News update
  • DG Health Services gives 12 directives to treat dengue cases     |     
  • Stock market shows recovery as investors back: DSE chairman     |     
  • BB to appoint administrators to merge troubled Islami banks     |     
  • Bangladesh Bank allows loan rescheduling for up to 10 years     |     
  • Guterres Urges Leaders to Act as UNGA Week Begins     |     

'পরিবর্তিত' বাংলাদেশ নিয়ে কেন শকড্ কলকাতার বাঙালিরা?

বিবিসি নিউজ বাংলা কুটনীতি 2025-02-01, 2:06pm

wqeqweqw-610e1846ed7fc23fd91e46c9f8379f1c1738397203.jpg




"ছোটবেলা থেকে বাবা-কাকার কাছে ঢাকা আর বাংলাদেশের কত গল্প শুনেছি, বহু বার সেদেশে যাওয়ার কথা ভেবেছি। কিন্তু, নাহ, আর বাংলাদেশে যাব না!" কথাগুলো বলছিলেন কলকাতার বাসিন্দা এক নারী।

তিনি সরকারি কর্মচারি, তাই নাম প্রকাশ করতে চান না।

তার কথায়, "কোন বাংলাদেশে যাব? ইতিহাসটাই তো বদলিয়ে দেওয়া হচ্ছে সেখানে – কী দেখতে যাব সেদেশে আর?"

এরকম মনোভাব কলকাতার মধ্যবিত্ত সাধারণ বাংলাভাষী মানুষের একাংশের কথাতেই শোনা যাচ্ছে অগাস্টের পর থেকে।

আবার বাংলাদেশ থেকে যে বহু সংখ্যক মানুষ কলকাতায় আসতেন নানা কারণে, তাদেরও প্রায় কেউই আজকাল আসছেন না। মধ্য কলকাতার নিউ মার্কেট অঞ্চলে ঘুরলেই দেখা যায় সেই চিত্র। এর একটা বড় কারণ অবশ্য মেডিক্যাল ভিসা ছাড়া বাংলাদেশের নাগরিকদের ভারতের ভিসা প্রায় দেওয়াই হচ্ছে না।

তবে ওই গত অগাস্টেরই শেষ দিকে ঢাকায় যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন দীর্ঘদিনের প্রবাসী চাকরি জীবন শেষে কলকাতায় এখন অবসর সময় কাটানো রাজা গাঙ্গুলি।

"জুলাই অগাস্টে বাংলাদেশের ঘটনাবলী দেখে অনেকে আমাকে বারণ করেছিল যেতে। যেন বাংলাদেশে ঢুকলেই ভারতীয় হিন্দু বলে আমাকে কেটে ফেলবে। কিন্তু ঝালকাঠির চেচরি গ্রামে আমার পূর্ব পুরুষের জন্ম-ভিটে দেখার স্বাদ মেটানোর সুযোগ পেয়েছি এতবছর পরে, সেই আশা অপূর্ণ থেকে যাবে?

"অনেকের বারণ না শুনেই চলে গিয়েছিলাম বাংলাদেশে – ২৯শে অগাস্ট। বহু মানুষের সঙ্গে আড্ডা হয়েছে, একেবারে আপন করে নিয়েছিলেন ওদেশের মানুষ। কিন্তু দেশে ফিরে এসে এইসব কথা কাকে বলব! এখানকার মানুষকে যদি আমি বলতাম যে আমাকে প্রায় মেরেই ফেলছিল – বাংলাদেশ থেকে কোনওমতে বেঁচে ফিরে এসেছি – তাহলে বহু মানুষ আমার অভিজ্ঞতার কথা শুনতে চাইত। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ যেন বাংলাদেশের এইসব অভিজ্ঞতার কথাই শুনতে চাইছে আজকাল, " বলছিলেন মি. গাঙ্গুলি।

তার কথায়, বাংলাদেশের ঘটনাবলী নিয়ে ব্যাপক অপপ্রচার চলছে ভারতে এবং তার আজন্ম পরিচিত বহু মানুষও বিশ্বাস করে ফেলছেন সেসব কথায়।

কলকাতার বাঙালিরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে?

রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী বা সরকারি স্তরে বাংলাদেশের অগাস্ট পরবর্তী ঘটনাবলী নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকে নানা কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু রাজনীতির পরিসরের বাইরে পশ্চিমবঙ্গের বা বলা ভালো কলকাতার সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালিরা অগাস্ট পরবর্তী বাংলাদেশ নিয়ে কী ভাবছেন? তারা কি মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন না তাদের মধ্যে কোনও অনীহা কাজ করছে, না কি তারা হতভম্ব বা শকড্?

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ ও রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক সব্যসাচী বসুরায়চৌধুরী বলছিলেন, "দুই বাংলার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে যে সাংস্কৃতিক-বৌদ্ধিক আদানপ্রদান ছিল, যাতায়াত ছিল, সেটা আবার কবে মসৃণ হবে, স্বাভাবিক হবে, সেটা নিয়ে একটা আক্ষেপ বা উদ্বেগ রয়েছে।''

"আবার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে কী না যদি জানতে চান, তাহলে সেদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নানা অবস্থান, নীতি, তাদের ভূমিকা নিয়ে একটা সংশয় কাজ করছে," বলছিলেন মি. বসুরায়চৌধুরী।

'মনে হয় নি অন্য দেশে এসেছি'

কলকাতায় ব্যবসা করেন অভিজিত মজুমদার। তার পৈতৃক ভিটে ছিল বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলায় পাটগেলঘাটার বড় কাশীপুর গ্রামে।

পূর্ব বাংলা থেকে ভারতে চলে আসা অনেক পরিবারের মতোই নিজের পূর্বপুরুষের জন্ম-ভিটে দেখার ইচ্ছা ছিল তার দীর্ঘদিনের।

সেই ইচ্ছা পূরণ করতে গত বছর জুলাই মাসে বাংলাদেশ গিয়েছিলেন মি. মজুমদার।

"শুধু সাতক্ষীরা নয়, আমি বরিশাল, যশোর, খুলনা আর ঢাকা – অনেক জায়গাতেই গিয়েছিলাম। ঢাকাতে আমি ছিলাম ঈদের সময়ে। বাস, গাড়ি, রিকশায় চেপে ঘুরেছি, মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। একটুও আলাদা কিছু মনে হয় নি যে আমি অন্য কোনও দেশে এসেছি," বলছিলেন অভিজিত মজুমদার।

তিনি বলছিলেন, "ব্যক্তিগত আলাপের সময়ে ভেতরে ভেতরে শেখ হাসিনার সরকার নিয়ে বেশ কিছু ক্ষোভের কথা শুনেছি – যেমন ভোট দিতে না পারা বা জিনিসপত্রের অগ্নিমূল্য ইত্যাদি। ভারত সম্বন্ধেও বিশেষ কিছু ক্ষোভের কথা কিন্তু বলেন নি ওদেশের মানুষ। কিন্তু এক দেড় মাসের মধ্যেই যে এত বড় একটা ঘটনা ঘটে যাবে, সেটার কোনও আন্দাজ আমি অন্তত পাই নি।"

অগাস্টে গিয়ে যা দেখলেন কলকাতার একজন

অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী রাজা গাঙ্গুলি আবার পাঁচই অগাস্টের পরের চিত্রটা দেখে এসেছিলেন নিজের চোখে।

"চেচরি গ্রামের কাছে ভাণ্ডারিয়া স্কুলে আমার বাবা পড়তেন আবার সেখানেই এক বছর হেডমাস্টার ছিলেন আমার ঠাকুর্দা। বরিশাল শহর থেকে একজন আমাকে গ্রামে নিয়ে গিয়েছিলেন," বলছিলেন মি. গাঙ্গুলি।

তার কথায়, "খুঁজে পেতে যখন ওই স্কুলে পৌঁছাই সেখানে দেখি বোর্ডে আমার ঠাকুর্দার নাম এখনও রয়েছে। এখন স্কুলের যিনি হেডমাস্টার, তিনি অনেকক্ষণ গল্প করলেন। আমরা খুব কম সময়ের জন্য গিয়েছিলাম, বারবার বলতে থাকলেন এরকম ভাবে এলে হবে না, আমাদের সঙ্গে খেতে হবে – আবার অবশ্যই আসবেন।"

গ্রামের মানুষের আপন করে নেওয়ার কথা যেমন তিনি বলছিলেন, তেমনই সেখানে এক বৃদ্ধকে খুঁজে পেয়েছিলেন রাজা গাঙ্গুলি। তিনি পদবীটা শুনে মনে করতে পারলেন যে তাদের পরিবার কোন জায়গায় থাকত।

"ওই ভদ্রলোক আমাকে বললেন যে আমার ঠাকুর্দা ১৯৬২ সালে চলে আসার সময়ে কোনও জমিজমা বিক্রি করে আসেন নি – এমনিই থাকতে দিয়ে চলে এসেছিলেন," জানালেন মি. গাঙ্গুলি।

তার মনে হয়েছে যে বাংলাদেশের মানুষের একাংশের মধ্যে একটা অভিমান আছে যে কলকাতার বাঙালীরা তাদের কিছুটা 'হেয়' চোখে দেখেন, আবার কলকাতার বাঙালীদের মধ্যে বাংলাদেশ সম্বন্ধে একটা ঘৃণা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে গত কয়েক বছর ধরেই।

সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানে বাধা তৈরি হয়েছে?

একই ভাষা এবং সংস্কৃতির কারণে দীর্ঘদিন ধরেই পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা এবং আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালিদের সঙ্গে বাংলাদেশের একটা ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক বিনিময় থেকেছে নানা স্তরে।

দুই দেশের কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীরা গেছেন অন্য দেশে আবার অধ্যাপক-ছাত্রছাত্রীরাও শিক্ষাক্ষেত্রের নানা কর্মসূচিতে পাড়ি দিয়েছেন অপর দেশটিতে।

আবার কেউ খুঁজতে গেছেন অন্য দেশে ফেলে আসা পিতৃপুরুষের জন্ম-ভিটে। দুই দেশের সাংবাদিকরাও নিয়মিত যাতায়াত করেছেন।

কলকাতা প্রেস ক্লাবের সভাপতি স্নেহাশিস সুর বলছিলেন, "ঢাকা আর কলকাতার মধ্যে একটা নিয়মিত যাতায়াত ছিল নানা স্তরে। যেমন আমি গতবছর একুশে বইমেলার সময়ে সেখানে ছিলাম। আবার ওদিক থেকেও বেড়াতে এলে বা ভারতের অন্য শহরে আসা-যাওয়ার পথে কলকাতা একবার ছুঁয়ে যেতেন বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ। ভিসা দেওয়ার সংখ্যা থেকেই বোঝা যায় কত মানুষ এদিক থেকে যেতেন আর ওদেশ থেকে এখানে কত মানুষ আসতেন।

"যদিও ভারত-বিদ্বেষ চিরকালই ছিল বাংলাদেশের একটা অংশের মধ্যে, তবুও হাজার হাজার মানুষের যাতায়াত ছিল, মানুষে-মানুষে সম্পর্ক – যেটাকে আমরা পাবলিক স্ফিয়ার বলি, সেটা অক্ষত ছিল। তবে অগাস্টের পর থেকে একটা অনিশ্চয়তা এবং অবিশ্বাসের বাতাবরণ নিশ্চিতভাবেই তৈরি হয়েছে," বলছিলেন মি. শূর।

কাজের সূত্রে বহুবার বাংলাদেশ গেছেন কলকাতার সিনিয়র সাংবাদিক তপশ্রী গুপ্ত।

তিনি বলছিলেন, "এ ধরনের বিনিময়ের ক্ষেত্রে একটা বাধা তো নিশ্চিতভাবে গড়ে উঠেছে। একটা সন্দেহের বাতাবরণও তৈরি হয়েছে। আমি এমন একজনকে চিনি ওদেশে, বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাকে যে সমঝোতা করতে দেখছি, তিনি সেটা করতে পারেন বলে আগে আমার ধারণাই ছিল না। হয়ত নানা চাপে বা পরিস্থিতির শিকার হয়ে তিনি এটা করতে বাধ্য হয়েছেন।"

চেনা বাংলাদেশ কী হঠাৎই অচেনা?

বাংলাদেশের কথা বললেই পশ্চিমবঙ্গের একটা বড় অংশের মানুষের মধ্যে পদ্মার ইলিশ, ঢাকাই জামদানি – এই দুটোই সবথেকে বেশি পরিচিত শব্দ থেকেছে।

বেশ কয়েক বছর ধরে নিয়ম করে বাংলাদেশ থেকে পদ্মার ইলিশ রফতানি করা হত দুর্গাপুজোর আগে।

গতবছর পদ্মার ইলিশ আসবে কী না, তা নিয়ে প্রথমে একটা অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল, যদিও শেষমেশ তা এসেছিল।

এ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে বিতর্কও হয়েছে বিস্তর। কলকাতার বাঙালিদের কেউ কেউ এমন মন্তব্যও চোখে পড়েছে যে 'দরকার নেই আমাদের পদ্মার ইলিশের'। সামাজিক মাধ্যমের বাইরে ব্যক্তিগত আলাপচারিতার মধ্যেও উঠে এসেছে সেসব কথা।

কলকাতার প্রকাশক সংস্থা আখর প্রকাশনীর কর্তা রৌণক মৌলিক সম্প্রতি গিয়েছিলেন বাংলাদেশে।

তিনি বলছিলেন, "দুই দেশের মানুষ কী সবাই একে অপরকে এতদিন বুকে জড়িয়ে ধরছিলাম?নাকি আমরা ভাবছিলাম যে বাংলাদেশ খানিকটা আমার মত করেই চলবে আর মাঝে মধ্যে ইলিশ পাঠাবে? আমাদের জীবনে তো বাংলাদেশের অবদান এইটুকুতেই এসে ঠেকেছিল যে বইমেলায় সেদেশের কিছু প্রকাশক এসে বই বিক্রি করবেন আর মাঝে মাঝে হুমায়ুন আহমেদ আর সুনীল গাঙ্গুলির ছবি একসঙ্গে দেখা যাবে আর বাংলাদেশ আমাদের ইলিশ পাঠাবে।''

''কিন্তু বাংলাদেশ যদি তার কথাগুলো তুলতে শুরু করে, যখন প্রশ্ন করে যে কেন ফেলানী খাতুনকে কাঁটাতারে ঝুলতে হবে, তখন এপারের বাঙালীরা সমস্যায় পড়ে যান। এই মুশকিলটাই তাদের এখন হচ্ছে।"

বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন আসলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরের যে ভারত-বিরোধিতার কারণগুলো থেকে গেছে, সেসব শেখ হাসিনার সময়কালে কলকাতার বাঙালিদের সামনে আসে নি। সে কারণেই কী হঠাৎ করে বাংলাদেশকে অচেনা লাগতে শুরু করেছে কলকাতার মানুষের?

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক সব্যসাচী বসুরায়চৌধুরী বলছিলেন, "কলকাতার মানুষের কাছে বাংলাদেশের এই ঘটনাপ্রবাহ কিছুটা অপ্রত্যাশিত ছিল। সে কারণে তারা কিছুটা হতভম্ব। আসলে কলকাতার শিক্ষাবিদ বলুন বা শিল্প-সংস্কৃতির জগতের মানুষদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের লোকেদের ঘনিষ্ঠতা বেশি ছিল ফলে তাদের শাসনের বিরুদ্ধে যে জনমত তৈরি হচ্ছিল, তা যত শতাংশ মানুষের মধ্যেই থাকুক না কেন, সেটার সম্পর্কে এদিককার মানুষরা অবহিত ছিলেন না।

"যেটা আমরা মাঝে মাঝে যাতায়াত করে উপলব্ধি করতাম, সেই খবর কিন্তু কলকাতার সাধারণ মানুষের কাছে ছিল না। তারা যে এখন শকড্, সেটার কারণ এটাই এবং সেজন্যই তারা বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহকে মন থেকে মেনে নিতে পারছেন না," বলছিলেন অধ্যাপক সব্যসাচী বসুরায়চৌধুরী।

যতই শকড্ বা হতভম্ব হোন কলকাতার মানুষ, যতজনের সঙ্গে কথা বলেছি, সবাই চাইছেন যে দুই দেশের সম্পর্ক আবারও স্বাভাবিক হয়ে উঠুক, আবারও চলতে থাকুক বাংলা ভাষাভাষীদের যাওয়া-আসা, আবারও কলকাতা বই মেলায় বাংলাদেশের স্টল বসুক, ঢাকার মানুষ পড়ুন শক্তি চট্টোপাধ্যায়- সুনীল গাঙ্গুলিদের লেখা।