠেলাগাড়ি ভর্তি রসুই ঘরের বাজার আর সাংসারিক জিনিসপত্র। তার বাড়ীর সামনের জোড়া পুকুর পারে উঁচু ঢিবিটাতে পাড়া দিতেই তার মনে হলো পায়ের নিচে নরম কি জানি পড়ল। জামিলউদ্দীন ভাবলো গোবর বুঝি। কিন্তু সাথে সাথেই কে জানি খেঁকিয়ে উঠলো। ভালো করে নিচে তাকিয়ে দেখে ভীন গাঁয়ের এক পাগল পুরোনো ছেড়া কাঁথা জড়িয়ে বসে। সামনে কলাপাতায় লেটকা খিচুড়ির হলদে দোলা। তার পাড়া লেগে দুদিকে ছড়িয়ে মাটিতে পড়ে গেছে। পাগলটা ক্ষেপে জামিলউদ্দীন এর লুঙ্গি কামছে ধরলো আর এক নাগাড়ে বকে যেতে লাগলো। জামিলউদ্দীন এই ভাদ্র মাসের গরমে দুই মাইল হেঁটে এসে, ক্ষুধা তৃষ্ণায় অস্থির হয়ে রাগ সামলাতে পারলনা। এক লাথি দিয়ে লোকটাকে সরিয়ে দিলো আর একরাশ গালাগাল দিতে দিতে আসলো।

বাড়ী ফিরে চাপ-কলের ঠান্ডা পানিতে হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসলো একরাশ ক্ষুধা নিয়ে। হাতমুখ ধোয়ার সময় ই রসুই ঘর থেকে লেবু পাতা দিয়ে মাছের মুচি রান্নার ম ম গন্ধ পাচ্ছিলো। খাবার আসনে বসে দেখলো সাথে ঘরে পালা কবুতর এর মাংস কষা, কৈ মাছ ভাজি, বোয়াল এর মাথা-পেটি দিয়ে মাষকলাই এর ঘন ডাল, প্রচুর পেঁয়াজ রসুন আর শুকনা মরিচ দিয়ে মুচমুচে করে ভাজা শুকনো পাট শাক। বাহ্! এত সব মজার খাবারের বাহার দেখে জামিলুদ্দীন এর সারাদিনের ক্লান্তি নিমিষেই দূর হয়ে গেলো। খেতে বসে প্রথমেই পাতে তুলে নিলো শুকনো পাটশাক ভাজি। মুখে এক লোকমা পুরে চাবাতেই তার মুখটা কেমন কুঁচকে আসলো। কেমন প্রকট একটা বোঁটকা গন্ধ পেলেন যেনো।

ক্ষুধায় ক্লান্ত দেখে চুপচাপ কিছু না বলে নিলেন কৈ মাছ পাতে। নাহ্। সেই বোটাকা পঁচা গন্ধ!

নীরবে তাকিয়ে দেখলেন তার ছোট দুই ছেলে আওয়াল আর আলিম মজা করে সব খাচ্ছে। একপাশে মাছটা রেখে নিলেন কবুতরের এর মাংস কষা। মশলা দিয়ে ভাত মেখে এক লোকমা মুখে দিতেই তিনি বমি করে দিলেন। সেই একই দুর্গন্ধ! তিনি তার স্বভাব মত রাগে সব লাথি দিয়ে ফেলে উঠে চলে গেলেন গজরাতে গজরাতে। মনে মনে ভাবলেন নিশ্চয়ই বেশি গরমে হাট থেকে ফিরে গা গুলিয়ে গিয়েছে। সকালে উটলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

সকালে কচি ডাটা দিয়ে সদ্য নদী থেকে ধরা তাজা চাপিলা মাছের চচ্চড়ি দিয়ে খেতে বসলেন। সেই একই বোটকা পঁচা গন্ধ পেলেন। এক লোকমাও ভাত খেতে পেলেন না। দুপুরে তার জন্য গাছের জলপাই আর পুকুরের পুটি আর চিংড়ি মাছ দিয়ে টক রান্না করে দাওয়া হলো যাতে জিভের স্বাদ ফিরে। কিছুতেই কিছু হলো না। সেই একই গন্ধ পাচ্ছেন সব খাবারে। হাজার রকমের খাবারের পদ তার সামনে এনে রাখলেও তিনি কোন কিছুর আর স্বাদ পাচ্ছেন না। এভাবেই আজ উনচল্লিশ দিন পার হলো। ভাত ছেড়ে শুধু সাবু-সুজি , মুড়ি খেয়ে খেয়ে শরীর তার শীর্ণকায় হয়ে গেছে। 

চল্লিশতম দিনে জামিলুদ্দীন ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠেই কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেন। বাড়ীর বাতাস যেনো তার কাছে অসহনীয় লাগছিল। একটা ফতুয়া আর লুঙ্গী গায়ে হাঁটা ধরলেন বাড়ির পিছনের মিনতি নদীর তীর ধরে। হাঁটতে হাঁটতে কখন যে তিনি কোনার ঘাট পেরিয়ে বংশী নদীর মোহনায় এসে পৌঁছালেন বুজতেই পারলেন না। এদিকে দুপুরের রোদ কড়া করে মাথার উপর চড়ে উঠেছে। একটু ছায়ার আশায় তিনি এদিক সেদিক তাকালেন। একটা উঁচু ঢিবির উপর একটা ছোটখাটো জারুল গাছ চোখে পড়ল। সেখানেই দু’পা ছড়িয়ে বসলেন। ইকটু সুস্থির হয়ে বসে সামনে তাকাতেই দেখলেন একটা জেলে পরিবার নদী ঘেঁষে নিচু জমিতে একটা ডিঙি নৌকার ছাউনির মতো একটা ঘর বেধেছে। চুলায় ছোট একটা মাটির হাড়ী আর ধোয়া দেখে বুজলেন খাবারের আয়োজন চলছে। জেলে বউ চুলার আগুন ঠিক করে দিচ্ছি। আসেপাশে দু'টি টি ফ্রগ পোড়া আট, দশ বছর বয়সী মেয়ে, একটি টি উদোম গায়ের পাঁচ বছর বয়সি ছেলে, আর একটি তেরো/চৌদ্দ বছর বয়সী ছেলে দেখলেন। জেলের ছেলেমেয়ে হবে এরা তিনি ভাবলেন। নদীর পানিতে জেলে কে গোসল করতে দেখলেন।

জেলে পানি থেকে উঠে এসে লুঙ্গি টা বদলে বাচ্চা গুলাকে ডেকে নিয়ে খেতে বসলেন। আয়োজন খুব সামান্য মনে হচ্চে। ভাত দেখে মনে হচ্ছে সকালের ঠান্ডা ভাত। সাথে কলমী শাক আর আলু দিয়ে রান্না করা কোনো একটা শুটকির তরকারি চুলার পাতিল থেকে নামানো হলো। গরম করার গন্ধটা পেয়ে তিনি বুজলেন তরকারি টা বাসি হয়ে গেছে। অপ্রতুল ভাত সবার পাতে আর ইকটু করে বাসি তরকারি। ছেলে মেয়ে গুলো ওইটুক তরকারি দিয়ে তাদের ভাত গুলা মাখলো ঝরঝরে করে। 

ওই একটুখানি তরকারিতে ভালো করে মাখানোও যায়না। কিন্তু ওই শুকনো করে মাখানো ভাত গুলি বাচ্চাগুলো আনন্দ নিয়ে খেয়ে যাচ্ছে। তাদের চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে ওই কলমী-আলুর বাসি তরকারি যেনো কোনো অমৃত। ঐদিকে জেলে বউ কে দেখতে পেলেন একটা মাটির বাসনে অল্প একটু পান্তা নিয়ে তাতে লবণ দিয়ে ভালো করে চটকিয়ে নিলো। পরে দু'টা পোড়া শুকনা মরিচ আর এক টুকরো পেঁয়াজ দিয়ে পুরো ভাত টা কচলে নিলো । তারপর পানি দিয়ে ঘন করে মাখিয়ে তৃপ্তি নিয়ে খেতে লাগলো। জামিলউদ্দীন অপলক চোখে তাকিয়ে তাদের এই পরম তৃপ্তির আহার দেখতে লাগলেন। এদের আহারের এমন পরম তৃপ্তি তিনি যেনো কোনোদিন পাননি। এতক্ষণে তার ও যে খিদে পেয়েছে সেটা টের পেলেন। সকাল থেকে দানাপানি কিছুই খাননি।

হত দরিদ্র জেলে পরিবার এর আয়োজনহীন কিন্তু পরম তৃপ্তিকর মধ্যাহ্নভোজ এর এই দৃশ্য তাকে মনে করিয়ে দিলো কত দিন তিনি সদ্য রান্না করা ভালো ভালো কত খাবার লাথি দিয়ে ফেলে দিয়েছেন তার একটু অপছন্দ হলেই। মনে পড়ল কোনো এক পথিক এর দিনান্তিকের আরাধ্য আহার কেও তিনি লাথি মেরে ছিলেন তার চলার পথে পড়ে যাওয়ায়। তিনি তো চাইলেই সেই লোকটাকে তার বাড়িতে নিয়ে তার সাথে বসিয়ে পেট পুড়ে খাওয়াতে পারতেন। না জানি দিনশেষের ওইটুকু খাবার হারিয়ে পাগলটার মনে কতনা যাতনা হয়েছে। জামিলুদ্দীন এর এসব কিছু ভেবে দারুন অনুশোচনা হতে লাগলো। তিনি ঠিক করলেন এর প্রায়শ্চিত্ত তিনি করবেন নিজের হাতে। তিনি বাড়ির পথে পা বাড়ালেন।

অগ্রহায়ণ মাস। কামলারা বাড়ির সামনের খলাতে ধান শুকাচ্ছে । দুপুরের বেলা হয়ে এসেছে। এমন সময় জোড়া পুকুরের কোনায় একটা লোক এসে উঠলো। পুকুর পাড়ের বড়ই গাছটা থেকে বড়ই পাড়ার চেষ্টা করছিল সে। জামিলউদ্দিন আলগ ঘরের চেয়ারে বসে থেকে তাকে দেখলেন। কামলাদের একজন হাসু জামিলুদ্দীন এর কাছেই বেঞ্চি তে বসে দড়ি পাকাচ্ছিল। জামিলুদউদ্দিন এর চোখে চোখ পড়তেই হাসু বুজলো কি করতে হবে।

গত কয়েক বছর ধরেই জামিলুদ্দীন দিনে একজন আগন্তুক বা পথিককে বাড়িতে খেতে নিয়ে যান। 

তার উদ্দেশ্য তাদের তৃপ্তির সাথে খেতে দেখা। যেদিন কাউকে পান না, সেদিন তিনি আহার গ্রহণ করতে পারেননা। কারণ টা হলো, তিনি কাউকে অতি আগ্রহ আর রুচি নিয়ে খেতে না দেখলে আর খেতে পারেন না। আগে সেই অথিতি দের খাওয়ান। নিজে কাছে বসে থেকে আগিয়েন দেন, মন ভরে দেখেন তাদের খাওয়া। বাড়ির লোকজন ও এখন এ নিয়মে অভ্যস্থ। তাই প্রতিদিন যাই রান্না হোক, ভালো কিছুর আয়োজন থাকবেই অতিথিদের কথা চিন্তা করে।

আগন্তুক লোকটা কে নিয়ে তিনি ভেতর বাড়ী গেলেন। রসুই ঘরের বারান্দায় পাটি পেতে তাকে খেতে বসালেন। তার সামনে যা যা রান্না হলো সব বাটিতে করে এনে দাওয়া হলো। কচি ঝিঙ্গা দিয়ে বড় বেলে মাছের তরকারি, কাঁঠালের বিচি দিয়ে হাঁসের মাংস, লাউ দিয়ে বড় বাইম মাছের তরকারি। তিনি নিজ হাতে লোকটার পাতে খাবার তুলে দিচ্ছেন। লোকটার মজা করে খাওয়া দেখে জামিলুদ্দীন এর খাওয়ার প্রবল রুচী হচ্ছে। আজও তিনি খেতে বসবেন আগন্তুক এর রেখে দাওয়া খাবার খেতে, পরম যত্নে, স্বাদের সাথে।

(লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ভাষা বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, আগারগাঁও, ঢাকা-১২০৭, (বর্তমানে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ লিডস এ PhD অধ্যয়নরত) ।