News update
  • Fire breaks out at jacket factory in Chattogram     |     
  • Dhaka, Delhi agree to bring down border killings to zero     |     
  • Natore’s Baraigram OC closed over negligence in bus robbery case     |     
  • Imported fruit prices surge by up to Tk 100 per kg     |     
  • 35% of air pollution in BD originates from external sources: Experts     |     

গ্রীস্মের আগেই সুপেয় পানির সংকটে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের মানুষ

গ্রীণওয়াচ ডেস্ক জলবায়ু 2023-03-12, 11:59am

8f2c7dd0-c014-11ed-bd9e-072d4a4bf7f5-cf139bb7d78a2adbbdb790014a6e273b1678600791.jpg




তীব্র গরম পড়ার আগেই বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা ও এর আশেপাশের উপকূলীয় অঞ্চলে নিরাপদ পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে। গ্রীষ্মের তাপদাহ বাড়ার সাথে সাথে এই সংকট আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা স্থানীয়দের।

গত বছর বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় এবারে শীতের পর থেকেই খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও এর আশেপাশের অঞ্চলের গভীর নলকূপ থেকে আর পানি উঠছে না। সুপেয় পানির অন্য উৎসগুলোয় লবণাক্ততা ছড়িয়ে পড়েছে।

আবার লবণ পানি পরিশোধন করতে যে ফিল্টারগুলো বসানো হয়েছিল সেগুলো অকেজো হয়ে পড়ায় দুষ্কর হয়ে পড়েছে বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহ।

খাবার পানি সংগ্রহে মাইলের পর মাইল পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অপরিকল্পিতভাবে ভূ-গর্ভের পানি উত্তোলন এবং লবণাক্ততার সমস্যা দূর করতে সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে যেসব উদ্যোগ হাতে নেয়া হয়েছে সেগুলো তদারকি না করার ফলে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলের জেলা পর্যায়ের তথ্য অনুযায়ী, খুলনার ২২ শতাংশ, বাগেরহাটের ১৫ শতাংশ এবং সাতক্ষীরার ১৩ শতাংশ মানুষ খাবার পানির সংকটে রয়েছে।

সরকারিভাবে এই তথ্য দেওয়া হলেও বাস্তবের চিত্র আরও ভয়াবহ বলছেন পরিবেশবাদীরা।

ওয়াসার পানি নিয়ে সংশয়

খুলনা মহানগরীর ৩৮ হাজার বাড়িতে পানি সরবরাহ করে আসছে খুলনা ওয়াসা।

ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা কমাতে ২০১৯ সালে গোপালগঞ্জের মধুমতী নদী থেকে পানি এনে পরিশোধন করে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে।

নগরবাসী নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করলেও এই পানি পান করা কিংবা রান্নার কাজে ব্যবহার করা নিয়ে তারা সংশয়ে থাকেন।

কারণ এই পানি হয়ে পড়েছে ঘোলা ও লবণাক্ত। খুলনা ওয়াসার দাবি, তারা সম্পূর্ণ পরিশোধিত পানি সরবরাহ করছেন। সঞ্চালন লাইনে লিকেজের কারণে বাসাবাড়িতে পৌঁছানোর সময় পানি লবণাক্ত ও দূষিত হয়ে পড়তে পারে বলে তারা ধারণা করছেন।

এমন অবস্থায় বিশুদ্ধ পানির জন্য নলকূপের পানির ওপরই ভরসা করার কথা জানিয়েছেন সাধারণ মানুষ।

খুলনা নগরীর বাসিন্দা শারমিন রহমান বলেন, “পানি পাচ্ছি, কিন্তু এটা শুধু ফুটিয়ে খাওয়াটা কতোটা নিরাপদ হবে জানি না। মাঝখানে কয়েকদিন পানি কিনে আনলাম। ওই পানিটা ডিপ টিউবওয়েল থেকে তোলে। শুধু খাওয়ার পানিটা নিয়ে আসি।”

খাবার পানি পেতে নগরবাসীদের অনেকেই শক্তিশালী সাবমার্সিবল পাম্প ব্যবহার করে পানি উত্তোলন করছেন।

সেটা শুধুমাত্র বহুতল ভবনের মালিকদের বাস্তবতা। নগরের নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোকে সেই ওয়াসার পানির ওপরেই নির্ভর করতে হচ্ছে।

অন্যদিকে, উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষদের এখনও দৈনন্দিন কাজে, সেইসাথে সুপেয় পানির জন্য নির্ভর করতে হয় পুকুর ও বৃষ্টির পানির ওপর।

তবে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অনিয়ন্ত্রিত চিংড়ি চাষ, চিংড়ি ঘেরে উঁচু বাঁধ না দেয়া, নদী প্রবাহ আটকে দেয়া, পুকুর ভরাট, খাল বেদখলের কারণে প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষগুলো নিরাপদ পানির তীব্র সংকটের মধ্যে দিয়ে দিন পার করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে।

সাধারণত শীতের মৌসুম থেকে বর্ষা আসার আগ পর্যন্ত একটা লম্বা সময় এই দুর্ভোগের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় উপকূলের সাধারণ মানুষকে।

নলকূপে পানি নেই

ওয়াসার পানি আসার আগে খুলনা নগরীর মানুষ মূলত মোটর চালিত নলকূপের মাধ্যমেই পানি উত্তোলন করে কাজ করতেন।

কিন্তু যত্রতত্র পানি তোলার কারণে মহানগরীর ওই নলকূপগুলোয় বর্তমান শুষ্ক মৌসুমে আর কোন পানি তোলা যাচ্ছে না।

শুধুমাত্র যারা গভীর নলকূপের সঙ্গে সাবমার্সিবল পাম্প ব্যবহার করছেন, তারাই কিছুটা পানি পাচ্ছেন।

একে অনাবৃষ্টি তার ওপর অপরিকল্পিতভাবে ভূগর্ভের পানি তোলার কারণে গত বছর খুলনার পানির স্তর স্বাভাবিকের চাইতে ২৫ থেকে ৩০ ফুট পর্যন্ত নীচে নেমে গিয়েছিল বলে জানা যায়।

যার ফলে চলতি শুষ্ক মৌসুমে পানির ভয়াবহ সংকট তৈরি হয়েছে যা সামনে আরও বাড়তে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো।

“মানুষ প্রচুর পরিমাণে ভূ-গর্ভস্থ পানি তুলে ফেলছে। একারণে মাটির নীচ থেকে পানির ফ্লো আর আগের মতো নেই,” বলেন খুলনার বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সুশীলনের সমন্বয়কারী সাজ্জাদ হোসেন।

জাতিসংঘের এক সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের দিক দিয়ে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম।

এদিকে বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন বিশেষ করে বোরোর আবাদ প্রধানত সেচ নির্ভর।

দীর্ঘসময় অনাবৃষ্টির কারণে নদী-নালা ও খালে-বিলে পানি না থাকায় চলতি বোরো আবাদে সেচ দিতে হচ্ছে শুরু থেকেই।

চাষাবাদে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ওপর মানুষের নির্ভরতা বেড়ে যাওয়ায় পানির স্তর আরও নিচে নেমে গিয়েছে।

এ ব্যাপারে বাগেরহাটের বাসিন্দা মো. আরজ আলী বলেন, “আমাদের এখানে টিউবওয়েলে কোন পানি ওঠেনা। মাঠঘাট শুকিয়ে চৌচির হয়ে গিয়েছে। এ বছর পানির অভাবে কৃষকরা হালচাষ করতে পারছে না, ধানের চারা রোপণ করতে পারছেন না। পানির অভাবে আর লবণে ফসল সব মরে যাচ্ছে।”

পানির পেছনে যাচ্ছে হাজার হাজার টাকা

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় এলাকায় নলকূপের গভীরতা ৭০০ থেকে ১২০০ ফুটের মধ্যে হয়ে থাকে।

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গিয়েছে, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় ১২০০ ফুট গভীর নলকূপ থেকেও তারা আর পানি তুলতে পারছেন না এতে সুপেয় পানির চরম সংকটে পড়েছে সাধারণ মানুষ।

সবচেয়ে বেশি বিপাকে নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা। খাবার পানির জন্য তাদের দূর দূরান্তের জলাশয়ের দিকে ছুটতে হচ্ছে। না হলে প্রতিদিনের পানি কিনে নিতে হচ্ছে।

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার রমজাননগর এলাকার বাসিন্দা ধনঞ্জয় বৈদ্য প্রতিমাসে তিন হাজার টাকার পানি কিনে থাকেন।

“রান্নাবান্নার পানি অনেক দূর থেকে আনা লাগে। আমি বাসায় নলকূপ বসিয়েছি কিন্তু কোন পানি ওঠে না। সাইকেলে করে দূর থেকে পানি আনা লাগে। গোসলের পানি, ধোয়া মোছার পানিও খুব কষ্ট কর সংগ্রহ করতে হচ্ছে। পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে গোসল আর করা যায় না। অত পানি নাই। খাওয়ার পানি বেশিরভাগ কিনে নেই। আমার পাঁচ জনের ফ্যামিলিতে পানি কিনতেই মাসে তিন হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়,” তিনি বলেন।

টানা অনাবৃষ্টির ফলে এই ভূগর্ভস্থ পানি আর রিচার্জ হচ্ছে না।

দ্রুত বৃষ্টি না হলে পানির স্তর আরও নিচে নামবে এবং তাতে উপকূলের নলকূপ দিয়ে পানি না ওঠার পরিস্থিতি তৈরি হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

পুকুরগুলোর কি অবস্থা?

ভূ গর্ভের পানির স্তর নেমে যাওয়ার আরেকটি বড় কারণ ভূ-উপরিভাগের পানির উৎসগুলো শুকিয়ে যাওয়া, বলছেন পরিবেশবাদীরা।

ইতোমধ্যে বহু পুকুর ভরাট হয়ে গিয়েছে, আশেপাশের গ্রামে যে কয়েকটি মিঠা পানির পুকুর রয়েছে সেগুলোর পানি শুকিয়ে গেছে। নদী ও খালগুলো দখল হয়ে যাওয়ায় পানি প্রবাহ কমে গেছে। সব মিলিয়ে ভূ-পৃষ্ঠের সুপেয় পানির উৎসগুলো কমে যাচ্ছে।

এদিকে উপকূলের বেশিরভাগ পুকুর ব্যক্তি মালিকানাধীন। সরকারি পুকুরের সংখ্যা হাতে গোনা। সরকারি পুকুর থেকে সবাই পানি তুলতে পারে।

এই অবস্থায় ওই পুকুরগুলোয় সকাল থেকেই লাইন পড়ে যায় পানি-পীড়িত এলাকার মানুষদের।

শুষ্ক মৌসুমে এসব হাতে গোনা কয়েকটি সংরক্ষিত পুকুর থেকে এক কলসি পানি সংগ্রহের জন্য কয়েক কিলোমিটার দূরের আরেক গ্রামে ছুটছেন তারা।

তেমনই একজন মনিরা বেগম। বিবিসি বাংলাকে তিনি জানান “প্রতিদিন পানি আনতে তাকে অন্তত এক ঘণ্টা পায়ে হাঁটা লাগে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে পানি সংগ্রহ করতে হয়। পানি আনতেই বেলা ফুরিয়ে যায়।”

“বাসাবাড়িতে খাবার পানি নেই, রান্নার পানি নেই, নেই গোসলের পানি। এক ড্রাম পানি ৩০ টাকা দিয়ে কিনে খাওয়া লাগে।”

এদিকে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন পুকুরগুলো সংরক্ষণ না করায় সেগুলোর পানিও ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে।

এ ব্যাপারে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সুশীলনের সমন্বয়কারী সাজ্জাদ হোসেন বলেন, “একটি পুকুরে প্রতি পাঁচ বছরে এক ফুট করে পলি পড়ে। এই পলিগুলো বছরের পর বছর খনন করা না হলে ওই পানি আর ব্যবহার করা যায় না। ব্যক্তি মালিকানাধীন পুকুরগুলো প্রায়শই খনন ছাড়াই পড়ে থাকে।”

লবণাক্ততা

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খুলনার চার উপকূলীয় উপজেলার নলকূপ, নদী, পুকুর ও খাল-বিলে লবণাক্ততার পরিমাণ গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছে। ২০২১ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) এক জরিপে এই তথ্য পাওয়া গিয়েছে।

ওই জরিপের তথ্য মতে, উপকূলীয় এসব উপজেলার মানুষের প্রতি লিটার খাবার পানিতে ১৫০০-২৪০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত লবণাক্ততা পাওয়া গেছে। রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততার গ্রহণযোগ্য মাত্রা প্রতি লিটারে ১০০০ মিলিগ্রাম। এর বেশি লবণাক্ততা থাকা মানে তা খাওয়ার অনুপযোগী।

আবার চিংড়ি ঘেরে উঁচু বাঁধ না দেয়ায় সেখানকার লবণাক্ত পানি পুকুরে ঢুকে পড়ছে এবং সেই পানিও আর খাওয়ার উপযোগী থাকছে না।

এমন অবস্থায় পুকুর নিয়মিত খননের পাশাপাশি লবণ পানি শোধনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন পরিবেশবিদরা।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সুশীলনের সমন্বয়কারী সাজ্জাদ হোসেন।

“বেড়িবাঁধ যদি ৩০-৩৫ ফুট উঁচু না হয় তাহলে লবণ ছড়িয়ে যেতে পারে। কিন্তু আমাদের এখানে বাধগুলো হয় ৫ ফুট থেকে ৭ ফুট। তাই লবণাক্ততা আটকানো যাচ্ছে না।” বলছেন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সুশীলনের সমন্বয়কারী সাজ্জাদ হোসেন।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটি ও অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষণায় বলা হচ্ছে মাটিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশের উপকূলের প্রায় দুই লাখ কৃষক বাস্তুচ্যুত হবেন। কারণ সেখানকার মাটিগুলো ধান চাষের অনুপযোগী হয়ে পড়বে।

জানা যায়, ২০০৯ সালে আইলা এবং তারও আগে সিডরের তাণ্ডবের পর থেকে এসব উপকূলীয় এলাকার সুপেয় পানির উৎসগুলো নষ্ট হয়ে যায়।

এসব এলাকায় সুপেয় পানি সমস্যার সমাধানে সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে পুকুর খনন, নলকূপ স্থাপন, লবণ পানি পরিশোধন যন্ত্র- পন্ডস অ্যান্ড ফিল্টার (পিএসএফ) স্থাপন এবং বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিংয়ের মত প্রকল্প হাতে নেয়া হলেও তেমন সুফল মেলেনি।

মেরামত ও সংরক্ষণ না করায় এরিমধ্যে অধিকাংশ পিএসএফ নষ্ট হয়ে পড়েছে।

এনজিওগুলো পৌর এলাকায় ওভারহেড ট্যাংকের মাধ্যমে পাইপলাইনে পানি সরবরাহ, রিভার্স অসমোসিস প্লান্ট, বায়ো স্যান্ড ফিল্টার বসানোর পর সেগুলোও নষ্ট হচ্ছে।

উপকূলীয় এলাকার মানুষকে বাঁচাতে সরকারিভাবে বড় ধরণের জলাধার বা পানির প্লান্ট নির্মাণ প্রয়োজন বলে মনে করছেন এলাকাবাসী। তথ্য সূত্র বিবিসি বাংলা।