ইউক্রেন থেকে কৃষ্ণ সাগর দিয়ে খাদ্য শস্য রফতানির ব্যাপারে যে চুক্তি হয়েছে, সেটি নবায়নের ক্ষেত্রে রাশিয়া তাদের বিরুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলোর জারি করা নিষেধাজ্ঞা শিথিল করতে বলছে।
এই চুক্তির অধীনে ইউক্রেনে যুদ্ধ সত্ত্বেও দেশটি থেকে লাখ লাখ টন খাদ্যশস্য রফতানি করা সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু রাশিয়া বলছে, যদি তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা না হয়, তাহলে এই চুক্তিটি তারা আর মাত্র ৬০ দিনের জন্য নবায়ন করবে।
এই শস্য চুক্তির প্রয়োজন পড়ছে কেন?
ইউক্রেন বিশ্বে সানফ্লাওয়ার, ভুট্টা, গম এবং যবের মতো শস্যের বড় রফতানি-কারক।
রাশিয়া যখন ২০২২ সালে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে, তাদের নৌবহর ইউক্রেনের বন্দরগুলো অবরোধ করেছিল। এর ফলে ইউক্রেনে প্রায় দুই কোটি টন খাদ্যশস্য আটকে পড়েছিল।
এর ফলে বিশ্বে খাদ্যশস্যের দাম এযাবতকালের মধ্যে সবচেয়ে বেড়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার যেসব দেশ ইউক্রেন থেকে আমদানি করা খাদ্যের ওপর নির্ভর করে, তাদের খাদ্য সরবরাহ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ে। জাতিসংঘ বলেছিল, তখন বিশ্বের সব অঞ্চলে খাদ্যের দাম গড়ে ৩০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল।
জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল আন্তনিও গুতেরেস বলেছিলেন, বিশ্বের ৩৮টি দেশে চার কোটি ৪০ লাখ মানুষ এর ফলে জরুরি অবস্থাকালীন ক্ষুধার মুখোমুখি হয়েছে।
"হর্ন অব আফ্রিকা, যেখানে খরার কারণে মানুষ এরই মধ্যে দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি, তা নিয়ে জাতিসংঘ কর্মকর্তারা চিন্তিত। আর খাদ্যশস্যের অভাব পরিস্থিতিকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে," বলছিলেন ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের একজন বিশেষজ্ঞ রিচার্ড গাওয়ান। এই সংস্থা আন্তর্জাতিকভাবে সংঘাত প্রতিরোধে কাজ করে।
খাদ্য চুক্তির মেয়াদ কি বাড়ানো হবে?
এই চুক্তিটি প্রতি ১২০ দিন পর পর নবায়ন করার কথা, সেই হিসেবে ১৮ই মার্চ আবার এটি নবায়ন করতে হবে।
কিন্তু রাশিয়া এটির মেয়াদ এবার মাত্র ৬০ দিনের জন্য বাড়াতে চায়।
রাশিয়া চায়, তাদের উৎপাদকরা যেন বাকী বিশ্বে আরও বেশি করে খাদ্য এবং সার রফতানি করতে পারে। কিন্তু রাশিয়া বলছে, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে তারা সেটা পারছে না।
রাশিয়ার খাদ্য-পণ্য রফতানির ওপর সুনির্দিষ্টভাবে কোন পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা নেই। কিন্তু মস্কোর যুক্তি হচ্ছে, অন্য যেসব পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তার ফলে আন্তর্জাতিক ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি এবং জাহাজ কোম্পানিগুলো তাদের রফতানি-কারকদের সঙ্গে ব্যবসা করতে চাইছে না।
মস্কো চায়, ইউক্রেনের ব্যাপারে খাদ্য চুক্তি নবায়নের আগে তাদের বিরুদ্ধে এসব নিষেধাজ্ঞার একটা সুরাহা করা হোক।
রাশিয়া হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গম রফতানি-কারক দেশ। বিশ্বের গমের বাজারের ১৯ শতাংশ তারাই যোগান দেয়। সোভেকন নামের একটি কৃষি বিষয়ক পরামর্শ সংস্থার হিসেবে, গত এক বছরে তাদের গমের রফতানি আরও বেড়েছে।
গত বছরের নভেম্বরে রাশিয়া খাদ্যশস্য নিয়ে এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। রাশিয়া অভিযোগ করেছিল, ক্রাইমিয়ায় তাদের যে নৌবহর আছে, সেগুলোর ওপর ইউক্রেন জাহাজ চলাচলের নিরাপদ করিডোরে থাকা তাদের জাহাজ থেকে ব্যাপক 'ড্রোন হামলা' চালিয়েছে।
তবে ইউক্রেন যখন এরকম নিশ্চয়তা দিল যে তারা এই করিডোরকে সামরিক কাজে ব্যবহার করবে না, তখন রাশিয়া আবার এই চুক্তিতে ফিরে আসে।
এই করিডোর কিভাবে কাজ করছে?
গত বছরের ২২ জুলাই রাশিয়া এবং ইউক্রেন কৃষ্ণ সাগর শস্য উদ্যোগে সই করে। জাতিসংঘ এবং তুরস্কের সহায়তায় এই চুক্তি সই হয়।
চুক্তির অধীনে পণ্যবাহী জাহাজ নিরাপদে কৃষ্ণ সাগর দিয়ে ওডেসা, চোরনোমর্স্ক এবং ইউজনি/পিভডেনি বন্দরে চলাচল করতে পারে।
গত বছরের অগাস্টের শুরুতে এভাবে প্রথম খাদ্যশস্য পাঠানো শুরু হয়েছিল। এজন্যে ৩১০ নটিক্যাল মাইল দীর্ঘ এবং তিন নটিক্যাল মাইল প্রশস্ত একটি করিডোর প্রতিষ্ঠা করা হয়।
জাতিসংঘের জয়েন্ট কো-অর্ডিনেশন সেন্টার (জেসিসি) এই করিডোরের তত্ত্বাবধান করে। তাদের হিসেবে গত আট মাসে এই করিডোর দিয়ে প্রায় ৮০০ জাহাজ ইউক্রেনের বন্দরগুলো থেকে ছেড়ে গেছে। এসব জাহাজে বহন করা হয়েছে ২ কোটি ৩০ লাখ টনের বেশি খাদ্য শস্য এবং সার।
এই অতিরিক্ত সরবরাহ বিশ্বে খাদ্যের দাম কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছিল।
বিশ্বের বাজারে ২০২২ সালের বসন্তকাল হতে খাদ্যের দাম কমতে শুরু করেছিল এরকম একটি করিডোর প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এমন ধারণার ভিত্তিতে। এখন খাদ্যশস্যের দাম রাশিয়ার অভিযান শুরু হওয়ার আগে যা ছিল, তার চেয়েও কমে এসেছে।
কী পরিমাণ খাদ্য শস্য রফতানি করা হচ্ছে
রাশিয়ার হামলা শুরু হওয়ার আগে ইউক্রেন যে পরিমাণ খাদ্যশস্য রফতানি করতো, এখন তাদের রফতানি সে তুলনায় ৩০ শতাংশ কম বলে জানাচ্ছে দেশটির কৃষি মন্ত্রণালয়।
এর একটা কারণ কৃষকরাও এখন উৎপাদন করছে কম, কারণ দেশটির বিরাট অংশ জুড়ে এখন যুদ্ধ চলছে।
তবে ইউক্রেনের সরকার দাবি করছে, যেসব জাহাজ ইউক্রেনের বন্দর থেকে খাদ্যশস্য তুলতে আসতো, রাশিয়া যেগুলোর চলাচল বিলম্বিত করতো।
চুক্তি অনুযায়ী, নিরাপদ করিডোর দিয়ে চলা জাহাজ পরিদর্শনের অধিকার রাশিয়ার আছে। ইউক্রেন যাতে এসব জাহাজে করে অস্ত্রশস্ত্র আনতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করতে এটা করা হয়েছে।
একটি শিপিং বিষয়ক সাময়িকী 'লয়েডস লিস্ট' এর ব্রিজেট ডায়াকুন বলেন, "ইউক্রেনের অভিযোগ ছিল এসব পরিদর্শনের বেলায় রাশিয়া খুব বেশি খুঁত ধরার চেষ্টা করতো।"
"কৃষ্ণ সাগরের প্রবেশ মুখে সাধারণত প্রায় একশো জাহাজের একটা লাইন লেগে থাকতো।"
ইউক্রেনের রফতানি করা খাদ্যশস্য কোথায় যায়?
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ইউক্রেনের রফতানি করা খাদ্যের মাত্র ২৫ শতাংশ বিশ্বের সবচেয়ে গরীব দেশগুলোতে যায়:
ইউক্রেনের রফতানির ৪৭ শতাংশ গেছে স্পেন, ইতালি এবং নেদারল্যান্ডস সহ এরকম উচ্চ আয়ের দেশে
২৬ শতাংশ গেছে তুরস্ক এবং চীনের মতো উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে
২৭ শতাংশ গেছে মিশর, কেনিয়া এবং সুদানের মতো নিম্ন এবং নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে।
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনের সমালোচনা করেছেন তাদের খাদ্যশস্য আরও বেশি করে কেন তারা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রফতানি করছে না। তবে জাতিসংঘ বলছে, ইউক্রেনের রফতানির কারণে গোটা বিশ্বের অভাবী মানুষও উপকৃত হয়েছে। কারণ এতে করে বিশ্বের খাদ্যের বাজার স্থিতিশীল হয়েছে এবং খাদ্যের দাম কমে এসেছে।
ইউক্রেন যত খাদ্যশস্য উৎপাদন করে, তার প্রায় অর্ধেক কিনে নেয় জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী। এসব খাদ্যশস্য মানবিক ত্রাণ সাহায্যের অংশ হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিতরণ করা হয়।
গত বছরের অগাস্ট হতে ডিসেম্বরের শেষ পর্যন্ত জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী ইউক্রেন থেকে ১৩টি খাদ্য-বাহী জাহাজ পাঠিয়েছে ইথিওপিয়া, ইয়েমেন, জিবুতি, সোমালিয়া এবং আফগানিস্তানে। এই জাহাজগুলোতে বহন করা হয়েছে মোট ৩ লাখ ৮০ হাজার টন গম। তথ্য সূত্র বিবিসি বাংলা।