২০২২ সালের জুলাই মাসে আব্দুর রউফ তালুকদার যখন গভর্নরের দায়িত্ব পান তখন ব্যাংকে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে। আর আব্দুর রউফ তালুকদার যখন পালিয়ে যান তখন দেশের রিজার্ভ ২০ বিলিয়নের নিচে নেমে গেছে। ফাইল ছবি
দেশের চরম রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যেও কখনও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের পালিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটেনি, যা এবার ঘটেছে সদ্যবিদায়ী গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের পালিয়ে যাওয়ার মধ্যদিয়ে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তিন দিন দায়িত্বে থাকলেও চতুর্থ দিন ৯ আগস্ট দুপুরে পদত্যাগ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ১২তম গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকেই এক রকমের লাপাত্তা ছিলেন আব্দুর রউফ; করেননি অফিস, দেখা যায়নি লোক-সম্মুখে।
গভর্নের মতো একটি অরাজনৈতিক পদে থাকার পরও কেন রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ঢেউয়ে আওয়ামী লীগের অনেক নেতার মতো গভর্নরকেও পালিয়ে যেতে হলো- এমন প্রশ্নে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘বিগত এক দশকের বেশি সময় ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা যেভাবে খর্ব করা হয়েছে এবং গভর্নর পদটিকে যেভাবে রাজনৈতিক পদে পরিণত করা হয়েছে তাতে গভর্নরের পালিয়ে যাওয়ায় অবাক হওয়ার কিছু নেই।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকে এখন পর্যন্ত কয়েক দফা রাজনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতি সৃষ্টি হলেও, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে তার রাজনৈতিক ছোঁয়া লেগেছে যৎসামান্য। কিন্তু এবার সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে গণঅভ্যুত্থানের মিছিলের রেশ লাগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকেও। এত বছর ব্যাংকখাতে সৎ কর্মকর্তাদের একপাশে সরিয়ে রেখে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে অসৎ কর্মকর্তাদের গভর্নর এবং ডেপুটি গভর্নরের মতো পদে বসিয়ে রাখার জন্যই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান এ কর্মকর্তা।
গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার সম্পর্কে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গভর্নর হিসেবে তিনি ছিলেন প্রচণ্ড দাম্ভিক। অন্যদের সিদ্ধান্ত কিংবা পরামর্শের তোয়াক্কা পর্যন্ত করতেন না। ডেপুটি গভর্নরদের নিয়ে নিজেদের ইচ্ছামতো ব্যাংক চালাতেন আব্দুর রউফ।
দেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু হত্যা, জিয়াউর রহমান হত্যা, এরশাদ পতনের মতো বড় বড় অস্থিতিশীল ঘটনায়ও গভর্নররা নিজ পদে আসীন ছিলেন।
আব্দুর রউফ তালুকদার তৎকালীন সরকারের এজেন্ট হয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এসেছিলেন উল্লেখ করে বেসরকারি ব্যাংকের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সময় সংবাদকে বলেন, ‘রউফ যে কয়টি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তার প্রায় সবকটি দেশের অর্থনীতির জন্য আত্মঘাতী। বিশেষ করে এস আলম গ্রুপের শরীয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলোকে রক্ষা করতে এবং দুর্নীতি ঢাকতে যা যা করেছেন তা দেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে নজিরবিহীন।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২২ সালের জুলাই মাসে আব্দুর রউফ যখন গভর্নরের দায়িত্ব পান তখন ব্যাংকে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪০ বিলিয়ন ডলারের উপরে। আর আব্দুর রউফ তালুকদার যখন পালিয়ে যান, তখন দেশের রিজার্ভ ২০ বিলিয়নের নিচে নেমে গেছে। এ বিশাল সময়ে টাকা লুটপাটের মতো ঘটনা এত হরহামেশা ঘটেছে যে, ব্যাংকখাতে অর্থ লোপাট সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন সময় সংবাদকে বলেন, ‘রাজস্ব বিভাগের আলোচিত দুর্নীতিবাজ মতিউরের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের ছবিই প্রমাণ করে কোন শ্রেণির মানুষের সঙ্গে তার সখ্য ছিল। এতদিন ধরে ব্যাংকখাতে যেসব অনিয়ম চলছে এসবের দায়ভার কোনোভাবেই গভর্নর এড়াতে পারেন না। এটি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা যায়, গভর্নরের জ্ঞাতসারেই টাকা ছাপিয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যাংকগুলোকে সাহায্যের নামে অর্থ লোপাটের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে।’
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নর নিয়োগে এস আলম গ্রুপের বিশাল প্রভাব ছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। যোগ্যতার ভিত্তিতে সরকারি সিদ্ধান্ত নয়; বরং নিজেদের কাছের লোক বড় পদে নিয়োগের জন্য এস আলমের স্বেচ্ছাচারিতার সঙ্গে তাল মেলাতেন কর্তাব্যক্তিরা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের অভিযোগ, বিগত কয়েক বছরে যোগ্যতার ভিত্তিতে পদোন্নতি হয়েছে হাতে গোনা। ডেপুটি গভর্নর থেকে শুরু করে অন্য বড় বড় পদে বসতে হলে এস আলম গ্রুপকে অবাধে অবৈধ সুবিধা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে হতো।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা সময় সংবাদকে বলেন, ‘অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের বড় বড় কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মন্ত্রী পর্যায়ের লোকজনের সঙ্গে এস আলম গ্রুপের কর্তাব্যক্তিদের ছিল দহরম-মহরম। গভর্নর নিয়োগের আগে সরকারের মন্ত্রী পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিরা এস আলম গ্রুপের পরামর্শ নিতো। তৎকালীন সরকারই এস আলম গ্রুপের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিল।’
ওই ব্যাংক কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার ছিলেন এস আলম গ্রুপের কাছের মানুষ। তার নিয়োগের পেছনে এস আলম গ্রুপের বড় প্রভাব ছিল। নিয়োগ পেয়ে এস আলম গ্রুপকে হেন কোনো অবৈধ সুবিধা নেই, যা আব্দুর রউফ দেননি।’
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘তারল্য সংকট মেটানোর কথা বলে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে দেদারসে অর্থ সহায়তা দেয়া হয়েছে এস আলম পরিচালিত শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলোকে। এই ব্যাংকগুলোর লুটপাট নিয়ে খুব ভালোভাবেই জানতেন গভর্নর। অথচ তিনি কোনো ব্যবস্থা নেয়া তো দূরে থাক, অবৈধভাবে এসব ব্যাংকে অর্থ সরবরাহ করে গেছেন।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২২ সালের জুনে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোতে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ২৬ হাজার ৮৭৬ কোটি টাকা। এক বছর পর ২০২৩ সালের জুনে তা কমে ১১ হাজার ৬৩০ কোটি টাকায় নেমে আসে। ২০২৩ সালের নভেম্বরে এসব ব্যাংকের অতিরিক্ত তারল্য আরও কমে ৫ হাজার ৪৩০ কোটি টাকায় নেমে আসে।
দিনকে দিন যেভাবে তারল্য কমছে, তেমনি বেড়েছে তারল্য সহায়তা। চলতি মাসের ৭ আগস্ট পর্যন্ত এই ছয় ব্যাংকের কাছে বকেয়া তারল্য সহায়তা দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৬২১ কোটি টাকা।
আওয়ামী লীগ সরকারের ছত্রছায়ায় ব্যাংকখাতে এ লুটপাট চালিয়েছে এস আলম গ্রুপ। আর তাদের সহায়তা করেছেন স্বয়ং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর।
গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে গভর্নরের অবস্থান প্রসঙ্গে নানা সময়ে নানা তথ্য এলেও, বর্তমানে আব্দুর রউফ কোথায় আছেন সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সময় সংবাদকে বলেন, পদত্যাগের আগের দিন পর্যন্ত গভর্নর ভবনেই অবস্থান করছিলেন আব্দুর রউফ। তবে পদত্যাগের কিছু সময় আগেই ভবন ছাড়েন তিনি। বর্তমানে রাজধানীতেই অবস্থান করছেন আব্দুর রউফ তালুকদার। তবে তিনি কোথায় আছেন সুনির্দিষ্টভাবে তা বলতে পারেননি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। সময় সংবাদ