News update
  • Khaleda Zia hospitalised again      |     
  • The Deadliest Days for Journalists in War Zones     |     
  • NY police arrest 300 at pro-Palestinian student protests     |     
  • Dhaka to enhance eco-tech in rice cultivation to cut gas emission     |     
  • Gazans on tenterhooks awaiting news of ceasefire call     |     

হাইকোর্টের 'প্রগতিশীল' রায়ে নারীর অভিভাবকত্ব কতটা অর্জিত হলো?

গ্রীণওয়াচ ডেস্ক আদালত 2023-01-25, 9:51am

d4562210-9bf9-11ed-920c-99267f6b05ca-e6fbdd34130cd3a5c9c7078752db5e681674618670.jpg




ইশিতার (আসল নাম নয়) বয়স যখন সাত বছর তখন তার পিতা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। স্বামীর বিয়ের পর মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে ঢাকায় চলে আসেন ইশিতার মা।

কিন্তু তার জন্য রাজধানীতে অপেক্ষা করছিল অন্য এক জীবন। কোথাও বাড়ি ভাড়া নিতে পারছিলেন না। সন্তানদের পিতার নাম ও জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া পারছিলেন না তাদেরকে স্কুলে ভর্তি করাতে। কারণ সবখানেই ছেলেমেয়ের পিতার নাম চাওয়া হতো।

কৌশলে কোথাও নাম দিয়ে, কোথাও না দিয়ে, অনেক সংগ্রাম করে সন্তানদের লেখাপড়া শেষ করিয়েছেন তিনি। ছেলে ও মেয়ে- দু’জনই আজ প্রতিষ্ঠিত।

অভিভাবক কে?

গুরুতর অসুস্থ পিতাকে নিয়ে ঢাকার একটি হাসপাতালে ছুটে গেলেন আজিজা আহমেদ। সেসময় তার ভাই ছিলেন রাজধানীর বাইরে। এক পর্যায়ে পিতার শারীরিক অবস্থার এতোটাই অবনতি ঘটলো যে তাকে সিসিইউতে নেওয়া জরুরি হয়ে পড়লো।

হাসপাতালের কর্মকর্তারা তখন জানতে চাইলেন তার সঙ্গে অভিভাবক কেউ আছেন কি না। কারণ সিসিইউতে ভর্তি করাতে হলে অভিভাবকের অনুমতি নেওয়া প্রয়োজন। উত্তরে ওই নারী বললেন যে তিনিই অভিভাবক।

হাসপাতাল: আপনার সাথে পুরুষ মানুষ নাই? আপনার গার্ডিয়ান কে?

আজিজা: আমিই গার্ডিয়ান। আমাকে বলেন।

হাসপাতাল: আপনাকে বললে কি আপনি বুঝবেন? সিদ্ধান্ত দেওয়ার মতো কোনো লোক নাই?

আজিজা: ধরেন আমার কোন ভাই নাই, স্বামীও নাই, তাহলে কি আপনারা বাবাকে ভর্তি করাবেন না?

এই প্রশ্নটা আজিজা আহমেদ ইংরেজিতে করেছিলেন। পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কথা না বাড়িয়ে তার পিতাকে সিসিইউতে নিয়ে যান।

হাইকোর্টের রায়

আজিজা এবং ইশিতা দুজনই মঙ্গলবার হাইকোর্টের দেওয়া রায়কে অভিনন্দন জানিয়ে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিয়েছেন।

ইশিতা লিখেছেন, “সরকারি নথিতে অভিভাবক হিসেবে মায়ের নাম থাকাই যথেষ্ট। এরকম একটি রায় যদি আরো আগে দেওয়া হতো, আমার ভাই এবং আমাকে সারা জীবন ধরে অপ্রীতিকর প্রশ্নের মুখে পড়তে হতো না। আজ অনেক মা ও সন্তান স্বস্তি পেল।”

আর আজিজা আহমেদ লিখেছেন: “সমাজে বাবা যা করেন, মা কোনো অংশেই কম করেন না। মা কম বোঝেন না। হাইকোর্টের এই রায় আমাদের জন্য একটি যুগান্তকারী রায়।”

কী রায় দিয়েছে হাইকোর্ট

বাংলাদেশে শিক্ষা ক্ষেত্রের সব ধরনের ফরমে এখন থেকে অভিভাবকের ঘরে বাবা ছাড়াও মা অথবা আইনগত অভিভাবকের নাম উল্লেখ করা যাবে বলে হাইকোর্ট রায় দিয়েছে।

আগে ফরমে শুধু পিতার নাম ব্যবহার করতে হতো। পরে সেখানে মায়ের নাম লেখাও বাধ্যতামূলক করা হয়। আর এখন যে রায় দেওয়া হলো তাতে অভিভাবক হিসেবে শুধু মায়ের নামও উল্লেখ করা যাবে।

হাইকোর্টের এই রায়ের ফলে মায়ের পরিচয়েও যেকোনো সন্তান শিক্ষার অধিকার পাবেন।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত দাশগুপ্ত সাংবাদিকদের বলেছেন, “অনেক সন্তান আছে, যাদের ক্ষেত্রে শুধু পিতার নাম লেখা সম্ভব না। যেমন কেউ যদি রেপ ভিকটিমের সন্তান হয়- যেমন আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়েও তো এমন ঘটনা ঘটেছিল।"

“এখন থেকে অভিভাবক হিসাবে যার নাম লিখতে চাইবেন, তার নামই লেখা যাবে। সেটা পিতার নাম হতে পারে, মাতার নাম হতে পারে অথবা আইনগত অভিভাবকের নামও হতে পারে,” বলেন তিনি।

প্রায় ১৬ বছর আগে পিতার স্বীকৃতি না পাওয়ায় ঠাকুরগাঁয়ের একজন শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রেশন ফরমে বাবার নাম লিখতে পারেননি। এরপর তাকে রেজিস্ট্রেশন কার্ড দেয়নি রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড। 

এই ঘটনায় ২০০৯ সালে করা এক রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে হাইকোর্ট এই রায় দিয়েছে।

রায়ের তাৎপর্য: যুগান্তকারী?

বাংলাদেশের সংবিধানে শিক্ষাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে উল্লেখ করা হলেও পিতার পরিচয় না দেওয়ার কারণে অনেক শিশু তাদের শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল।

আইনজীবীরা বলছেন, এর ফলে লঙ্ঘন ঘটছিলো সংবিধানেরও।

তারা বলছেন এখন এই রায়ের মাধ্যমে পিতা-মাতার পরিচয়হীন যেকোনো শিশুর শিক্ষা পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত হলো।

রিট আবেদনকারীদের আইনজীবী আয়েশা আক্তার বলছেন, “এখনও যারা এসএসসি এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে, আমরা গবেষণা করে দেখেছি তাদের ফরমে বাবা ও মায়ের নাম বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর যেকোনো একটা ঘর ফাঁকা রেখে আপনি ফরম জমা দিতে পারবেন না।”

কিন্তু অনেক শিশু রয়েছে যাদের পিতার পরিচয় জানা নেই অথবা তারা সেই পরিচয় দিতে চান না। তাদের পড়াশোনার ক্ষেত্রে কী হবে?

এরকম শিশুদের মধ্যে রয়েছে ছিন্নমূল শিশু, ধর্ষণের শিকার হওয়া নারীর সন্তান, পিতার স্বীকৃতি না পাওয়া সন্তান, যৌনকর্মীদের সন্তান, গর্ভ ভাড়া বা সারোগেসি এবং আইভিএফ পদ্ধতিতে জন্ম নেওয়া শিশু। 

ফরমে পিতা ও মাতার নাম বাধ্যতামূলক করার কারণে এই শিশুরা তাদের শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল।

পিতৃপরিচয়হীন শিশুদের লেখাপড়া

হাইকোর্টের এই রায়ের পর আইনজীবীরা বলছেন, এর ফলে তাদের লেখাপড়ার ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা দূর হলো।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মিতি সানজানা বলছেন, হাইকোর্টের এই রায়ের সঙ্গে অভিভাবকত্বের কোনো সম্পর্ক নেই। এই রায়টি শুধুমাত্র পিতৃপরিচয়হীন শিশুদের লেখাপড়ার ব্যাপারে প্রযোজ্য হবে।

“অনেকেই এটিকে যুগান্তকারী রায় হিসেবে উল্লেখ করছেন। তারা বলছেন, এর মধ্য দিয়ে নারীরা অভিভাবকত্ব পেয়ে গেল। কিন্তু আমি বলবো এটি তেমন কিছু নয়। এই রায়ে জমিজমাসহ পারিবারিক বিভিন্ন ইস্যুতে নারীকে কোনো অভিভাবকত্ব দেওয়া হয়নি। এজন্য আরো অনেক অনেক দূর যেতে হবে,” বলেন মিতি সানজানা।

তিনি বলছেন, হাইকোর্টের রায়ের অর্থ এই নয় যে অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে পিতার পরিবর্তে মায়ের নাম ব্যবহার করা যাবে।

পিতার নাম কেন বাধ্যতামূলক

আইনজীবীরা বলছেন, শিক্ষার ক্ষেত্রে যুগের পর যুগ ধরে পিতার নাম উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক থাকলেও বাংলাদেশের কোনো আইনে এরকম কোনো বিধান নেই।

সামাজিকভাবেই এটি প্রচলিত হয়ে আসছিল।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আয়েশা আক্তার জানান, আইনি সহায়তা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট বা ব্লাস্টের পক্ষ থেকে ‘তথ্য জানার অধিকার’ বা আরটিআই-এর অধীনে মাদ্রাসা ও কারিগরিসহ সব শিক্ষা বোর্ডের কাছে পিতা মাতার নাম বাধ্যতামূলক করার কারণ জানতে চাওয়া হয়েছিল।

জানতে চাওয়া হয়েছিল- কোন নীতিমালার অধীনে এটা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে?

কিন্তু তাদের কেউই এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি।

“তারা প্রত্যেকেই লিখলেন যে তাদের কাছে এসংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। শিক্ষা নীতি বা কোনো আইন- কোথাও এটা নেই। এর কোনো ব্যাখ্যাও তারা দিতে পারেনি,” বলেন তিনি।

“কোনো একটা সময়ে বৈষম্যমূলক এই প্র্যাকটিস চালু হয়েছিল। এবং বছরের পর বছর ধরে সেটা চলেই এসেছে।”

অন্যান্য ক্ষেত্রে কী হবে

আইনজীবীরা বলছেন, হাইকোর্টের দেওয়া এই রায় শুধুমাত্র শিক্ষার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে।

তবে যেসব ক্ষেত্রে নারীরা এখনও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন সেখানেও এই রায়ের প্রভাব পড়বে বলে তাদের অনেকে মনে করেন।

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির প্রেসিডেন্ট সালমা আলী এই রায়কে স্বাগত জানিয়ে বলেন, “এর মধ্য দিয়ে সমাজ পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসার পথে আরো এক ধাপ অগ্রসর হলো। এই রায় প্রগতিশীল।”

আয়েশা আক্তার বলেন, “এরকম আরো যেসব বৈষম্য রয়েছে সেসব ক্ষেত্রে আদালতে এই রায়টিকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যাবে, যার ফলাফল ইতিবাচক হতে পারে।”

উদাহরণ হিসেবে পাসপোর্টের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রেও পিতা ও মাতা দুজনের নামই দিতে হয়। এর ফলে পিতৃপরিচয়হীন ব্যক্তিরা পাসপোর্ট পাওয়া থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে।

তবে নারী পুরুষের মধ্যে অন্যান্য বৈষম্যের ক্ষেত্রে হাইকোর্টের এই রায়ের কতোটা প্রভাব পড়বে সেবিষয়ে নিশ্চিত নন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মিতি সানজানা।

“হাইকোর্টে যে রায় দিয়েছে সেটি শুধু শিক্ষার ব্যাপারে। আমরা এখনও পূর্ণাঙ্গ রায় দেখিনি। অভিভাবকত্বের বিষয়টি অনেক জটিল। এখানে ধর্মীয় এবং স্ট্যাটুটরি আইনও রয়েছে। ফলে এই রায় অন্যান্য বৈষম্যের ক্ষেত্রে কী ভূমিকা রাখবে সেটা এখনই বলা সম্ভব নয়,” বলেন তিনি।

ফলে নারীর  অভিভাবকত্ব কতোটা অর্জিত হলো তা জানার জন্য আজিজা এবং ইশিতাকে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তথ্য সূত্র বিবিসি বাংলা।