News update
  • 2 dead, six hurt in Sherpur micro-autorickshaw-motorbike crash     |     
  • One killed over loud music row at wedding party in Natore     |     
  • Fire breaks out at jacket factory in Chattogram     |     
  • Dhaka, Delhi agree to bring down border killings to zero     |     
  • Natore’s Baraigram OC closed over negligence in bus robbery case     |     

চীনের সেই অপার্থিব পর্বত যেখান থেকে 'অ্যাভাটারের' অনুপ্রেরণা আসে

বিবিসি বিবিধ 2025-01-08, 6:06pm

ewfwerqwe-d00d557ce7f39141148e5d9cc63681911736337987.jpg




চীনের প্রথম জাতীয় উদ্যান জ্যাংঝাঝিয়েতে বেড়াতে গিয়ে যারা একটু সহজ পথটা নেন, তাদের জন্য রয়েছে কাঁচের সেতু, পাহাড়ের চূঁড়ায় চড়ার একটা লিফট, আর রয়েছে একটা ফুড কোর্ট যেখানে ম্যাকডোনাল্ডসের দোকানও রয়েছে।

শাই সেরকম গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তি নন, তবুও আমি যখন সম্ভবত একই জায়গা থেকে শততম ছবিটা তুলব বলে ফোনটা বের করলাম, সে বেশ কষ্ট করেই মাথা ঠান্ডা রেখেছিল। ওর আসল নাম শ্যান হং ইয়্যান, ছোট করে শাই। চীনের মধ্যভাগের জ্যাংঝাঝিয়ে জাতীয় উদ্যানে ও-ই ছিল আমার গাইড। তাই ও এটা জানত যে আমি আরও ওপরের দিকে গেলে আরও ভালো ছবি পাব।

কিন্তু ওই জায়গাটা থেকে আরও ছবি না তুললে আমার যেন মন ভরছিল না। এই বনভূমির ভেতরে বেলেপাথরের স্ফটিকের বিশাল উঁচু যে স্তম্ভগুলো আছে, এরকম জিনিস আমি পৃথিবীর কোথাও আগে দেখিনি যে!

হুনান প্রদেশের উত্তর-পশ্চিমে এই জ্যাংঝাঝিয়ে চীনের প্রথম জাতীয় উদ্যান। এটা চালু করা হয়েছিল ১৯৮২ সালে। এই অরণ্য আসলে 'উইলিংইউয়ান সিনিক এরিয়া'র অংশ। ওই অঞ্চলটি ইউনেস্কোর 'বিশ্ব হেরিটেজ তালিকা'য় অন্তর্ভুক্ত হয় ১৯৯২ সালে। পরে ২০০১ সালে 'গ্লোবাল জিও-পার্ক'-এর তকমাও পায় সেটি।

'অ্যাভাটার' সিনেমার সেই হ্যালেলুইয়া পর্বত'

জায়গাটার নামটা খটমট। তবে এটা মনে রাখার একটা সহজ উপায় আছে। দুনিয়াজুড়ে সারা ফেলে দেওয়া ইংরেজি ছবি 'অ্যাভাটার'-এ যে 'হ্যালেলুইয়া পর্বত'- দেখানো হয়েছিল, তা আসলে এই অরণ্যের আদলেই তৈরি।

জ্যাংঝাঝিয়েতে বেড়াতে আসার আগে আমি আসলে জায়গাটা সম্বন্ধে শুধু এটুকুই জানতাম।

আমার মনেও কথাটা উঁকি দিচ্ছিল, তবে শাইয়ের কথায় ব্যাপারটা নিয়ে নিশ্চিত হলাম যে 'অ্যাভাটার' সিনেমাটার আগে এমনকি চীনা পর্যটকরাও এখানে বিশেষ আসতেন না। ওই ছবিটাই তাদের চোখ খুলে দেয়।

ওই সিনেমার ওয়েবসাইটে লেখা আছে, "প্যান্ডোরার আকাশে ভেসে থাকা কিছু পাহাড় নিয়েই হ্যালেলুইয়া পর্বত।"

তবে আমি যে পাহাড়গুলোর দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে ছিলাম, সেগুলো অবশ্য ঠিক আকাশে ভাসছিল না। জমি থেকে যেভাবে মেঘ আর কুয়াশার চাদর ভেদ করে পাহাড়গুলো উঠে এসেছে, সেটা দেখে মনে হচ্ছিল যেন এক অপার্থিব দৃশ্য। আমি কি আর সাধে ওখান থেকে নড়তে চাচ্ছিলাম না!

শাই অবশ্য ঠিকই বলেছিল। আমরা পাহাড়ি পথ বেয়ে যত ওপরে উঠছিলাম, চারদিকের দৃশ্যগুলো যেন ততই বেশি করে অসামান্য হয়ে উঠছিল।

শেষমেশ যখন আমরা সব থেকে আকর্ষণীয় জায়গাটায় পৌঁছালাম– যেখানে একটা মাত্র স্ফটিক হয়ে যাওয়া বেলেপাথরের স্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে, স্থানীয় পর্যটন দফতর যেটার নাম দিয়েছে 'প্রেইজ দ্য লর্ড মাউন্টেন' (হ্যালেলুইয়া শব্দটার কাছাকাছি অনুবাদ এটি), শাই তো উত্তেজনায় লাফালাফি শুরু করে দিয়েছিল।

"এটার জন্যই সবাই আসে এখানে," বলেছিল শাই।

সেটা অবশ্য আশপাশে জড়ো হওয়া ভিড়টা দেখেই টের পাওয়া যাচ্ছিল। রাজকীয়ভাবে খাড়া হয়ে থাকা এই প্রাকৃতিক বিস্ময়ের ছবি সবাই নিজেদের ছোট ছোট ফোন-ক্যামেরায় বন্দি করার চেষ্টা করছিল।

এই বিশাল প্রস্তর-স্তম্ভটার আগে নাম ছিল 'সাউদার্ন স্কাই কলাম'। আকাশচুম্বী, ১০৮০ মিটার উঁচু এই স্তম্ভসহ পুরো দৃশ্যপটটাই খয়েরি।

তবে তার মাঝেই কেউ যেন সবুজের ছিটে লাগিয়ে দিয়েছে। আসলে স্তম্ভগুলোর গায়ে ঘন সবুজ ঝোপঝাড় গজিয়ে উঠেছে।

কলকল করতে থাকা অন্য পর্যটকরা কখন চলে যাবে তার জন্যই আমি অপেক্ষা করেছিলাম, যাতে প্রগাঢ় শান্তি আর স্তব্ধতার স্বাদটা নিতে পারি।

স্বর্গ আর পৃথিবীকে জুড়েছে যে প্রস্তর- স্তম্ভ

আমি যেন একটা স্বপ্নের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিলাম। আমরা ঘোর ভেঙে যেতে পারে– এটা ভেবে একটু ইতস্তত করেই শাই ফিসফিস করে বলল, "আমরা এটাকে বলতাম 'কিয়ানকুন'। শব্দটার অর্থ হলো 'স্বর্গ আর পৃথিবী', যেন এই প্রস্তর-স্তম্ভটাই স্বর্গ আর পৃথিবীকে জুড়ে রেখেছে।"

নামটা বেশ জুতসই – যেন পৃথিবী থেকে একটা স্তম্ভ আকাশে উঠে গেছে।

আমি যে জায়গাটায় দাঁড়িয়ে ছিলাম, সেখান থেকে দেখা যাচ্ছিল স্তম্ভটার নিচের দিকটা সরু আর ওপরের দিকটা চওড়া। তবুও লাখ লাখ বছর ধরে দৃঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেটি।

জাতীয় উদ্যানটায় এরকম তিন হাজারেরও বেশি প্রস্তর-স্তম্ভ আর খাঁজকাটা পাহাড়-চূড়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কঠিন পাথরের মধ্যে দিয়ে একনাগাড়ে জলস্রোত বয়ে যাওয়ার ফলে ভূমিক্ষয় হয়ে যেগুলোর সৃষ্টি।

পুরো জাতীয় উদ্যান এলাকাটা খুব বেশি বড় না, মাত্র ৪৮ বর্গকিলোমিটারের থেকে একটু বেশি। সেটা আবার ছোট ছোট অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে যাতে গুরুত্বপূর্ণ দ্রষ্টব্যগুলো কয়েকদিনের মধ্যেই দেখে ফেলা যায়।

যে জায়গাগুলো থেকে দৃশ্যগুলো অসামান্য লাগে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ইয়নজিয়েঝা, তিয়ানজি পর্বত আর ইয়েলো স্টোন ভিলেজ। এই জায়গাগুলোর দিকেই প্রথম থেকে আমাদের নজর ছিল।

পর্যটকদের শারীরিক শক্তি আর দক্ষতা অনুযায়ী এই অঞ্চলে বেশ কয়েকটা হাইকিং রুট আছে। আবার শাটল বাস, কেবল রোপওয়ে আর পাহাড়ে চড়ার একটা লিফটও আছে যারা আরামে ঘুরতে চান তাদের জন্য।

এরা শুধু মূল আকর্ষণীয় জায়গাগুলোয় পৌঁছে দেয় ছবি তুলে ফেলার জন্য।

ওই যে পাহাড়ে চড়ার লিফট, যেটার নাম বাইলং এলিভেটর – সেটা একসঙ্গে ৫০ জন মানুষকে হুশ করে ৩২৬ মিটার উঁচুতে চড়িয়ে দেয় দুই মিনিটেরও কম সময়ে। পর্যটন মরসুমে এই লিফটে চাপার জন্য বিশাল লম্বা লাইন পড়ে যায়, কয়েক ঘণ্টাও অপেক্ষা করে থাকেন মানুষজন।

এখান থেকেই আমি টের পেলাম যে ইউরোপ বা উত্তর আমেরিকার হাইকিংয়ের থেকে চীনের হাইকিং কতটা আলাদা হতে পারে। আমি ইউরোপ, উত্তর আমেরিকায় আগেই হাইকিং করেছি। এখানে ক্যাফে, স্যুভেনিরের দোকান, উচ্চস্বরে কথা বলা পর্যটক এবং তাদের সমবেত গলার স্বরের থেকে আরও জোরে গান বাজাতে থাকা স্পিকার, এসবই হাইকিং-পথগুলোর দিকে দিকে ছড়িয়ে রয়েছে।

শাই আমাকে সরাসরি নিয়ে গেল ভিড়ে ঠাসা পাহাড়-চূঁড়ার একটা ফুড কোর্টে, যেখানে একটা ম্যাকডোনাল্ডস আর বেশকিছু স্ট্রিট ফুডের দোকান আছে।

ওই জায়গাটায় শান্ত-সৌম্য যে ভাবটার ঘাটতি ঘটছিল, তা অবশ্য অসাধারণ দৃশ্যপট আর আকর্ষণীয় স্পটগুলোর বিচিত্র সব নামের ফলে অনেকটাই পূরণ হয়ে যায়। একেকটা জায়গার একেকরকম নাম দেওয়া হয়েছে – 'ফিল্ডস ইন দ্য স্কাই', 'নাম্বার ওয়ান ব্রিজ আন্ডার হেভেন', 'থ্রি সিস্টার্স পিক', 'এক্সট্যাসি টেরেস' ইত্যাদি।

মনমরা, ফ্যাকাশে একটা দিন

আমি যেদিন গিয়েছিলাম ওখানে, সেটা ছিল একটা মনমরা-ফ্যাকাশে দিন। সূর্য আর মেঘরাজি দুইয়ে যেন লুকোচুরি খেলছিল সেদিন।

দুপুরের খাওয়ার পরে আমরা যখন তিয়ানজি পর্বতের চূড়ায় পৌঁছলাম 'ফেয়ারি মেইডেন গিভিং ফ্লাওয়ার্স' দেখতে, শাইয়ের মনটা একটু খারাপই ছিল, কারণ আমরা যে স্পষ্ট একটা 'ভিউ' পেলাম না!

তবে কুয়াশা যেভাবে পাক বেয়ে বেয়ে উঠছিল, সেটা দেখে আমার তো অসাধারণ লাগছিল। ঠিক যেন হাতে আঁকা চীনা প্রথাগত একটা ছবি চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠছে।

আমরা যখন পাহাড় থেকে নেমে এলাম তখন কুয়াশা ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করেছিল। আমরা আরও কয়েক ঘণ্টা পায়ে হেঁটে এগিয়েছিলাম। পাশ দিয়ে কুলকুল করে বয়ে চলেছিল ছোট একটা জলধারা – 'গোল্ডেন হুইপ স্ট্রিম' যার চীনা নাম জিয়ানবিয়ান।

এই পথচলাটা বেশ সহজসাধ্য ছিল। তবে এই পথের কয়েকশো মিটার যাওয়ার পরেই ভিড়টা হাল্কা হয়ে গিয়েছিল। তাই পাথর-স্তম্ভগুলোর নিচ থেকে ওপরের দিকের আরেকটা আকর্ষণীয় ভিন্ন আঙ্গিক চোখে পড়ছিল।

শাই আমার সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটছিল – একদম নিস্তব্ধে, মাঝে মাঝে শুধু কুলকুল করে বয়ে যাওয়া জলধারার শব্দ আর খয়েরি 'ম্যাকাক' বাঁদরগুলোর চিল-চিৎকার কানে আসছিল। ওরা আসলে বুঝে গেছে যে 'মানুষ'দের কাছে গেলে কিছু স্ন্যাক্স পাওয়া যেতে পারে!

বিশ্বের দীর্ঘতম কেবল কার

পরদিন সকালে ঘন মেঘের মধ্যে দিয়েই আমরা ঘণ্টাখানেক দূরের তিয়ানমেন পর্বতে পৌঁছে যাই। জায়গাটা জ্যাংঝাঝিয়ে শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে।

এই এলাকাটা অবশ্য জ্যাংঝাঝিয়ে জাতীয় উদ্যানের অংশ নয়, তবে শাই বারবার বুঝিয়েছিল যে এখানে 'একটা কিছু স্পেশাল' ব্যাপার আছে।

জাতীয় উদ্যানের ভেতরে যেমন লিফট আছে পাহাড়ে চড়ার জন্য, এখানে তেমনই পাহাড়ের ওপর থেকে নিচে নামার জন্য একটা কেবল কার যাতায়াত করে। আট-আসনের গন্ডোলাটায় বসে আমি বুঝতে পারলাম যে এটাকে ঘিরে মানুষের এত উত্তেজনা কেন!

এটা আসলে বিশ্বের দীর্ঘতম কেবল কার, সাত কিলোমিটারেরও বেশি পথ পাড়ি দিয়ে পাহাড় চূড়ায় পৌঁছতে এই কেবল কার সময় নেয় আধ ঘণ্টা মতো। মাথার চুল খাড়া করে দেওয়ার মতো খাড়া চড়াই পেরোতে হয় এই পথে। আর চারদিকে পাহাড়-চূড়াগুলো আর পাহাড়ি পথের একটা ৩৬০ ডিগ্রি দৃশ্য-পট দেখা যায়। গোটা পথে ৯৯টি তীক্ষ্ণ বাঁকও আছে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে তিয়ানমেন আসলে দুর্বলচিত্তের মানুষের জন্য নয়। এখানে যে অসংখ্য কাঁচের ব্রিজ আর খাড়া পাহাড়ের ধার দিয়ে পায়ে চলার পথ আছে, সেখানে আসলে এরকম মানুষের জায়গা নেই।

এমনকি পায়ের নিচে কুয়াশায় ঢাকা কাঁচ দেওয়া ব্রিজগুলো যখন পার করছিলাম সাবধানি আর আন্দাজে পা ফেলে ফেলে, তখন আমি নিজেই টের পাচ্ছিলাম আমার হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি নিজের কানেই শোনা যাচ্ছে।

আর ঠিক এই সময়েই শাইকে বলতে হলো যে এই 'স্কাই-ওয়াক'টাকে আসলে বলা হত 'ওয়াক অফ ফেইথ'! ওটা ঠিক তখনই জানাতে হলো ওকে!

'স্বর্গের দুয়ার'

সকাল থেকেই সবকিছুই ঝাপসা দেখা যাচ্ছিল। জাতীয় উদ্যানের ভেতরে যেরকমটা দেখেছি, অনেকটা সেরকমই প্রস্তর-স্তম্ভ আর পাহাড় চূঁড়াগুলোর একটা আভাস যদিও দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল।

এরপরেই আমার চোখে পড়ল সেই গুহা আর খিলান – যেটা দুটো পাহাড়-চূঁড়াকে জুড়েছে। চীনের লোকগাঁথায় বলা হয় এই খিলানটা হলো স্বর্গের দুয়ার, সেজন্যই স্থানীয়ভাবে এই পাহাড়ের নাম তিয়ান মেন শান বা স্বর্গের দুয়ার পর্বত।

বহু পর্যটক যখন হাঁপাতে হাঁপাতে ৯৯৯টা সিঁড়ি চড়ে গুহার মুখে পৌঁছাচ্ছেন, আমরা তখন নিচের চাতালটায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমাদের চোখের সামনে তখন সাদা চাদরে মোড়া একটা পুরো দৃশ্যপট।

হঠাৎই মেঘ সরে গেল, কুয়াশা উবে গেল, আর গুহাটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। এরকম একটা মুহূর্তের জন্যই বোধহয় বেড়ানোটা আরও আনন্দের হয়ে ওঠে।

আশপাশের মানুষরা উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠলেন, কেউ তো হাততালিও দিয়ে ফেললেন।

কিন্তু আমার মুখ যে সেই অপার-বিস্ময়ে হাঁ হয়ে রইল...