ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়ার যে নতুন আইন সোমবার থেকে চালু হয়েছে, সেটিকে অনেকে মুসলিম বিরোধী আইন বলে বর্ণনা করলেও বিজেপি দাবী করছে যে মুসলমানদের সঙ্গে এই আইনের কোনও সম্পর্ক নেই।
আবার বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে আসা হিন্দুদের একটা অংশের মধ্যেও দ্বিধা আছে যে নতুন আইনে তারা আবেদন করবেন কী না, তা নিয়ে।
এদিকে সোমবার রাতে নোটিফিকেশন জারি করে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন চালু করার পরে মঙ্গলবার থেকে ভারত সরকার একটি ওয়েবসাইট চালু করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, যারা বাংলাদেশ, পাকিস্তান আর আফগানিস্তান থেকে ভারতে এসেছেন, সেই হিন্দু,বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, জৈন, পার্শি এবং শিখ সম্প্রদায়ের মানুষরা এখন ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য আবেদন করতে পারবেন।
সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন যখন ২০১৯ সালে পাশ করানো হয়েছিল, তখন থেকেই ভারতের মুসলমানদের একটা বড় অংশ এবং বিজেপি-বিরোধী দলগুলি আশঙ্কা প্রকাশ করছিল যে এই আইনটির সঙ্গে সম্পৃক্ত করে জাতীয় নাগরিক পঞ্জী হালনাগাদ করা হবে, আর তার মাধ্যমে আসলে মুসলমানদের চিহ্নিত করে ভারতের নাগরিকত্ব বাতিল করে দেওয়া হবে।
আবার হিন্দু উদ্বাস্তুদের একটা অংশের আশঙ্কা আছে যে প্রথমে সরকার এটা জেনে নেবে যে তারা আসলে পড়শি দেশ থেকে ভারতে এসেছিলেন, তাই প্রথমে তাদের নাগরিকত্ব ছাড়তে হবে। তারপরে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে যে সেই ব্যক্তিকে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে কী না। যদি সরকার ওই ব্যক্তিকে নাগরিকত্ব না দেয়, তখন কী হবে?
আইনটি কী মুসলমান বিরোধী?
সোমবার থেকে চালু হওয়া সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনটিকে মুসলমান বিরোধী বলে অনেকেই অভিযোগ করছেন।
পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু যুব ফেডারেশনের প্রধান মুহম্মদ কামরুজ্জামানের আশঙ্কা, “যারা দেশান্তরিত হয়ে ভারতে চলে এসেছেন, তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হোক এটা এখানকার মুসলমান সমাজও চায়। এমনকি এত বছর ধরে কেন তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হয় নি, সেটাও আমাদের প্রশ্ন। কিন্তু একই সঙ্গে এরকমটা হবে না তো, যে এখন অ-মুসলমানদের নাগরিকত্ব দেওয়া হল, এর পরে সেই সূত্র ধরে ভূমিপুত্র মুসলমানদের কাছেও নাগরিকত্বের প্রমাণ চাওয়া হবে?”
তবে এই আশঙ্কা অমূলক বলে মনে করছেন বিজেপি নেতারা।
বিজেপি নেতা অধ্যাপক বিমল শঙ্কর নন্দ বলছেন, “এটা কোন দিক থেকে মুসলমান বিরোধী আইন? মুসলমানদের কথা তো আইনের কোথাও লেখাই নেই! হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, জৈন, পার্শি আর শিখরা যারা পাকিস্তান, আফগানিস্তান আর বাংলাদেশ থেকে চলে এসেছেন ভারতে, তাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার আইন এটা। কারও নাগরিকত্ব এই আইনের মাধ্যমে কেড়ে নেওয়া হবে, এটা সম্পূর্ণ ভুল প্রচার।“
বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দুরা কী ভাবছেন?
বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে এসেছেন, এরকম মানুষের মধ্যে যেমন হিন্দু আছেন, তেমনই রয়েছেন অনেক মুসলমানও।
সংশোধিত আইনে বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসা সেই সব মুসলমানরা ভারতের নাগরিক হওয়ার জন্য আবেদন করতে পারবেন না।
যদিও বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দু এবং মুসলমানদের একটা বড় অংশই কোনও না কোনও ভাবে ভারতের আধার কার্ড, ভোটার কার্ডের মতো পরিচয় পত্র যোগাড় করে ফেলেছেন।
মুসলমানরা নাগরিকত্বের আবেদন না করতে পারলেও ভারতীয় পরিচয়পত্রগুলি সরিয়ে রেখে নতুন করে ভারতের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করবেন বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দুরা?
এ নিয়ে দ্বিধায় আছেন তারা।
বাংলাদেশ থেকে ২০০০ সালে ভারতে চলে এসেছেন, এমন একজন হিন্দু ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলছিলেন, “আমার তো ভারতীয় পরিচয়পত্র সবই আছে। আমি নতুন করে আবার আবেদন করব কেন?”
আবার কলকাতা লাগোয়া অঞ্চলে বাস করেন এমন এক ব্যক্তি, যিনি বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগে চলে এসেছেন, তিনি বলছিলেন, “নতুন আইনে নাগরিকত্বের আবেদন করব কী না, তা নিয়ে একটু দ্বিধায় আছি।“
আরও অনেকের মধ্যেই এ নিয়ে দ্বিধা আছে যে নতুন ব্যবস্থায় আবেদন করলেই তাদের বর্তমান পরিচয়পত্রগুলি বাতিল হয়ে যাবে। এরপরে যদি কোনও কারণে তাদের নাগরিকত্বের আবেদন গৃহীত না হয়, তখন তো তারা দু কুলই হারাবেন।
বিজেপির নেতা অধ্যাপক বিমল শঙ্কর নন্দ বলছিলেন, “যেসব পরিচয় পত্র ওই ব্যক্তিদের বা তার মতো বাংলাদেশ থেকে আসা আরও বহু মানুষের রয়েছে, সেগুলো কিন্তু বেআইনি পথে যোগাড় করা। তারও ওপরে, ওই সব পরিচয় পত্রগুলোর কোনোটাই নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়। একমাত্র পাসপোর্টই হল নাগরিকত্বের প্রমাণ।
“কোনও ভাবে যদি এটা প্রমাণ হয়ে যায় ওইসব পরিচয় পত্র ভুয়ো নথির মাধ্যমে পেয়েছেন ওই ব্যক্তি, সেটা কিন্তু গুরুতর অপরাধ বলে গণ্য করা হবে,” বলছিলেন মি. নন্দ।
অন্যদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অমল সরকার বলছেন, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বাংলাদেশে হিন্দু, বৌদ্ধদের সমস্যায় ফেলতে পারে।
তার কথায়, “এটা ঠিকই সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন তৈরি করে মেরুকরণের রাজনীতি করার চেষ্টা করছে বিজেপি। তবে তার থেকেও বড় ইস্যু হল এই আইনটা পড়শি দেশগুলোতে সেখানকার সংখ্যালঘুদের সমস্যায় ফেলতে পারে। আফগানিস্তান আর পাকিস্তানের কথা বাদ দিলেও বাংলাদেশে হিন্দু, বৌদ্ধদের এবারে শুনতে হতেই পারে যে তোমাদের দেশ আছে তো ভারত, সেখানেই চলে যাও – নাগরিকত্ব পেয়ে যাবে। তারা সমস্যায় পড়লে কী হবে?”
সিএএ আসাম-চুক্তির বিরোধী?
সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন চালু হওয়ার পরেই সোমবার রাত থেকেই আসামে এর বিরোধিতা শুরু হয়ে যায়। মঙ্গলবার বনধেরও ডাক দিয়েছিল কয়েকটি সংগঠন।
তবে সেই ডাকে বিশেষ সাড়া মেলে নি বলেই রাজধানী গুয়াহাটির স্থানীয় সাংবাদিকরা জানাচ্ছেন। সিএএ-র বিরোধিতা শুরু হতে পারে, এই আশঙ্কায় রাজ্য পুলিশের তরফে সোমবার রাত থেকেই লিখিতভাবে কড়া অবস্থান নেওয়া হয়।
বনধ-হরতাল করে অথবা রাস্তা অবরোধ, ভাঙচুরের ঘটনা ঘটলে পুলিশ কঠোর হাতে তা দমন করবে বলে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।
তবে মঙ্গলবারও রাজ্যের বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে বিজেপি বিরোধী দলগুলি।
সিএএ বিরোধীরা বলছে, ১৯৮৫ সালের আসাম চুক্তি অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ রাত পর্যন্ত রাজ্যে আসা ‘বিদেশি’দের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা।
“সারা দেশে যেখানে দেশ-ভাগের পরের কয়েক বছরে পাকিস্তান থেকে আসা মানুষদের নাগরিক বলে বিবেচনা করা হয়, সেখানে আমরা আসামে সেই তারিখটা ১৯৭১ সাল পর্যন্ত মেনে নিয়েছি আসাম চুক্তি অনুযায়ী, শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে। কিন্তু এখন যদি ২০১৪ সাল পর্যন্ত যারা অন্য দেশ থেকে ভারতে এসেছেন, তাদেরও নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা ওঠে, যেমনটা নতুন আইনে বলা হয়েছে, তাহলে তো তা আসাম চুক্তিটাকেই অস্বীকার করা হয়,” বলছিলেন আসাম থেকে নির্বাচিত রাজ্যসভার সংসদ সদস্য অজিত ভুঁইঞ্যা। বিবিসি বাংলা