News update
  • Guterres Urges Leaders to Act as UNGA Week Begins     |     
  • BNP to go door to door for hearts and votes     |     
  • Chittagong port tariffs increased up to 50 per cent     |     
  • Rising Heat Cost Bangladesh $1.8 Billion in 2024     |     
  • Stocks extend gains; turnover drops in Dhaka, rises in Ctg     |     

অটোমান ইতিহাসের 'সবচেয়ে ক্ষমতাধর' নারী হুররেম সুলতান কে ছিলেন?

বিবিসি বাংলা মিডিয়া 2025-06-08, 8:26am

img_20250608_081809-4acd9f8697c68f4355d4c4d6f35345f31749349611.png




হুররেম সুলতান––যাকে নিয়ে ইতিহাসের পাতায় নানা বিতর্ক রয়েছে, তবে সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে তিনি ছিলেন অটোমান সাম্রাজ্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী নারী, ইতিহাসের অন্যতম শক্তিশালী শাসক সুলতান সুলেমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্টের প্রিয় স্ত্রী এবং একজন রহস্যময় ব্যক্তিত্ব।

যার লিগ্যাসি বা পরম্পরা নিয়ে এখনো লেখালেখি হচ্ছে, নতুন ব্যাখ্যা দাঁড় করানো হচ্ছে, সেইসাথে তকে নিয়ে হারানো অনেক তথ্য পুনরুদ্ধারের কাজও চলছে।

হুররেম সুলতান মারা যান ১৫৫৮ সালে। মৃত্যুর চারশ বছরের বেশি সময় পরে এখনো এই ব্যক্তিত্ব ইতিহাসপ্রেমীদের মুগ্ধ করে চলেছেন।

হুররেম সুলতান, যার আরেক নাম রক্সেলানা, তিনি কেবল সম্রাটের একজন উপপত্নী বা সঙ্গিনী বা স্ত্রী-ই ছিলেন না; বরং দাসত্ব থেকে সাম্রাজ্যের প্রভাবশালী অবস্থানের চূড়ায় ওঠার এক অসাধারণ যাত্রা পাড়ি দিয়েছেন তিনি।

নিজেকে ভেঙেচুড়ে এমনই এক ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিলেন যা ষোড়শ শতাব্দীর অটোমান রাজদরবারের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে নতুন রূপ এনে দিয়েছিলো।

যা ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এবং দীর্ঘস্থায়ী সাম্রাজ্যগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে বিবেচিত।

অনেক ইতিহাসবিদের মতে, হুররেমের উত্থানের মধ্য দিয়ে মূলত 'নারীদের সালতানাতের' একটি পর্ব শুরু হয়েছিল যখন অটোমান বা উসমানীয়দের শাসনে রাজপরিবারের নারীদের নজীরবিহীন প্রভাব বিস্তার করতে দেখা গিয়েছিল।

"ম্যাগনিফিসেন্ট সেঞ্চুরি" আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল

তুর্কিয়ে ভাষায় একে 'কাদিনইয়ার সালতানাতে' বলা হতো। যার অর্থ নারীদের শাসন করার বা নেতৃত্বের জায়গায় পৌঁছানো।

মূলত হুররেমের উত্থানের সাথে রাজ্যের নারীদের এমন অভূতপূর্ব প্রভাব বিস্তার শুরু হয়েছিল।

অটোমান বা উসমানীয় সাম্রাজ্যে সুলতানের প্রাসাদের ভেতরে হারেম ছিল। এই হারেম হলো প্রাসাদের আলাদা একটি অংশ যেখানে সুলতানের স্ত্রী, উপপত্নী, পরিবারের নারী সদস্য এবং নারী দাসীরা থাকতেন।

এই অটোমান হারেমে হুররেমের থাকার সময়কাল এবং তার পরবর্তী সময় বিশদে নথিভুক্ত আছে।

তবুও শত শত বছর পেরিয়ে গেলেও, হুররেমের প্রকৃত পরিচয় নিয়ে, অর্থাৎ তিনি কোথা থেকে এসেছিলেন সে নিয়ে রহস্য ও বিতর্ক এখনো রয়ে গিয়েছে।

তিনি ইউক্রেন অঞ্চল থেকে অপহৃত কোনো বন্দি, অর্থোডক্স পুরোহিতের কন্যা, নাকি — অপ্রত্যাশিত তত্ত্ব অনুযায়ী — জলদস্যুদের দ্বারা অপহৃত কোনো ইতালীয় অভিজাত নারী ছিলেন?

বেশিরভাগ ইতিহাসবিদদের মনে করেন, হুররেম সুলতান পনেরশ শতকের শুরুর দিকে রুথেনিয়া নামে এক ঐতিহাসিক অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন; আজকের দিনে যা ইউক্রেন, পোল্যান্ড এবং বেলারুশের কিছু অংশ জুড়ে ছিল।

জন্মের পর হুররেমের নাম কী ছিল সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো রেকর্ড নেই। কিছু ইউক্রেনীয় সূত্র তাকে আলেকজান্দ্রা লিসোভস্কা বা আনাস্তাসিয়া হিসেবে উল্লেখ করে।

অন্যরা মনে করেন–– তিনি পশ্চিম ইউরোপে লা রোসা (লাল), রোজানা (মার্জিত গোলাপ), রোকসোলান (রুথেনিয়ান নারী), রোকসানা বা রোক্সেলানার মতো নামে পরিচিত ছিলেন।

তবে, সরকারি অটোমান নথিতে তাকে হাসেকি হুররেম সুলতান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

ফার্সি ভাষায় 'হুররেম' অর্থ সুখী বা আনন্দময়, এবং 'হাসেকি' হলো সুলতানের সন্তানের মায়ের জন্য সংরক্ষিত একটি সম্মানসূচক উপাধি।

কিছু সূত্র দাবি করে যে, হুররেম একজন অর্থোডক্স পুরোহিতের কন্যা ছিলেন, আবার অনেকে মনে করেন যে তিনি একটি কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

যেখানে বলা হয়েছে, রোহাটিন নামের এক শহরে — যা তখন পোলিশ রাজ্যের অংশ ছিল এবং বর্তমানে পশ্চিম ইউক্রেনে অবস্থিত — সেখানে হুররেম ক্রিমিয়ান তাতার দস্যুদের হাতে বন্দি হয়েছিলেন।

এরপর, তাকে দাস হিসেবে বিক্রি করা হয়েছিল। কিশোর বয়সে হুররেমকে অটোমান সাম্রাজ্যে আনা হয় এবং তাকে যুবরাজ সুলেমানের মা-র কাছে উপহার হিসেবে দেওয়া হয়। আরেক তুর্কি অধ্যাপক জেইনেপ তারিম এমন ব্যাখ্যা দেন।

এই যুবরাজ সুলেমান পরবর্তীতে সুলতান হন এবং সুলেমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট নামে পরিচিতি পান।

ইতিহাসবিদরা বলছেন যে হুররেম সম্ভবত ১৫২০ সাল নাগাদ হারেমে যোগ দিয়েছিলেন, কারণ সুলেমানের সাথে তার প্রথম সন্তান, প্রিন্স মেহমেদ, পরের বছর জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

শত বছরের প্রথা ভেঙে, সুলেমান হুররেমকে বিয়ে করেছিলেন – যা রাজদরবারকে বিস্মিত করেছিলো এবং হুররেমের অবস্থানকে নজিরবিহীন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলো।

এর আগে অন্য কোনো অটোমান সুলতান কোনো উপপত্নীকে বিয়ে করেননি।

ইতালীয় পরিচয়

হুররেম রুথেনিয়ান বংশোদ্ভূত হতে পারেন এ বিষয়ে ব্যাপক একমত হওয়া সত্ত্বেও, হুররেমের পেছনের কাহিনী নিয়ে বিকল্প তত্ত্বগুলো এখনো রয়ে গেছে।

(পূর্ব ইউরোপীয় এলাকার বাসিন্দাদের বোঝাতে পশ্চিম বা মধ্য ইউরোপীয়রা মধ্যযুগে এই রুথেনিয়ান শব্দটি ব্যবহার করতো)

একটি বিশেষভাবে বিতর্কিত দাবি করেছেন গবেষক ড. রিনালদো মারমারা, যিনি বলেছেন যে তিনি ভ্যাটিকানের আর্কাইভে একটি পাণ্ডুলিপি খুঁজে পেয়েছেন, যেখানে বলা হয়েছে হুররেম আসলে একজন ইতালীয় অভিজাত নারী ছিলেন — তিনি ছিলেন সিয়েনা অঞ্চলের মার্সিলি পরিবারের একজন সদস্য এবং তার নাম ছিলো মার্গেরিটা।

তিনি বলেন, এই নথি অনুযায়ী, তিনি এবং তার ভাইকে জলদস্যুরা বন্দি করেছিলো এবং পরে তাদের অটোমান দরবারে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়া হয়।

গবেষক মারমারা আরও বলেন, ওই পাণ্ডুলিপি থেকে জানা যায় যে হুররেমের বংশধর সুলতান মেহমেদ চতুর্থ এবং পোপ আলেকজান্ডার সপ্তমের মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল — যা তার রুথেনিয়ান পরিচয় নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি করে এবং এক গোপন অভিজাত বংশের ইঙ্গিত দেয়।

তবে ইতিহাসবিদরা সন্দেহ প্রকাশ করেন। অধ্যাপক তারিম সতর্ক করে দেন যে এই দাবির সত্যতা প্রমাণের জন্য আরও অনেক তথ্য-প্রমাণ দরকার।

তিনি উল্লেখ করেন, তৎকালীন ভেনিসীয় রাষ্ট্রদূতের রেকর্ডে এ বিষয়ে বিস্তারিত কোনো উল্লেখ নেই। সেই সময়ের রাজদরবারের গুজব ও কূটনৈতিক বিষয়ে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উৎস ছিল এই ভেনিসীয় রাষ্ট্রদূতের রেকর্ড।

"যদি এমন কিছু থাকতো, তাহলে ওই রেকর্ডগুলোয় সেই তথ্য পাওয়া যেতো, আমরা অনেক আগেই তা জেনে যেতাম," তিনি বলেন।

অধ্যাপক এমেচেনও এই সন্দেহের সাথে একমত, তিনি স্বীকার করেন যে হুররেম পোলিশ রাজপরিবারের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন ঠিকই, তবে সেটা সম্ভবত আনুষ্ঠানিক কূটনীতির অংশ ছিল — অভিজাত বংশের প্রমাণ নয়।

অটোমান যুগের নথি এবং কবিতাগুলোয় মাঝে মাঝে তাকে "রাশিয়ান ডাইনি" হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা ছিল সমালোচকদের দেওয়া তার একটি অপমানজনক উপাধি।

বিশেষ করে অন্য নারীর গর্ভে জন্ম নেয়া সুলেমানের বড় ছেলে প্রিন্স মুস্তাফার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার পর তাকে এই এমন কটাক্ষমূলক উপাধি দেয়া হয়।

প্রিন্স মুস্তাফা অটোমান সিংহাসনের প্রথম উত্তরসূরি ছিলেন।

ধারণা করা হয়, হুররেমই তার এই মৃত্যুর নেপথ্যে ছিলেন, যেন তার নিজের ছেলেদের সিংহাসনে আরোহণের পথ পরিষ্কার হয়ে যায়।

অধ্যাপক এমেচেন ব্যাখ্যা করেন, অটোমান প্রেক্ষাপটে "রুস" শব্দটি শুধু জাতিগত রাশিয়ানদের বোঝাতে ব্যবহার করা হতো না। বরং, এটি ছিল একটি ভৌগোলিক উপাধি—উত্তরের যেকোনো এলাকা থেকে আসা লোকদের জন্য এটি ব্যবহৃত হতো, যার মধ্যে বর্তমান ইউক্রেন ও বেলারুশও পড়ে।

তৎকালীন পশ্চিমা ভ্রমণকারী বা পর্যটকরা ও ভেনিসীয় কূটনীতিকরাও হুররেমকে রাশিয়ান বলে উল্লেখ করেছিলেন। তবে গবেষকদের মতে, এটি তার জন্মসূত্রে ভৌগোলিক পরিচয়কে বোঝাত, জাতিগত পরিচয় নয়।

"সেই সময়ে, আজকের সীমানার মধ্যে কোনো রাশিয়া ছিল না। (তৎকালীন চিঠিপত্রে) তারা রাশিয়ান বলতে বোঝাতো 'রুশীয় অঞ্চল থেকে'," বলেন অধ্যাপক এমেচেন।

"ষোড়শ শতকে, পোল্যান্ডে যেখানে ইউক্রেনীয়রা বাস করতেন, সেই এলাকাগুলোকে বলা হতো 'রুস্কে' প্রদেশ, এবং রোহাতিন ছিল তার অংশ," যোগ করেন বিবিসি নিউজ ইউক্রেনিয়ানের ভিতালি চেরভোনেঙ্কো।

"সেই সময়ে ইউক্রেনীয়দের 'রুসিন' বলা হত, কিন্তু রাশিয়ার সাথে এর কোনো সম্পর্ক ছিল না," তিনি বলেন।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, হুররেম সুলতানের পরিচয় নতুন রাজনৈতিক গুরুত্ব পেয়েছে, বিশেষ করে ইউক্রেনে, যেখানে তিনি একজন জাতীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে সম্মানিত।

তার সম্মানে তার কথিত জন্মস্থান রোহাতিনে ভাস্কর্য রয়েছে এবং বর্তমানে রাশিয়া-অধিকৃত মারিউপোল শহরের একটি মসজিদে সুলেমানের নামের পাশাপাশি তার নাম রয়েছে।

২০১৯ সালে, আঙ্কারায় ইউক্রেনীয় দূতাবাসের অনুরোধে, ইস্তাম্বুলের সুলেমানিয়ে মসজিদ কমপ্লেক্সে হুররেমের কবরের শিলালিপি থেকে তার 'রাশিয়ান বংশোদ্ভূত' সংক্রান্ত তথ্য মুছে ফেলা হয়।

আপডেট করা শিলালিপিটি এখন তার ইউক্রেনীয় ঐতিহ্যকে তুলে ধরা হয়েছে, যার মাধ্যমে ধারণা পাওয়া যায় যে আধুনিক ভূ-রাজনীতির প্রেক্ষাপটে হুররেমের উত্তরাধিকার কতোটা গুরুত্ব বহন করে।

হুররেমের প্রভাব হারেমের চার দেয়ালের বাইরেও অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তবে সম্ভবত তার জনহিতকর কাজগুলো সবচেয়ে বেশি স্থায়ী হয়েছে।

তিনি ইস্তাম্বুল এবং জেরুসালেমে (যা তখন অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ ছিল) মসজিদ, বিনামূল্যে খাওয়ানোর কেন্দ্র বা স্যুপ কিচেন এবং দাতব্য প্রতিষ্ঠান চালু করেছিলেন, যা তখন অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ ছিল।

ইস্তাম্বুলের হাসেকি এলাকা আজও তার নাম বহন করে আসছে।

ঐতিহাসিক নথি অনুসারে, হুররেম সুলতান ১৫৫৮ সালের ১৫ই এপ্রিল ইস্তাম্বুলে স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন।

তার দেহ সুলেমানিয়ে মসজিদে দাফন করা হয়েছিল। পরে, সুলতান সুলেমানের নির্দেশে তার কবরের স্থানে একটি সমাধি নির্মাণ করা হয়।

হুররেমের মৃত্যুর মাধ্যমে একটি অসাধারণ জীবনের সমাপ্তি ঘটে, কিন্তু তাকে ঘিরে থাকা প্রশ্নগুলো আজও ফুরায়নি।

তিনি রুথেনিয়ান বন্দি হোন, ইতালীয় অভিজাত পরিবারের সদস্য হন, কিংবা ভুল বোঝা এক ক্ষমতাধর নারী— হুররেম সুলতান অটোমান ইতিহাসে এবং বৈশ্বিক ইতিহাসে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও বিতর্কিত ব্যক্তিত্বদের একজন হয়ে আছেন।