বাংলাদেশে অর্থনীতির বেশিরভাগ সূচক খারাপ হচ্ছে। দেশের ব্যবসা ও বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে বহুমুখী সংকট সামনে আনছেন ব্যবসায়ীরা। অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও একটা নেতিবাচক ধারা দেখা যাচ্ছে। দেশের অর্থনীতির জন্য এগুলোকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী সবাই।
পাঁচই অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর একদিকে যেমন বেশকিছু শিল্প কারখানা বন্ধ হয়েছে, আবার সম্ভাবনাময় অনেক শিল্প কারখানাও অর্থাভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।
আবার অর্থায়ন সংকট, ঋণ সহায়তা, সুদহার বৃদ্ধির কারণে ব্যবসায়ীরা উদ্বেগ জানাচ্ছেন নিয়মিত। সার্বিকভাবে ব্যবসা ও বিনিয়োগের পরিবেশ নিয়েও দুশ্চিন্তা ফুটে উঠছে ব্যবসায়ীদের কথায়।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলে চামড়া ও পাট শিল্পের একজন উদ্যোক্তা মো. ফিরোজ আহমেদ। পাটকলের মুনাফা এবং ব্যাংক ঋণের ভর করে খুলনার ফুলতলায় দেশের বৃহত্তম চামড়া প্রকিয়া কারখানা প্রতিষ্ঠা করেছেন। ফুলতলায় সুপার জুট মিলস ও সুপারেক্স লেদার নামে দুটি প্রতিষ্ঠান তার গড়ে তোলা।
মি. আহমেদ জানান, অতীত ও বর্তমান সংকট মিলিয়ে রপ্তানিমুখী দুটি শিল্প কারখানাই এখন রুগ্ন। পাটকলে সক্ষমতার ২৫ শতাংশ এবং চামড়া কারখানায় দশ ভাগের কম সক্ষমতা কাজে লাগাতে পারছেন।
মি. আহমেদ জানান জানান, তার দুই কারখানার ৮০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ জমেছে। দৈনিক সুদ হচ্ছে ৩০ লাখ টাকা। চামড়া ও পাটকল মিলে আড়াই হাজারের বেশি শ্রমিকের কাজ নেই।
তার দাবি, দেশে পাট ও চামড়া কাঁচামালের অভাব নেই। বিদেশি ক্রেতা ও রপ্তানির সুযোগও রয়েছে। পুরোদমে কারখানা দুটি চালাতে তার এখন ন্যুততম ২০০ কোটি টাকা ঋণ সহায়তা দরকার। এরই মধ্যে সুদের হার বৃদ্ধির কারণে ঋণের সুদ আরও বেড়েছে।
"আমাদের দুটো ফ্যাক্টরিতে দৈনিক মাত্র ৫-৭ লাখ টাকা ইনকাম হয়। এখন এতবড় ইন্টারেস্ট কী করে দেব। এই জায়গাগুলো এই সরকারকে দেখতে হবে। এশিয়ার মধ্যে বড় ফ্যাক্টরি তৈরি করেছি, যদি ব্যাংক এগুলো না দেখে আমার মনে হয় এই বাংলাদেশে নতুন করে কোনো লোক এই ধরনের রিস্ক নিয়ে নতুন করে আর ব্যবসা করবে না।"
মি. আহমেদ বলেন, ২০১৭ সালে স্থাপিত সুপারেক্স লেদার কারখানায় দৈনিক এক লাখ বর্গফুট চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে সক্ষম। তার দাবি এশিয়ার বৃহত্তম এ কারখানাটি দেশের মাত্র তিনটি পরিবেশবান্ধব (এলডক্লিউজি) সনদপ্রাপ্ত চামড়া কারখানার একটি।
চামড়া কারখানায় বিনিয়োগ করে পাটকলের মূলধেনও ক্ষতি হয়েছে। দেশের একটি বেসরকারি ব্যাংক প্রতিশ্রুতি দিলেও সময়মতো এবং প্রয়োজনীয় ঋণ না দেয়ায় গভীর সংকটে পড়তে হয়, জানান তিনি।
কারখানা দুটি চালাতে না পারলে ফিরোজ আহমেদের ঋণখেলাপি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
মি. আহমেদের অভিযোগ, অতীতে ব্যাংক ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে গড়িমসি করেছে। একটি ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তনের পর প্রতিশ্রুত ঋণ পাননি বলেই সমস্যা বেড়েছে।
শতভাগ দেশীয় কাঁচামাল নির্ভর রপ্তানিমুখী শিল্প ঋণ সহায়তা পাবেন এমন আশাবাদ তৈরি হয় সরকার পরিবর্তনের পর। কিন্তু ফিরোজ আহমেদ বলছেন, পরিস্থিতি আশানুরূপ পরিবর্তন হয়নি।
ফিরোজ আহমেদের মতো বহু ব্যবসায়ী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান-শিল্পকারখানা চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন বলে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো জানাচ্ছে।
বলা হচ্ছে, অতীত সংকট আর বর্তমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতি মিলিয়ে বাংলাদেশে ব্যবসা বিনিয়োগে যে স্থবিরতা সৃষ্টি হয়েছে তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে সর্বস্তরের ব্যবসায়ীদের মধ্যে।
প্রাণ আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী এক সাক্ষাৎকারে ব্যবসায়ীদের সমস্যা নিয়ে বিবিসি বাংলাকে বলেন,
"ব্যবসায়ীদের অবস্থা ভীষণ খারাপ। তাদের লোনের টাকা শোধ করতে বেগ পেতে হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা নিজেদের ব্যয় নিয়ে কষ্টের মধ্যে আছে। বিদেশি ক্রেতারা আরো স্বল্পমূল্যে পণ্য ক্রয় করতে চাচ্ছেন। ভারতীয় কম্পিটিশন আসতেছে গার্মেন্টস সেক্টরে। সো অভারঅল ব্যবসায়ীরা কিন্তু বিভিন্নমুখী চাপের সম্মুখীন হচ্ছেন, এটা কিন্তু কেউ ডিনাই করতে পারবে না।"
বাংলাদেশে অন্যতম বড় শিল্পগ্রুপ প্রাণ-আরএফএল'র কর্নধার বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র শঙ্কিত নয় প্রাণ আরএফএল গ্রুপ। যদিও দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগের পরিস্থিতি গত কয়েক বছর ধরে একটা স্থিতাবস্থার মধ্যে ছিল। এখন বিনিয়োগে একটা ভাটা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে স্থানীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে গত অর্থবছরের তুলনায় ৭১ শতাংশ কম।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বিবিসিকে বলেন ঘুষ দুর্নীতি এগুলো কিন্তু কমে নাই। ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ জিডিপির ২৩.৫ শতাংশ এবং বিদেশি বিনিয়োগ সেটা জিডিপির এক শতাংশের নিচে ছিল। সেটা কমে কমে ০.৩ এর কাছাকাছি রয়েছে। একটা বড় সময় ধরে বাংলাদেশে বিনিয়োগে স্থবিরতা দেখা যাচ্ছে।
"বিনিয়োগকারীরা কোনো সময়ই সারা পৃথিবীতেই কোনো জায়গায় বিনিয়োগ করতে চাইবে না যদি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা থাকে। এবং অনেকেরই আমাদের সাথে তো কথাবার্তা হয়, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের। তারা বলেছে যে ইলেকশনের আগে তারা নতুন বিনিয়োগ করার কথা ভাবছে না। এটা দুশ্চিন্তার কারণ। বিনিয়োগের মাধ্যমেই তো কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়," বলেন তিনি।
ফাহমিদা খাতুন বিবিসিকে বলেন, ঘুষ-দুর্নীতি এগুলো কিন্তু কমে নাই। ব্যবসার পরিবেশ নিয়ে সিপিডির জরিপে ১৭টি সমস্যা সামনে এসেছে, এর মধ্যে দুর্নীতি এক নম্বর।
"ব্যবসায়ীরা তারা বলতে পারছে না সরাসরি কারণ। ধরেন ব্যবসা যারা করেন, সেনসিটিভিটির মধ্যে থাকেন, তারা ভয়ের মধ্যে থাকেন যে কী বলতে কী বলে ফেলি। আবার ব্যবসার ক্ষতি হয় কিনা। আবার এখন তো দেখা যাচ্ছে আমরা অন্য ধরনের স্বাধীন অবস্থার মধ্যে রয়েছি যে কোনো একটা বক্তব্য পছন্দ হলো না, একটা মব জাস্টিসের মধ্যে পড়ে যায় অনেকে। তারা তো ওইরকম রিস্কের মধ্যে যেতে চায় না। যদি ভাঙচুর হয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে তাদের ব্যবসা তো বন্ধ হবে। পরিস্থিতি খারাপ হবে। ওখানে যারা কাজ করে তাদেরও," যুক্ত করেন ফাহমিদা।
ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়াম্যান ও এফবিসিসিআইএর সাবেক সভাপতি এবং বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আবদুল আউয়াল মিন্টু বিবিসিকে বলেন, যে পরিবেশ-পরিস্থিতিতে একটা দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে, বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায় এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় সেটা অনুপস্থিত।
"দেশি বিনিয়োগকারীকে যখন দেখবে যে এরা বিনিয়োগ করতেছে তখন আস্তে আস্তে আসবে। না হয় বিদেশি যেগুলি আছে এগুলি কেমনে চলে যাবে সেই চিন্তা করবে। আমি যদি আমার দেশে বিনিয়োগ না করি তো বিদেশি কি মরতে আসবে এখানে? ওতো আমাদের থেকে বেশি চালাক। সে পরিসংখ্যান আমার থেকে বেশি বোঝে। সে দেশের রাজনীতির অবস্থা বেশি দেখতেছে। আমরাতো এখানে ভেতরে বসে অনেক কিছু বুঝি না, কিন্তু তারা বেশি বোঝে।"
ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন বিনিয়োগ ও অর্থনীতিতে গতি সঞ্চারে প্রয়োজন দুর্নীতিমুক্ত স্থিতিশীল পরিবেশ, আইন শৃঙ্খলার উন্নতি এবং আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা।
আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, "বিনিয়োগের জন্য যে পরিবেশ দরকার সে পরিবেশ সৃষ্টি করুন। সেটা হলো আর্থিক খাতকে ঠিক করে বিনিয়োগের জন্য টাকা সাপ্লাই বাড়ান। দুই নম্বর হলো সামাজিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনুন। তিন নম্বর হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসুক।"
অর্থনীতিবিদরা বলছেন চলমান সংকট সমাধানে সময় লাগবে। কর্মসংস্থান, মূল্যস্ফীতি, প্রবৃদ্ধিসহ বিভিন্ন সূচক খারাপের দিকে থাকায় ঢালাওভাবে কারখানা বন্ধ এবং শ্রমিকছাঁটাই যাতে না হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখে পদক্ষেপ নিতে হবে।
"অনেক কারখানা আছে নামকাওয়াস্তে চলছিল। সবই সরকারের টাকায় চলছিল। আবার কিছু কারখানা ভালো চলছিল, যেগুলো ভালো এক্সপোর্ট অরিয়েন্টেড। কিন্তু খেলাপি ঋণ রয়েছে, সেটাকে কীভাবে রিস্ট্রাকচার করা যায় সেটাকে কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং যেসমস্ত ব্যাংকে থেকে তাদের লেনদেন আছে তাদেরকে চিন্তাভাবনা করতে হবে। সব ঢালাওভাবে বন্ধ করা যাবে না। যাচাই বাছাই করতে করতে হবে।"
অন্তর্বর্তী সরকার দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা এবং আর্থিক খাতে নানা সংস্কার শুরু করেছে। বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্যেও পদক্ষেপ নিচ্ছে। আগামীতে ব্যবসা সংকট উত্তরণে কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছেন সেটি নিয়ে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বিবিসিকে বলেন, বিনিয়োগ বাড়াতে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, "যখন দেশি বিনিয়োগকারীরা কশাস (উদ্বিগ্ন) থাকে তখন বিদেশিরাও আসে না। আর কমেছে অবশ্যই, প্রথম কয়েক মাস তো সমস্যা ছিল।"
সরকারে চিন্তাভাবনা নিয়ে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, "মেইন ইস্যু হলো সুদের হারটা একটু বেশি। কিন্তু সরকার দুর্নীতি বন্ধে জোর দিচ্ছে। কারণ ব্যবসায় খরচ ইন্টারেস্ট রেইট একমাত্র ব্যয় নয়।
তাদের কিন্তু অনেক কিছু কস্ট দিতে হয়, আন্ডার দ্য টেবিল অলসো। অতএব উই আর ট্রায়িং টু রিডিউস দ্য ওভারওল বিজনেস কস্ট। আর দ্বিতীয়ত কিছুটা রেগুলেটরি সাপোর্ট দেয়া। এক্সপোর্ট ডাইভার্সিটি করা শুধু আরএমজি না। চামড়া আছে, প্লাস্টিক আছে ইলেকট্রনিক্স আছে এদের যাতে ব্যবসা হয়।"