News update
  • Bangladesh condemns Israeli military aggression in Gaza     |     
  • WTO: Standing Tall as the Winds Howl     |     
  • HC orders screening of film 'The Remand' on July Uprising     |     
  • Unfit launches won't be allowed on Chandpur-Dhaka route: DC     |     
  • Tarique warns of threats to democracy, vows to uphold secular trait     |     

প্রাচীন ভারতে শূন্যতার ধারণা থেকে যেভাবে আবিস্কৃত হলো 'শূন্য' সংখ্যাটি

গ্রীণওয়াচ ডেস্ক বিবিধ 2023-03-28, 8:33am

dfebf780-ccaf-11ed-9b0a-6f4a90e45a6a-36289be09a5584dba856be41aff8e0121679970802.jpg




গল্পটা এরকম: প্রায় ২,৩০০ বছর আগে সম্রাট অ্যালেকজান্ডার পারস্য জয় করার পর একদিন এসে পৌঁছুলেন সিন্ধু নদের তীরে। দেখলেন, জিমনোসোফিস্ট বলে ডাকা হয় এমন একজন নগ্ন সাধু একটি পাথরের ওপর বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।

"তুমি এখানে বসে কী করছো?" জিজ্ঞেস করলেন অ্যালেকজান্ডার।

"শূন্যতাকে অনুভব করছি। কিন্তু তুমি কী করছো?" পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়লেন জিমনোসফিস্ট।

"আমি বিশ্ব জয় করছি," জবাব দিলেন অ্যালেকজান্ডার।

এরপর তারা দু’জনেই হেসে ফেললেন। দু’জনেই ভাবছিলেন, অন্য লোকটি কত বোকা, এবং কীভাবে নিজের জীবনটাকে বরবাদ করে দিচ্ছে।

পশ্চিমা এবং ভারতীয় সংস্কৃতির মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরার জন্য এই গল্পটি বলেছেন খ্যাতিমান পৌরাণিক কাহিনীকার দেবদত্ত পট্টনায়ক।

তবে এই গল্প থেকে আমরা আরও জানতে পারি যে প্রথম শূন্য (০) সংখ্যাটি আবিষ্কারের অনেক আগে থেকেই দার্শনিক ধারণার দিক থেকে ভারত কতটা উন্নত এক দেশ ছিল।

যজ্ঞের বেদী

সংখ্যার ব্যাপারে তিনটি প্রাচীন ভারতীয় ধর্ম - বৌদ্ধ, হিন্দু, এবং জৈন ধর্মের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ব্যতিক্রমী।

ভারতীয় গণিতের ইতিহাস সেই বৈদিক যুগ (খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ শতক) থেকে যখন ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে অত্যাধুনিক গণনার ব্যবহার ছিল।

সে সময় যজ্ঞের আচার ছিল জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, এবং যজ্ঞের বেদী তৈরি করা হতো সঠিক নিয়ম মেনে।

এই নিয়ম বর্ণনা করা রয়েছে সুলবা সূত্রে, যা ভারতের প্রাচীনতম বৈজ্ঞানিক গ্রন্থগুলির একটি।

খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২০০ শতকের মধ্যে লেখা এই গ্রন্থে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে রয়েছে:

জ্যামিতিক পরিসংখ্যানগুলির রূপান্তর। যেমন, ক্ষেত্র একই রেখে বর্গ থেকে বৃত্ত, এবং আয়তক্ষেত্র থেকে বর্গক্ষেত্র বের করা, যেখানে π-এর মান গণনা করা হয়েছিল।

√২ এর গণনা - এটা সেই অযৌক্তিক এক সংখ্যা যা পিথাগোরিয়ান দর্শনকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছিল।

এবং পিথাগোরাসের কথা যখন উঠলোই, তাঁর নাম বহনকারী এই উপপাদ্যটি তাঁর জন্মের ২০০ বছর আগে থেকে চালু ছিল।

বিশাল সংখ্যার প্রতি 'মোহ'?

জ্যামিতিতে এগিয়ে থাকার পাশাপাশি বিশাল সংখ্যার ব্যাপারেও প্রাচীন ভারতীয়দের মধ্যে তৈরি হয়েছিল মোহ।

প্রাচীন গ্রিসে সর্বোচ্চ সংখ্যাটি বোঝাতে ব্যবহৃত হতো মিরিয়াড, সংখ্যার দিক থেকে যেটি আসলে ছিল ১০,০০০।

কিন্তু ভারতে বিলিয়ন, কোয়াড্রিলিয়ন এবং আরও অনেক সংখ্যা ব্যবহৃত হচ্ছিল।

এবং সংখ্যার প্রতি সেই দুর্দান্ত ভালবাসার চিহ্নগুলি কিন্তু এখনও বর্তমান।

"খুব বড় বড় সংখ্যা ছিল [প্রাচীন ভারতের] গাণিতিক কথোপকথনের অংশ," বিশিষ্ট গণিতবিদ শ্রীকৃষ্ণ জি. দানি বিবিসিকে বলছিলেন।

"যেমন, আমি যদি কোন কিছু ব্যাখ্যা না করে শুধু 'পদার্থ' শব্দটি উচ্চারণ করি, তবে এটা নিয়ে খুব কম লোকেই চমকিত হবে।"

পদার্থ কী?

"আসলে এটি ১ এর পরে ১৭টি শূন্য (১০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০ বা ১০০,০০০ ট্রিলিয়ন) এবং এর আক্ষরিক অর্থ “স্বর্গের অর্ধেক পথ।“

"এবং বৌদ্ধ ঐতিহ্য অনুযায়ী, সংখ্যাগুলি আরও অনেক বেশি এগিয়ে গেছে: এর একটি হচ্ছে ১ এর পরে ৫৩টি শূন্য।"

কিন্তু এগুলো কেন ব্যবহৃত হয়েছিল? কোন বিশেষ কিছু কাজের জন্য তারা কি এসব সংখ্যা ব্যবহার করতো?

"এর পেছনে সুস্পষ্ট কোনও ব্যবহারিক কারণ নেই," বলছেন মি. দানি। "আমার ধারণা, এই ধরণের সংখ্যা সম্পর্কে চিন্তাভাবনা থেকে কিছু লোক বিশেষ ধরণের তৃপ্তি পেতেন।"

এবং সন্তুষ্টির চেয়ে ভাল কারণ কার কী থাকতে পারে!

তবে এদিক থেকে জৈনরাও খুব একটা বেশি পিছিয়ে ছিলেন না: যেমন, 'রাজু' হলো কোন দেবতার ভ্রমণের ছয় মাসের দূরত্ব। ঐ দেবতা যদি চোখের প্রতিটি পলকে ১,০০,০০০ যোজন দূরত্ব অতিক্রম করে এভাবে ছয় মাস পথ চলেন - তাহলে সেই দূরত্বকে বলা হয় রাজু।

এ থেকে আপনি সম্ভবত কিছুই বুঝবেন না। তবে মোটামুটি হিসেব করে বলা যাবে, দেবতা যদি প্রতি সেকেন্ডে ১০ বার করে চোখের পলক ফেলেন তাহলে ছয় মাসে তিনি প্রায় ১৫ আলোক-বর্ষ পথ অতিক্রম করেন।

পশ্চিমা কোনও ধর্মীয় পাঠ্যপুস্তক এর ধারেকাছেও যেতে পারেনি।

এবং শুধু তাই না; প্রাচীন ভারতীয়রা বিভিন্ন ধরণের অসীম সংখ্যা সম্পর্কেও চিন্তাভাবনা করেছিলেন এবং তা শ্রেণিবদ্ধ করেছিল। এটি এমন একটি বিষয় যা দুই সহস্রাব্দ পর 'অ্যাবস্ট্র্যাক্ট' বা বিমূর্ত গাণিতিক চিন্তার বিকাশের ক্ষেত্রে মৌলিক হয়ে ওঠে।

শূন্যতা থেকে শূন্যে

অবশ্যই এভাবে অনেকগুলি ০ সম্পর্কে কল্পনা করতে হলে আপনাকে প্রথমে শূন্য (০) সংখ্যাটি আবিষ্কার করতে হবে।

অবশ্য বেশ কয়েকটি সভ্যতায় এ সম্পর্কে ধারণা ছিল, যেমন মায়া এবং ব্যাবিলোনিয়া, যেখানে কোন কিছু অনুপস্থিতির জন্য নির্দিষ্ট চিহ্ন ব্যবহার করা হতো।

কিন্তু ভারতীয়রাই প্রথম এই অনুপস্থিতিকে ০-সংখ্যায় পরিণত করেছিল এবং সংস্কৃত ভাষায় একে শূন্য বা শূন্যতা বলে অভিহিত করেছিল।

অন্য কথায়, যা কিছু নেই তাকে কোনও প্রতীক দেয়ার মাধ্যমে বলা হলো সেটা আসলে কিছু একটা। যুক্তিযুক্তভাবেই, এটা ছিল গণিতের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ধারণাগত অগ্রগতি।

শূন্যের ধারণা তারা প্রথম কখন দিয়েছে?

কয়েক বছর আগ পর্যন্তও ০ সংখ্যার প্রাচীনতম উদাহরণ বলে যাকে মনে করা হতো এবং যার একটি যাচাইযোগ্য তারিখ ছিল, সেটি ছিল গোয়ালিয়র দুর্গের মন্দিরের একটি দেয়াল লিখন।

এটি খোদাই করা হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৮৭৫ শতকে। কিন্তু তত দিনের মধ্যে ০ সংখ্যাটি ভারতে সাধারণভাবে ব্যবহৃত হচ্ছিল।

আসলে, বাখশালী পাণ্ডুলিপি নামে একটি প্রাচীন ভারতীয় পুঁথিতে শূন্য সংখ্যাটির প্রাথমিক রেকর্ডকৃত ঘটনা হিসাবে মনে করা হয়।

বাখশাল হচ্ছে পাকিস্তানের পেশোয়ারের কাছে একটি গ্রাম। ২০১৭ সালে কার্বন ডেটিং করে জানা গেছে ভূর্জপত্রের ওপর পুঁথিটি লেখা হয়েছিল তৃতীয় কিংবা চতুর্থ শতাব্দীতে। তবে কিছু বিশেষজ্ঞ সেই ডেটিংটিকে স্বীকার করেন না।

যাহোক, আমাদের জানামতে, দুই হিন্দু জ্যোতির্বিদ এবং গণিতবিদ আর্যভট্ট, যিনি জন্মেছিলেন ৪৭৬ সালে, এবং ব্রহ্মগুপ্ত, যিনি জন্মগ্রহণ করেন ৫৯৮ সালে, প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে দশমিক স্থানের আধুনিক মান ব্যবস্থা তৈরি করেছিলেন এবং শূন্য প্রতীক ব্যবহারের প্রচলিত বিধিগুলি প্রথমবারের মতো বর্ণনা করে প্রমাণ করে দিয়েছিলেন যে এর ব্যবহার কতটা অবিশ্বাস্যভাবে কার্যকর হতে পারে।

গণনা আরও সহজ করার ব্যাপারে অন্য সব সভ্যতার চেয়ে উচ্চতর এই ভারতীয় সংখ্যা ব্যবস্থাটি পরে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে, এবং তারও পরে বিশ্বের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে যা এখন প্রধান ব্যবস্থা বলেই সর্বজন স্বীকৃত।

কিন্তু ০ সংখ্যাটির উদ্ভব কেন ভারত থেকে হয়েছিল? এটা কি শুধু বড় সংখ্যা লেখার সুবিধার জন্য? নাকি এর পেছনে অন্য কোন আধ্যাত্মিক শক্তিও কাজ করছিল?

নির্বাণপ্রাপ্তি

"মজার বিষয় হলো শূন্য শব্দটির ব্যবহার ছিল সর্বত্র। খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৩০০ শতক থেকেই এটির চল ছিল," গণিতের ইতিহাসবিদ জর্জ গেভেরহিজ জোসেফ বিবিসিকে বলছিলেন।

তিনি উল্লেখ করেন, এই শূন্য শব্দটি এসেছিল "স্থাপত্যবিদ্যার ম্যানুয়াল থেকে, যাতে বলা হয়েছে দেয়াল নয়, বরং দেয়ালের ভেতরের স্থানটি গুরুত্বপূর্ণ। সেখান থেকে বৌদ্ধ ধর্ম, জৈন ধর্মে যাতে বিশ্বাস করা হয় যে এর মধ্য দিয়ে আপনাকে নির্বাণ নামে আধ্যাত্মিকতার একটি নির্দিষ্ট স্তরে পৌঁছুতে হবে যেখানে বাকি সবকিছু বিলীন হয়ে যাবে।"

"এটি থেকেই হয়তো কেউ, যার নাম আমরা জানি না, মনে করেছিলেন যে এই দার্শনিক এবং সাংস্কৃতিক ধারণাটিও গাণিতিক অর্থে কার্যকর করা যায়।"

দেবী অহল্যা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য গণিতবিদ রেণু জৈনের মনে কোনও সন্দেহ নেই যে শূন্যতার আধ্যাত্মিক ধারণাটিই সংখ্যা ০-এর গাণিতিক ধারণাটিকে অনুপ্রাণিত করেছে।

"এমনিতে শূন্য সংখ্যাটির মানে কিছুই বোঝায় না। তবে ভারতে এটি এক ধরণের পরিত্রাণ, মানবতার গুণগত সমাপ্তি, এক ধরণের শূন্যতার ধারণা থেকে উদ্ভূত।

"যখন আমাদের সব আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়, যখন আমাদের আর কোন আকাঙ্ক্ষা বাকি থাকে না, তখন আমরা নির্বাণ বা শূন্যতা প্রাপ্ত হই।"

সুতরাং শূন্যতাই সবকিছু।

আসলে, ০ বোঝানোর জন্য বৃত্তের ব্যবহারের মূলে ধর্মীয় কারণ থাকতে পারে।

"বৃত্ত হচ্ছে স্বর্গের প্রতীকী," বলছেন ভারতীয় গণিতের ইতিহাসবিদ কিম প্লফকার।

"সংস্কৃত ভাষায় ০ চিহ্নটি মৌখিকভাবে এনকোড করার জন্য ব্যবহৃত অনেকগুলি শব্দের অর্থ আকাশ বা শূন্যতা। যেহেতু স্বর্গ বোঝাতে শূন্য চিহ্নটি ব্যবহৃত হয়, সুতরাং, আকাশ বা শূন্যতার প্রতীকও ০।“

"ভারতীয় ধর্মমতে, শূন্যতা থেকেই এই মহাবিশ্বের জন্ম এবং মানবতার চূড়ান্ত লক্ষ্যও শূন্যতা প্রাপ্তি," - বিবিসির অনুষ্ঠান ‘জিনিয়াস অফ দ্যা ইস্ট’-এ মন্তব্য করেছেন গণিতবিদ মার্কাস দ্যা সৌটয়।

"সুতরাং সম্ভবত এটি অবাক হওয়ার মতো কোন বিষয় নয় যে এমন একটি সমাজ যা এত উৎসাহের সাথে শূন্যতা গ্রহণ করেছিল, সেটি সহজেই শূন্যের ধারণাটিকে গ্রহণ করতে পেরেছিল।"

এটি কখনই সম্পূর্ণ নিশ্চিতভাবে বলা না গেলেও বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের মতামত অনুযায়ী, ভারতীয় আধ্যাত্মিক জ্ঞানই সম্ভবত শূন্য-র আবিষ্কারের পথ দেখিয়েছিল।

তবে এর সাথে সম্পর্কিত আরেকটি ধারণা রয়েছে যা আধুনিক বিশ্বকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।

কম্পিউটার দুটি সম্ভাব্য অবস্থার নীতিতে কাজ করে: চালু থাকা মানে ১ এবং বন্ধ থাকা মানে ০।

"সম্ভবত অবাক হওয়ার মতো বিষয় নয় যে এই বাইনারি নম্বর সিস্টেমটি খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় বা তৃতীয় শতাব্দীতে ভারতেই আবিষ্কৃত হয়। মনে করা হয়, পিঙ্গলা নামে একজন সংগীতজ্ঞ এটিকে তার ছন্দ-শাস্ত্রে ব্যবহার করেছিলেন," জানালেন বিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসবিদ সুভাষ কাক।

তাহলে ভেবে দেখুন, অনেক কিছুই বেরিয়ে এসেছে ভারত থেকে ... একেবারে শূন্যতার মধ্য থেকে! তথ্য সূত্র বিবিসি বাংলা।