News update
  • UNRWA chief: Ceasefire is the start, not the solution     |     
  • UNRWA chief: Ceasefire is the start, not the solution     |     
  • Sudan war becomes more deadly: Ethnically motivated attacks up     |     
  • Dhaka's RMG exports reach $38.48 bn in 2024: New markets up     |     
  • Bangladesh’s GDP Growth to Decline to 4.1% in FY25: WB     |     

আয়নাঘর: বাঁচার আশা একদম ছেড়ে দিয়েছিলাম - মাইকেল চাকমা

বিবিধ 2024-08-15, 3:37pm

ryrtwet-7d906eca3b9cd5ac278e66e573f5ffa91723714643.jpg




ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের এক দিন পরে ৬ আগস্ট ‘আয়নাঘর’ থেকে মুক্তি পান মাইকেল চাকমা। তুলে নেওয়ার প্রায় সাড়ে ৫ বছর পর তাকে চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার একটি জঙ্গলে হাত ও চোখ বেঁধে ফেলে রেখে যাওয়া হয়।

মাইকেল চাকমা বলেন, "সেখানে না থাকলে বুঝতে পারবেন না যে সেই পরিবেশ কতটুকু অসহনীয়। মনে হবে, থাকার চেয়ে মৃত্যুও অনেক ভালো। বাঁচার আশা তো ছেড়েই দিয়েছিলাম।"

শুধু মাইকেল চাকমা নয়, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আয়নাঘর থেকে মুক্তি পান যুদ্ধপরাধী জামায়াত নেতা গোলাম আযমের পুত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আব্দুল্লাহ হিল আমান আযমী, যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মীর কাশেম আলীর ছেলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার আহমাদ বিন কাসেম (আরমান)।

আয়নাঘর থেকে মুক্তি পেলেও এখন ট্রমা কাটিয়ে পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) সংগঠক মাইকেল চাকমা। এখনও তিনি চিকিৎসাধীন আছেন।

বাংলাদেশে গণতন্ত্র ১৯৯১ সালে পুনরুদ্ধারের পর পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি আলোচনা শুরু হয়। দ্বিতীয় দফা আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্রগ্রাম শান্তি চুক্তি হয়। সেই চুক্তির বিরোধিতার মধ্য দিয়ে ১৯৯৮ সালের ২৬ জুন ইউপিডিএফ-এর জন্ম হয়।

পার্বত্য শান্তি চুক্তি সম্পাদনকারী জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার (সন্তু লারমা) দল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতির সমিতি থেকে তরুণদের একটি অংশ বের হয়ে ইউপিডিএফ গঠন করে। স্থানীয় গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন সময় ইউপিডিএফ পার্বত্য অঞ্চলে সেনাবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।

বাংলাদেশ রাষ্ট্র পার্বত্য চট্রগ্রামকে পুরোপুরিভাবে সেনাবাহিনীর চোখ দিয়ে দেখে বলে দাবি করে, ইউপিডিএফ-এর ছাত্র সংগঠন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের সভাপতি অঙ্কন চাকমা ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "প্রায় শুরু থেকে এই সংগঠনের মুখপাত্র হিসেবে এই চুক্তির বিরোধিতা করে আসছেন মাইকেল চাকমা।" "যেটা তাকে তুলে নেওয়ার প্রধান কারণ,” বলে মনে করেন অঙ্কন।

গত ১২ আগস্ট মাইকেল চাকমা ভয়েস অফ আমেরিকার সঙ্গে কথা বলার সময় ২০১৯ সালে তাকে তুলে নেয়ার ঘটনা এবং আয়নাঘরের দুর্বিষহ দিনগুলোর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। তার বর্ণনার প্রায় পুরোটাই তার নিজের ভাষায় তুলে ধরা হলো পাঠকের জন্য।

আটকের প্রথম দিন যা ঘটেছিল মাইকেল চাকমার সঙ্গে?

চোখ বাঁধার আগে আমি গাড়িতে একটা ওয়াকিটকি দেখেছি, যেগুলো প্রশাসনের লোক ব্যবহার করে। আর পত্র-পত্রিকায় তো প্রায় সময় খবর দেখতাম এইভাবে সিভিল ড্রেসে মানুষকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। তাই ভেবেছিলাম যে আমাকেও গ্রেফতার করা হয়েছে।

আটকের প্রথম দিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে মাইকেল চাকমা বলেন, “২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল ঢাকার কল্যাণপুর বাস স্ট্যান্ড বিপরীতে অবস্থিত সোনালী ব্যাংকের সামনে থেকে আমাকে তুলে নেওয়া হয়। তুলে নেওয়ার পর তারা বলেছিল - আমাকে ধরার জন্য গত চার দিন ধরে ফলো করছে। আজ সফল হয়েছে।

চোখ বাঁধার আগে আমি গাড়িতে একটা ওয়াকিটকি দেখেছি, যেগুলো প্রশাসনের লোক ব্যবহার করে। আর পত্র-পত্রিকায় তো প্রায় সময় খবর দেখতাম এইভাবে সিভিল ড্রেসে মানুষকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। তাই ভেবেছিলাম যে আমাকেও গ্রেফতার করা হয়েছে।

যারা আমাকে গ্রেফতার করেছে তারা সবাই সাদা পোশাকে ছিলেন। গ্রেফতারের পর একজন ফোনে কাউকে গাড়ি পাঠাতে বলে। তখন সঙ্গে-সঙ্গে গাড়ি চলে আসে। গাড়িতে তোলার পর আমার মোবাইল ও ব্যাগ সবকিছু নিয়ে নেয় তারা। কালো কাপড়ে আমার চোখ বেঁধে দেয়। আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, আমার নামে যে মামলা আছে, সেটা জানি কিনা। আমি বললাম, এগুলো রাজনৈতিক মামলা। এসব মামলা প্রায় সময় আমাদের দেশে হয়।

তখন তারা বলে, আপনি পালিয়ে বেড়াচ্ছেন কেন। আমি বললাম-পালিয়ে বেড়ালে তো দেশেই থাকতাম না। তখন তারা কাউকে ফোন করে বলে- মাইকেল চাকমা কট (ধরা পড়েছে)। এরপর ওই সময়কার ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে যেতে-যেতে আমাকে বললো- এই ঘটনায় তো আপনার নাম আসছে। তখন আমি স্বাভাবিক হয়ে বললাম- আপনার তো নিজেরাই বলছেন, গত চার দিন ধরে আমাকে ফলো করছেন। তাহলে ওই ঘটনার সঙ্গে আমি জড়িত থাকি কিভাবে? সেখানে তো আমি ছিলামও না।

তারপর আমাকে একটি বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। কল্যাণপুর থেকে সরাসরি ওই জায়গায় আমাকে নেওয়া হয়েছে বলে মনে হয় না। একটু এদিক-সেদিক ঘুরিয়ে ওইখানে নেওয়া হয়। আমাকে তারা ধরে বিকাল ৫ টার দিকে। আর সেখানে পৌঁছায় সন্ধ্যায়। ওই বাড়িটা একটা থানার মতো। তবে, থানায় সাধারণ মানুষের আসা-যাওয়া থাকতো ও পুলিশের পোশাকের লোক থাকতো। কিন্তু সেখানে এই রকম কিছু ছিলো না, একদম নির্জন জায়গা। থানায় হাজাতখানার মত লোহার দরজার ৭-১০ ফিটের মতো একটা রুমে আমাকে রাখা হয় এবং চোখের বাঁধন খুলে দেওয়া হয়। তার ভেতরে একটা টয়লেট ও পানির কল ছিলো। সেই কলের পানি দিয়ে সবকিছু করতে হয়।

আমার পাশের আরেকটি রুমে একটি লোক ছিল। ওইদিন রাতে তাকে সেখান থেকে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া হয়। তবে, আমি তার চেহারা দেখতে পাইনি। কারণ ওই লোককে নিয়ে যাওয়ার সময় আমাকে বলা হলো-আপনি দেয়ালের দিকে মুখ দিয়ে ঘুরে বসেন, পেছনে তাকাবেন না।

রাতে আমি ওখানকার একজনকে বললাম ভাই, আমার পরিবার তো চিন্তা করছে। তাদেরকে কি একটু ফোন করে বলা যায়। তখন ওই ব্যক্তি বললো এটা অসম্ভব। এটা করলে আমার অবস্থাও খারাপ হয়ে যাবে।

তখন তারা পাল্টা বললো আপনি তো চুক্তি (পাবর্ত্য চট্রগ্রাম শান্তি চুক্তি) মানেন না। আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম, চুক্তি না মানলে কি রাষ্ট্রদ্রোহী হতে হয়? তখন তারা যুক্তি দেয়- চুক্তি যেহেতু সরকারের সঙ্গে ছিলো, সরকারে বিরোধিতা করা রাষ্ট্রের বিরোধিতা করা। কারণ রাষ্ট্র পরিচালনা করে সরকার।

এরমধ্যে আমাকে রাতে খাবার দেওয়া হয়। খাওয়ার পরে আনুমানিক রাত ৯ টার দিকে ৩-৪ জন লোক এসে চোখ বেঁধে একটা কালো টুপি পরিয়ে ওই বাড়ির আরেকটি রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তারা বিশৃঙ্খল অবস্থায় একেক জন একেক প্রশ্ন করতে থাকে। এরমধ্যে একটা প্রশ্ন ছিলো তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর খাগড়াছড়ি সফরের দিন কেন আমাদের ছাত্র সংগঠন রোড়ব্লক কর্মসূচি দিয়েছিল এই নিয়ে। তারপর আমাকে বলা হলো- আপনি তো একজন রাষ্ট্রদ্রোহী। তখন আমি প্রশ্ন করলাম, রাষ্ট্রদ্রোহী হবো কেন। তখন তারা পাল্টা বললো আপনি তো চুক্তি (পাবর্ত্য চট্রগ্রাম শান্তি চুক্তি) মানেন না। আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম, চুক্তি না মানলে কি রাষ্ট্রদ্রোহী হতে হয়? তখন তারা যুক্তি দেয়- চুক্তি যেহেতু সরকারের সঙ্গে ছিলো, সরকারে বিরোধিতা করা রাষ্ট্রের বিরোধিতা করা। কারণ রাষ্ট্র পরিচালনা করে সরকার।

তখন আমি পাল্টা যুক্তি দিয়ে বললাম, এটা আমার নাগরিক অধিকার। আমাদের দেশে সংসদে বিরোধী দল সরকারের বিভিন্ন বিষয়ে বিরোধীতা করে, কর্মসূচি দেয়। তাহলে তো আগে তাদেরকে নিষিদ্ধ করতে হবে, রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা দিতে হবে। তখন তারা এই বিষয়ে আর কোনো কথা বলেন নাই। এরপর তারা আমাদের দল ইউপিডিএফ এর দাবি-দাওয়া নিয়ে কিছু প্রশ্ন করে চলে যায়। আবার আগের রুমে নিয়ে আসা হয় আমাকে। চোখ খুলে দেয়, ঘুমানোর জন্য ২ টি কম্বল দেয়। এইভাবে ৯ এপ্রিল কেটে যায়।

দ্বিতীয় দিন ক্রসফায়ারের ভয় ঢুকে যায় মনে

দ্বিতীয় দিনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা তুলে মাইকেল চাকমা বলেন, “পরের দিন ১০ এপ্রিল সকালে নাস্তা খাওয়ার পর আবার চোখ বেঁধে আরেকটি রুমে নেওয়া হলো। সেখানে নেওয়ার পর এবার চোখের বাঁধন খুলে দেওয়া হয়। সেখানে একটি ফাঁকা টেবিল ও কয়েকটি চেয়ার এবং দুই জন লোক। তারা মূলত আগের রাতে যেসব প্রশ্নগুলো করেছিল, সেইগুলো আবারও করা হয়। তারপর আবার আগের হাজতের মত রুমে নিয়ে আসা হলো। এক পর্যায়ে দুপুরের খাবার নিয়ে আসলো এক ব্যক্তি। তখন আমি ওই ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করি, আমাকে কোর্টে তোলা হবে না? কারণ আমি বুঝতে পারছি এটা থানা না। তিনি উত্তর দেন- স্যাররা মিটিংয়ে ব্যস্ত। উনারা আসলে একটা ব্যবস্থা হবে। এভাবে সন্ধ্যা পার হয়ে যায়, তাদের উত্তরও একই আসে- স্যাররা মিটিংয়ে ব্যস্ত।”

আমার দুই পাশে দুই জন লোক ছিল। তাদের একজনের কোমরে শক্ত কিছু একটা ছিল, সেটা আমার শরীরে লাগার পর অনুধাবন করি।

এরপর রাতে খাবার খেয়ে মনে হয় আমি ১৫-২০ মিনিট জন্য ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তখন এক ব্যক্তি এসে আমাকে ঘুম থেকে তুলে হাতকড়া লাগিয়ে চোখ বেঁধে কালো টুপি পরিয়ে দেয়। তখন আমার মধ্যে ভয় ঢুকে যায় রাতে কি তাহলে আমাকে ক্রসফায়ারের দেওয়া হবে। কারণ এইভাবে তো অনেক লোককে ক্রসফায়ারের দেওয়ার ঘটনা শুনেছি। আমি প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম যে আজকে আমি শেষ। তখন বাইরে একটি গাড়ি আসার শব্দ শুনতে পাই। তারপর গাড়িতে তোলা হলো আমাকে। গাড়িতে উঠার পর মাথার কালো টুপি খুলে দেওয়া হয়। তবে, কাপড় দিয়ে চোখ বাঁধা ছিল। কাপড় কিছুটা হালকা হওয়ায় দেখতে পাই, এটা পুলিশের গাড়ির মতো। আমার দুই পাশে দুই জন লোক ছিল। তাদের একজনের কোমরে শক্ত কিছু একটা ছিল, সেটা আমার শরীরে লাগার পর অনুধাবন করি। তখন আরও বেশি ভয় লাগে যে, আজকে আমাকে মেরে ফেলবে ।

গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়ার সময় ভেতরে-বাইরের কোনও শব্দ যেন কানে না আসে তার জন্য স্পিকারে গান বাজিয়ে দেওয়া হয়। এরপর মনে হলো গাড়িটা কোনো একটা গ্রামের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। অনেক ভাঙা ও উচু-নিচু (পথ) দিয়ে গাড়ি চলছিল। এইভাবে এক ঘন্টার মত গাড়ি চলার পর একটা জায়গায় থামলো। তখন আমি জীবনের আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম...মনে হলো নামিয়ে ক্রসফায়ার দেবে। তাই নেমেই উচ্চস্বরে স্লোগান দিতে লাগলাম। এরমধ্যে কখন যে আমাকে আবার গাড়িতে তোলা হয়েছে সেটাই বুঝতে পারি নাই। আবার কখন নামিয়ে ‘আয়নাঘরে’ ঢোকানো হলে কিছুই বুঝতে পারি নাই। এতটাই উত্তেজিত ছিলাম।

আয়নাঘরে নেওয়ার পরও উত্তেজিত ছিলাম। বসা থেকে দাঁড়িয়ে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলাম, কেন আমাকে তুলে এনেছেন, আমাকে কি ক্রসফায়ারে দিবেন, খুন করবেন, কি অপরাধ আমার, কি করেছি...এসব বলতে লাগলাম। আমাকে গুলি করে ফেলেন। আমার পবিত্র রক্তে বাংলার মাটি সিক্ত হোক। তখন তারা কোনও কথা বলে নাই। একদম চুপ ছিলো।

শারীরিক নির্যাতন

তারা আমার সঙ্গে মুখে কথা না বললেও, শারীরিক নির্যাতন করেছিল। লাঠি দিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাত করে। কথা বলতে গেলে মুখের ভেতরে বাঁশের মতো ৫-৬ ইঞ্চি লম্বা কিছু একটা দিয়ে দেওয়া হয়। যাতে কথা বলতে না পারি। পরের চিকিৎসক আসে, আমার প্রেশার পরীক্ষা করে। তখন চিন্তা করতে লাগলাম, এটা কোথায় আসলাম। কেন চিকিৎসক আসলো। তখন শুধু মনে হতো এই বুঝি আমাকে মেরে ফেলবে। কিছু সময় পর তারা চলে যায়। এইভাবে দ্বিতীয় দিন ও রাত যায়।

তারা আমাকে কয়েকবার শারীরিক নির্যাতন করেছে। বিভিন্নভাবে মানসিক নির্যাতন করাই ছিল তাদের কৌশল।

‘আয়নাঘরে’ প্রথম দিন

রুমের মধ্যে জানালা আছে কিন্তু গ্লাসের ওপর কালো রং করা, যাতে বাইরের কিছুই দেখা না যায়। ঘরটি অনেক পুরানো মনে হয়েছে।

(তুলে নেওয়ার দ্বিতীয় দিন রাতে আয়না ঘরে একটি কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে) কয়েক মিনিট হাঁটিয়ে একটি রুমে নেওয়া হয়। রুমে নিয়ে চোখের বাঁধন খুলে দেওয়া হয়। তখন দেখলাম রুমের মধ্যে ৩ বাই ৬ ফিটের একটা খাট। ওপরে একটি সিলিং ফ্যান। রুমের মধ্যে জানালা আছে কিন্তু গ্লাসের ওপর কালো রং করা, যাতে বাইরের কিছুই দেখা না যায়। ঘরটি অনেক পুরানো মনে হয়েছে।

তারা আমার কাপড় খুলে নিয়ে একটি লুঙ্গি ও গেঞ্জি দিয়ে যায়। এরপর দুই জন লোক এসে চার দিক থেকে আমার ছবি তুলে। বলে যায়, আপনি এখানে থাকবেন। সারা রাত ফ্যান চলছিল। অনেক শীত লেগেছিল। তখন বৃষ্টির দিন ছিল। লাইট-ফ্যানের সুইচ ছিল রুমের বাইরে। তাই বন্ধও করতে পারি নাই। অনেক ক্লান্ত থাকায় ঘুমিয়ে পড়ি।

‘গল্প’-এর নামে জিজ্ঞাসাবাদ

(দ্বিতীয় দিন যে দুই জন আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল, তাদের একজন গুণধর নামে পরিচয় দিয়েছিল বলে জানান মাইকেল চাকমা।)

জিজ্ঞাসাবাদ শেষে যাওয়ার সময় ওই ব্যক্তি আমি কি খেতে পছন্দ করি, প্রিয় লেখক কে, প্রিয় বই কি এসব জানতে চেয়েছিল। তারপর বললো কালকে আবার কথা হবে।”

তৃতীয় দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা শেষে আবার চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় আরেকটি রুমে। অনেক পরে জানতে পারি এই রুমকে তারা ‘ডাকা সেল’ বলে। সেখানে আগে থেকে একজন উপস্থিত ছিলো। যিনি নিজেকে গুণধর পরিচয় দিয়েছিল। সে আমাকে দাদা কেমন আছেন জানতে চাইলো, আর বললো- আমরা গল্প করতে আসলাম। তারা জিজ্ঞাসাবাদকে ‘গল্প’ বলে। আমার নাম, পিতার নাম কি এসব জানতে চেয়ে গল্প শুরু করে। ঢাকাতে কাকে চিনি, কি করে...এসব জানতে চাইলো। আমার সঙ্গে তুমি করে কথা বললে কিছু মনে করবো কিনা, সেটাও জানতে চাইলো। এরপর একটি কাগজে দিয়ে বলে যায়, সেখানে সব কিছু লিখে দিতে। তারপর আবার রুমে নিয়ে এসে চোখের বাঁধন খুলে দেয়।”

তারা জিজ্ঞাসাবাদকে ‘গল্প’ বলে। আমার নাম, পিতার নাম কি এসব জানতে চেয়ে গল্প শুরু করে।...এভাবে প্রায় কয়েক মাস পর-পর তারা আমার সঙ্গে গল্প করতে আসতো। 

কাগজে আমি সবকিছু লিখে দিলে একজন লোক এসে তা নিয়ে যায়। বিকালে সেই কাগজটি নিয়ে আবার গুণধর আসে। তখন শুরু হয় আসল গল্প। (যা) কাগজে লিখেছি, সেটা মুখে আমাকে মুখে বলতে বলা হয়। মিলে কিনা পরীক্ষা করছিল, খুব বেশি হেরফের হয়নি। কাকে, কিভাবে চিনি এসব জিজ্ঞাসাবাদ করে। যদিও তারা এটাকে গল্প বলে। তারা এগুলো নিয়ে গিয়ে বিশ্লেষন করে (বলে) মনে হয়েছিলো। রাতে আবার আসে। আবার আগের জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে মিল রেখে নতুন করে আমার মামলা নিয়ে কথা বলে। সরকার বিরোধী বক্তব্য, সমালোচনা করা যাবে না…..এসব কথা বলে যায়। এভাবে প্রায় কয়েক মাস পর-পর তারা আমার সঙ্গে গল্প করতে আসতো।

(৯ এপ্রিল আটকের পর ওই ব্যক্তিরা তার মোবাইল নিয়ে যায় বলে জানান মাইকেল চাকমা।)

কয়েক দিন পরে আমি ফেসবুকের মেসেঞ্জারে কার সঙ্গে কি কথা বলেছি, কাকে কি ইমেল পাঠিয়েছি, কি মেসেজ পাঠিয়েছি…সবকিছু প্রিন্ট করে কয়েকটি ফাইল নিয়ে আসে। এসব নিয়ে গল্প করে। কোনটা কি, এটা কেন করেছি, ওটা কেন করছি এসব আরকি। সেখানে কিছু-কিছু মেসেজ আমাদের চাকমা ভাষায় লেখা ছিল, সেইগুলোর অনুবাদ করে দিতে বলে। যতক্ষন না পর্যন্ত তাদের জানার আগ্রহ শেষ না হতো, এভাবে জিজ্ঞাসাবাদ চলতো। এই সময় বাথরুমে যেতেও দিতো না।

বারবার রুম পরিবর্তন

(আয়না ঘরে যাওয়ার পর চার/পাঁচ দিনের মাথায় রুম পরিবর্তন করে দেওয়া হয় বলে উল্লেখ করেন মাইকেল চাকমা।)

সেখান থেকে নতুন যে ভবনে নেওয়া হলো সেটা উত্তর-দক্ষিণ লম্বা ছিল। এটার পূর্ব ও পশ্চিম মিলিয়ে দুই দিকে পাঁচটি করে দশ টি রুম ছিল। রুমগুলোর আয়তনে বড় ছিল না। ৭ বাই ৮ কিংবা ৭ বাই ১১ ফিট এই রকম। ১০ রুমের জন্য দুইটি বাথরুম ছিল।”

গত সাড়ে পাঁচ বছরে প্রায় ১০ বারের মত আমার রুম পরিবর্তন করে তারা। কয়েকটি ভবন একসঙ্গে লাগোয়া ছিলো। ভেতরে দিয়ে আসা-যাওয়ার রাস্তা ছিল।

যেসব কক্ষে রাখা হতো সেইগুলোর চার কোনায় চারটি টেবিল ফ্যান চলত। লোহার দরজার বাইরে কাঠের দরজা ছিল। কাঠের দরজায় বড় একটা ছিদ্র ছিল, যেটা দিয়ে বাহির থেকে দেখা হতো ভেতরে লোক কি করছে। ভবন ছাদগুলোর উপরে দিকে বড়-বড় এক্সহস্ট ফ্যান ছিল, যেগুলো থেকে খুব জোরে শব্দ হতো। যাতে ভেতরের শব্দ বাইরে না যায়, আর বাইরের শব্দ ভেতরে না আসে।

টয়লেটের দরজায় একটি ছিদ্র ছিল, সেটি দিয়ে তারা ভেতরে দেখতে পেতো। টয়লেট ব্যবহার শেষ হলে চোখ বাঁধা অবস্থায় আবার হাতকড়া পরিয়ে কক্ষে দিয়ে যেতো। তারপর চোখ খুলে দেওয়া হতো।

চোখ বেঁধে হাতকড়া পরিয়ে টয়লেটে নেওয়া হতো

(টয়লেট যেতে চাইলে দরজায় গিয়ে টোকা দিলে একজন এসে কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে এবং হাতকড়া পরিয়ে টয়লেটে নিয়ে যেতো বলে জানান মাইকেল চাকমা।)

টয়লেটের দরজায় একটি ছিদ্র ছিল, সেটি দিয়ে তারা ভেতরে দেখতে পেতো। টয়লেট ব্যবহার শেষ হলে চোখ বাঁধা অবস্থায় আবার হাতকড়া পরিয়ে কক্ষে দিয়ে যেতো। তারপর চোখ খুলে দেওয়া হতো।

(২০২২ সালের দিকে প্রায় ৮-১০ মাস চুল-দাড়ি কেটে দেওয়া হয়নি বলে জানান মাইকেল চাকমা।)

অনেক বড় হয়ে যায়। এক পর্যায়ে আমাকে দাড়ি কাটানোর জন্য একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। একটি মেশিন দেওয়া হয়। যে আমাকে নিয়ে যায় তাকে বললাম- ভাই আমি কি এটা দিয়ে চুল কাটতে পারবো। সে বললো কাটেন। তখন আমি মাথার চুল একদম ছোট করে ফেলি। এই নিয়ে অনেক ঝগড়া হয়। তারা আমাকে শিখিয়ে দেয় সুপারভাইজার আসলে যেন বলি- নিজের ইচ্ছায় চুল কেটেছি। দোষটা আপনি নিজের কাঁধে নিলে সুপারভাইজার মাফ করে দেবে। এই নিয়ে প্রধান সুপারভাইজার অনেক রাগারাগি করে আমার সঙ্গে।

প্রথম দিকে ভালো খাবার, সম্পর্ক নষ্ট হলে নির্যাতন নেমে আসে

(আয়না ঘরের খাবার প্রথম দিকে কিছুটা ভালো ছিল বলে উল্লেখ করেন মাইকেল চাকমা।)

এভাবে মাসের পর মাস আমাকে কষ্ট দিয়েছে। আবার সকালে এসে উপহাস করে বলতো, ভালো ঘুম হয়েছে?

তারা একটা মেন্যু অনুসরণ করতো। মাছ, মাংস ও ডিম থাকতো খাবারের মেন্যুতে। তবে, একটা সময় যখন সুপারভাইজারদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক খারাপ হয়। তখন আমাকে খারাপ খাবার দিতো। কখনও-কখনও বাসি ও নষ্ট খাবারও দিতো।

আমি যখন একটু ঘুমানোর চেষ্টা করতাম, তখন ফ্যানগুলো বন্ধ করে দিতো। যেই ফ্যানটা দিয়ে গরম বাতাস হয় এবং শব্দ করে, সেটা ছেড়ে দিতো। এভাবে মাসের পর মাস আমাকে কষ্ট দিয়েছে। আবার সকালে এসে উপহাস করে বলতো, ভালো ঘুম হয়েছে?

সেখানে না থাকলে বুঝতে পারবেন না যে সেই পরিবেশ কতটুকু অসহনীয়। ওখানে থাকার চেয়ে মৃত্যুও অনেক ভালো।

আবার যখন টয়লেট নিয়ে যেতে বলতাম, তখন নানা অজুহাতে দেরি করতো। কখনও-কখনও এক ঘন্টা পরে নিয়ে যেতো।

এক পর্যায়ে চলতি বছরের এপ্রিল মাসে আমি খুব অসুস্থ হয়ে পড়ি। শরীর খারাপ হয়ে যায়। তখন একজন ডাক্তার এসে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর দেখে বলে শরীরে লবনের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে, প্রেশার কমে গেছে। তখন কিছু ওষুধ দিয়ে যায়। ডাক্তার যাওয়ার সময় পরামর্শ দিয়ে যায় যে, আমাকে যেন বেশি গরমে রাখা না হয়। তখন পরিবর্তন করে এসির ব্যবস্থা আছে, এমন কক্ষে রাখা হয় আমাকে। ছাড়া পাওয়ার আগ পর্যন্ত সেখানে ছিলাম। সেখানে গরম- ঠান্ডা পানির ব্যবস্থাও ছিল।

মুক্তির দিন আবার মনে হয়ে হত্যার জন্য নেওয়া হচ্ছে

(৬ আগস্ট গভীর রাতে ঘুম থেকে ডেকে ‍তোলা হয় বলে জানান মাইকেল চাকমা।)

আমি ভাবলাম নাস্তার সময় হয়ে গেছে মনে হয়, এজন্য ডেকে তুলেছে। বাথরুমে নেওয়া হলো। এরপর রুমে এসে পানি খেলাম। তখন দেখলাম একজন লোক হাতকড়া ও কালো টুপি নিয়ে আসলো। বললো- আপনাকে অন্য জায়গায় যেতে হবে। তারপর পেছনে হাত নিয়ে হাতকড়া পরিয়ে এবং চোখ বেঁধে গাড়িতে তোলা হয়। গাড়িতে তোলার পর মাথার টুপি খুলে দেওয়া হয়, গান চালিয়ে গাড়ি চলতে শুরু করে।

সাধারণত আগে যখন রুম পরিবর্তনের জন্য গাড়িতে তোলা হতো, তখন সাত-আট মিনিট পরে নামানো হতো। মূলত এটা একটা তাদের কৌশল ছিল। একই ভবনের এক রুম থেকে আরেক রুমে নিতো। কিন্তু, এবার এক ঘন্টার মতো গাড়ি চলার পরে বুঝলাম, আমাকে দূরে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে। কোথাও-কোথাও গিয়ে গাড়ি থামলে আমার মাথাকে নিচু করে ড্রাইভারের পেছনে লুকিয়ে রাখা হচ্ছে।

ওইদিন আবার চোখের বাঁধন কিছুটা লুজ (হালকা) ছিলো। এক পর্যায়ে আমি দেখার চেষ্টা করলাম। তখন দেখি রাস্তায় অন্ধকার। কোনও গাড়ি নেই। আধা ঘন্টা পর গাড়ির রেডিও বন্ধ হয়ে যায়। তখন বুঝতে পারি যে ঢাকা থেকে অনেক দূরে চলে আসছি। গাড়িও অনেক গতিতে চলতে লাগলো, বুঝতে পারলাম কোনও মহাসড়কে আছি।

তখন মনে হলো আজকে আমাকে হয়তো হত্যা করা হবে। না হলে নানা রকম নাটক সাজিয়ে এবার আমাকে থানায় দেবে।

পরের গাড়িতে তোলার পর বলা হয়, কোনও আওয়াজ করবা না। কিছুদূর গিয়ে এবার বললো তোমাকে ছেড়ে দেওয়া হবে, বাড়ি চলে যাবে। তখন তো আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।

এরমধ্যে আস্তে-আস্তে বাইরে আলো আসতে লাগলো। তখন গাড়ির ভেতরের ড্রাইভার ছাড়া অন্যরা ঘুমিয়ে পড়ে। তখন নিশ্চিত হলাম এটা ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়ক। আমাদের গাড়ির সামনে একটি বাহিনীর (নাম উল্লেখ করে বলেন) গাড়ি ছিল। এক পর্যায়ে মহাসড়ক থেকে গাড়ি বাম দিকে একটি রাস্তায় ঢুকে, কিছুদূর গিয়ে থামে। তখন মনে হলো, এবার জঙ্গলের ভেতরে নিয়ে আমাকে গুলি করে মেরে ফেলবে। বাইরে বৃষ্টির কারণে লোকজনের আনাগোনা নেই।

সেখানে প্রায় আধা ঘন্টা অবস্থান করার দেখলাম আরেকটি গাড়ি আসলো। সেটাতে আমাকে তোলা হলো। হাতকড়া খুলে নেওয়া হলো। মাথার টুপি খুলে একটা গামছা ছিড়ে দুই টুকরো করে একটা দিয়ে হাত, আরেকটা দিয়ে চোখ বাঁধা হলো। তখন পর্যন্ত আমাকে বলা হয়নি যে, ছেড়ে দেওয়া হবে। পরের গাড়িতে তোলার পর বলা হয়, কোনও আওয়াজ করবা না। কিছুদূর গিয়ে এবার বললো তোমাকে ছেড়ে দেওয়া হবে, বাড়ি চলে যাবে। তখন তো আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।

এবার গাড়ি থামিয়ে আমাকে টেনে নামিয়ে জোরে-জোরে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় জঙ্গলের মধ্যে। তারপর তারা আমাকে শুয়ে পড়তে বলে। আধা ঘন্টার আগে উঠতে চেষ্টা করলে গুলি করে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। বলে যায়, আধা ঘন্টা পরে উঠে দৌড়ে পালিয়ে যেতে। তখন আমার হাতের বাঁধনের গামছার একটা অংশ লুজ করে দিয়ে যায়। যদিও আমার মনে ভয় ছিল, উঠে দৌঁড়ালে তারা পেছন থেকে গুলি করে মেরে ফেলবে।

তাদের কথা অনুযায়ী প্রায় আধা ঘন্টা পরে হাত খুললাম। দেখলাম গুলি করে না। তখন সাহস করে চোখের বাঁধনও খুললাম। পরে অনুমান করে রাস্তার দিকে হাঁটতে লাগলাম। কিন্তু রাস্তার গাড়িকে থামার জন্য সংকেত দিলে থামে না। কিছুদূর আসার পরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা ছিল খড়ের হাট বন বিভাগ। যেটা চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলা।

আয়না ঘরে থাকতেই আমি বাঁচার আশা একদম ছেড়ে দিয়েছিলাম। চিন্তা করতে পারি নেই, আমি আবার পৃথিবীর আলো দেখতে পারবো। ভয়েস অফ আমেরিকা