শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে সম্প্রতি গণমাধ্যমে দেয়া রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সাক্ষাৎকারকে ঘিরে সোমবার (২১ অক্টোবর) দিনভর ব্যাপক আলোচনা চলেছে। অন্তবর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টারা, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও আইনজীবীরা এ বিষয়ে ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র কেন রাষ্ট্রপতির কাছে থাকবে না এবং রাষ্ট্রপতি ঠিক কথা বলছেন কিনা এ নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপনও করতে দেখা গেছে অনেককেই।
সোমবার (২১ অক্টোবর) রাতে এবং মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) সকালে ফেসবুকে দুটি স্ট্যাটাস দেন লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফরহাদ মজহার।
ফেসবুক পোস্টে তিনি লেখেন, হাসিনার পদত্যাগপত্রের ভূমিকা নাই? অবশ্যই ভূমিকা রয়েছে। পদত্যাগপত্রের কথা বলেই হাসিনার নিয়োজিত জেনারেলদের সহযোগিতায় গণঅভ্যুত্থানকে শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সংবিধানের অধীনস্থ করা হয়েছে। যদি হাসিনাকে উৎখাতই করা হয়ে থাকে তাহলে তার ফ্যাসিস্ট সংবিধান বহাল এবং সেই সংবিধানের অধীনে শপথ নেয়া হলো কেন? কেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে চুপ্পুর উপদেষ্টা বানানো হলো? কেন জনগণের অভিপ্রায়কে এভাবে ফ্যাসিস্ট সংবনিধানের অধীনে এনে নস্যাৎ করা হলো এবং কার্যত ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থাই টিকিয়ে রাখা হলো? এর জবাবদিহি কে করবে?
তিনি আরও প্রশ্ন করে লেখেন, সংস্কারের নামে লোক দেখানো চাতুরির কী ফায়দা? রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের পুনর্বাসনের কী যুক্তি? এই চাতুরির ফলে ফ্যাসিস্ট শক্তি দ্রুত মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পেরেছে। ভূ-রাজনৈতিক শক্তির সমীকরণ বাংলাদেশের জনগণের বিপক্ষে চলে গিয়েছে।
ফরহাদ মজহার লেখেন, গণঅভ্যুত্থানকে নস্যাৎ করবার প্রক্রিয়া বন্ধ করুন। আসুন, কুতর্ক না করে এখন সমাধান খুঁজি। আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকি এবং বাস্তবতা মেনে নিয়ে আসন্ন লড়াইয়ের জন্য জনগণকে তৈরি করি। গণরাজনৈতিক ধারার রাজনীতিতে ছলনা চলে না। জনগণের কাছে স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন থাকার ওপরই আমাদের বিজয় নির্ভর করবে। আসুন গণঅভ্যুত্থানকে পূর্ণ বিজয়ের দিকে নিয়ে যাবার জন্য ছাত্র-জনতা-সৈনিকের মৈত্রীর ভিত্তিতে দ্রুত সংগঠিত হই। নিশ্চিত থাকুন, বাংলাদেশের জনগণ ফ্যাসিস্ট শক্তি এবং তার দালালদের কাছে মাথা নোয়াবে না।
এদিকে সোমবার রাতে লেখা পোস্টে তিনি বলেন, উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ভূঁইয়া লিখেছেন, ‘রাষ্ট্রপতির কাছে মৌখিকভাবে পদত্যাগ করেছিল স্বৈরাচারী খুনি হাসিনা। পদত্যাগপত্র নিয়ে বঙ্গভবনে যাওয়ার কথা থাকলেও ছাত্র-জনতা গণভবনের কাছাকাছি চলে আসলে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় খুনি হাসিনা।’ আসিফ, এটা সত্য নয়। মৌখিকভাবে পদত্যাগের কথা কখনই বলা হয়নি। সবসময়ই প্রেসিডেন্টের কাছে পদত্যাগপত্র দেবার কথা বলা হয়েছে। যে জন্য আমি আমার একটি ভিডিওতে পদত্যাগপত্র দেখতে চেয়েছি। আপনারা তখন দেখাতে পারেননি। এখন কেন মৌখিক পদত্যাগপত্রের ভুয়া গল্প প্রচার করছেন?
ফরহাদ মজহার লেখেন, শুরু থেকেই আমরা বলেছি যে চুপ্পুর কাছে শপথ নেওয়া ছিল আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। কিন্তু আপনারা সেটাই করেছেন। আপনারা সেনা সমর্থিত উপদেষ্টা সরকার বানিয়েছেন। বাস্তব সত্য স্বীকার করুন। এটা কি ঠিক করেছেন? আমার ভিডিওগুলো আবার শুনুন। পোস্টগুলো আবার পড়ুন। আপনারা আমাদের কারো কথা শোনেননি। এমনকি কথা বলাও প্রয়োজন বোধ করেননি। আপনাদের অনেকে দাবি করেছেন, ট্রেন মিস হয়ে গিয়েছে, এখন আর কিছু করা যাবে না। এটাও ঠিক নয়। অবশ্যই সমাধান আছে। এখন সমাধানের কথা আলোচনা না করে খামাখা পদত্যাগপত্র নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াবেন না।
তিনি আরও লেখেন, উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এবং আপনাদের এখন ব্যাখ্যা করতে হবে কোন যুক্তিতে আপনারা গণঅভ্যুত্থানকে ফ্যাসিস্ট সংবিধানের অধীনে ঢুকিয়েছেন এবং সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লবে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছেন। এখন যে ভয়াবহ রাজনৈতিক এবং আইনী জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে সেই অবস্থা থেকে নিষ্ক্রান্ত হবেন কীভাবে? সেনা সমর্থিত উপদেষ্টা সরকারতো এখনও অবৈধ। এর বৈধতা প্রতিষ্ঠার জন্য কী করছেন?
আসিফ নজরুলসহ আপনারা সেনাপ্রধান এবং ফ্যাসিস্ট হাসিনার নিযুক্ত সেনাবাহিনীর কিছু উচ্চপদস্থ অফিসারদের সঙ্গে নিয়ে যে রাজনৈতিক আঁতাত গড়ে তুলেছিলেন সেটা শুরু থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। এখন তা অনেক জটিল রূপ পরিগ্রহণ করেছে। শুধু তাই নয়, আপনারা সাধারণ সৈনিকদের দেশপ্রেম এবং গণঅভ্যুত্থানে তাদের অবদানকেও অস্বীকার করেছেন।
এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক আরও লেখেন, জুলাই অভ্যুত্থান ছিল ছাত্র-জনতা-সৈনিকদের অভ্যুত্থান। কিন্তু আপনারা সাধারণ সৈনিকদের অবদান অস্বীকার করে ফ্যাসিস্ট হাসিনার নিযুক্ত সেনা প্রধানদের সঙ্গে আঁতাত করেছেন। সাধারণ সৈনিকদের দেশপ্রেম এবং জনগণের প্রতি আনুগত্যকে গণশক্তিতে রূপান্তরিত করবার পরিবর্তে আপনাদের ফ্যাসিস্ট হাসিনার জেনারেলদের সঙ্গে আঁতাত করা কি ঠিক হয়েছে? আত্মসমালোচনা করতে শিখুন। আমরা বারবার তার সমালোচনা করেছি। তথাকথিত 'সাংবিধানিক শূন্যতা' এবং 'সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা'-র নামে যেভাবে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা আপনারা টিকিয়ে রেখেছেন তা আবার বিষধর সাপ হয়ে বাংলাদেশকে ছোবল মারতে উদ্যত। গণভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত জনগণের অভিপ্রায়ের পূর্ণ বাস্তবায়নে আপনারা যে বিঘ্ন ঘটিয়েছেন দয়া করে তা উপলব্ধি করুন। সমাধানের পথ খুঁজুন।
তিনি লেখেন, আসুন, বর্তমান পরিস্থিতি থেকে নিষ্ক্রান্ত হওয়ার সঠিক রণনীতি ও রণকৌশল আমরা আগে নির্ণয় করি। মনে রাখবেন, জনগণই আমাদের শক্তির উৎস, জেনারেলরা নয়। জনগণের শক্তির মানে হচ্ছে ছাত্র-জনতা ও সৈনিকের মৈত্রী। এই মৈত্রীকে জোরদার করুন। জনগণের জয় হোক।