
আবারও অস্থির হয়ে উঠেছে রাজধানীর পেঁয়াজের বাজার। গত ৩-৪ দিনের ব্যবধানে প্রতি কেজিতে দাম বেড়েছে অন্তত ৩০-৪০ টাকা পর্যন্ত। সরবরাহ না বাড়লে সামনে দাম আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
এদিকে আবারও বাজার সিন্ডিকেট সক্রিয় হয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরির মাধ্যমে মুনাফা লুটার পাঁয়তারা করছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
সরেজমিনে রাজধানীর কারওয়ান বাজার, শ্যামবাজারসহ কয়েকটি এলাকার বাজার ও আড়ত ঘুরে দেখা যায়, গত শুক্র-শনিবার যেখানে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৯০ টাকায়, সেখানে আজ বুধবার (৫ নভেম্বর) বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৩০ টাকায়।
পেঁয়াজের দাম বাড়ার তথ্য মিলেছে সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) সবশেষ পরিসংখ্যানেও। তথ্য বলছে, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম ৪০ শতাংশ বেড়েছে। মাসের ব্যবধানে যা বেড়েছে ৪৪.৮৩ শতাংশ।
খুচরা ব্যবসায়ীরা জানান, দাম কেন বাড়ছে, তার সুনির্দিষ্ট কারণ তাদের জানা নেই। পেঁয়াজ বিক্রেতা আলমগীর বলেন, ‘পাইকারিতে হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে দাম। কেন বেড়েছে বুঝতেছি না। পাইকারিতে বাড়ায় খুচরা পর্যায়েও বাড়িয়ে বিক্রি করতে হচ্ছে।’
আরেক বিক্রেতা শাহবুদ্দিন বলেন, ‘দাম বাড়ার পেছনে খুচরা বিক্রেতাদের কোনো হাত নেই। পাইকারি বাজার থেকে যে দামে কিনি, সেই অনুযায়ী বিক্রি করি। আমরা নিজেরাও জানি না কেন এমন বাড়ল। দাম বাড়ায় কমেছে বেচাকেনাও।
একই অভিযোগ পাইকারদেরও। তারা বলছেন, ‘আড়ত থেকেই বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। তাই বাধ্য হয়েই বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। পাইকারি পেঁয়াজ ব্যবসায়ী জুবায়ের জানান, ‘পাইকারিতে প্রতিকেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকার ওপরে। আড়তে ও মোকামে দাম বাড়ায় পাইকারিতেও দাম বাড়িয়ে বিক্রি করতে হচ্ছে।’
তবে আড়তদারদের ভাষ্য, ‘যারা পেঁয়াজ সংরক্ষণ করেছেন, তারা ইচ্ছাকৃতভাবে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছেন। এছাড়া বৃষ্টিতেও কিছু পেঁয়াজ নষ্ট হয়েছে। তাই আড়তেও সরবরাহ কম। যার প্রভাব পড়েছে আড়ত, পাইকারি ও খুচরা-সব পর্যায়েই। কয়েক সপ্তাহ এমন অবস্থা থাকতে পারে। তবে নতুন মৌসুমের পেঁয়াজ বা আমদানি করা পেঁয়াজ বাজারে আসলেই দাম কমে যাবে।’
পুরান ঢাকার শ্যামবাজারের আলহাজ ভাণ্ডারের মালিক সহিদুল ইসলাম সময় সংবাদকে বলেন, ‘দেশে বছরে প্রায় ৩৬ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। এবার পেঁয়াজ উৎপাদনও হয়েছিল প্রায় ৩৬ লাখ টন। আমদানি করা পেঁয়াজের কোনো দরকার ছিল না। তবে টানা বৃষ্টিতে কৃষকের প্রায় দুই লাখ টন রাখি পেঁয়াজ নষ্ট হয়েছে। এই কারণেই পেঁয়াজের বাজারে সংকট তৈরি হয়েছে।’
সংকট তৈরি হওয়ায় দাম বাড়ছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘সংকটের পাশাপাশি বাজারে যুক্ত হয়েছে ক্রেতাদের বাড়তি কেনার প্রবণতা। দাম যেই বাড়া শুরু হয়েছে, ওমনি কিছু ক্রেতা বেশি বেশি পেঁয়াজ কিনে মজুত করা শুরু করেছে। যা পেঁয়াজের বাজারকে আরও অস্থির করে তুলছে।’
সহিদুল ইসলাম বলেন, ‘দাম নিয়ন্ত্রণে দ্রুত আমদানির অনুমোদন দেয়া উচিত। অনুমোদন দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে দাম কমতির দিকে চলে যাবে। আর পেঁয়াজ দেশে আসা শুরু হলে দাম নাগালে চলে আসবে।’
পেঁয়াজের আড়তদার ফরিদ হোসেন জানান, ‘গত কয়েক মাসে বাইরের দেশ থেকে কোনো পেঁয়াজ আমদানি করা হয় নি। স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদিত পেঁয়াজ দিয়েই দেশের চাহিদা মেটানো হয়েছে। তবে এখন দেশি পেঁয়াজেরও কিছুটা সংকট চলছে। আবার অনেক অসাধু ব্যবসায়ী সুযোগ বুঝে মজুত করছে তাই দাম বাড়ছে। দাম হঠাৎ করে বাড়ায় কমে গেছে বেচাকেনাও।’
যদি সরবরাহ বাড়ে বা আমদানির অনুমতি দেয়া হয়, তাহলে দাম কমে আসবে বলে মনে করেন আড়তদার ফরিদ হোসেন। তিনি বলেন, তবে সরবরাহ না বাড়লে দাম আরও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পুরো প্রক্রিয়াটিই নির্ভর করছে সরবরাহের ওপর।
পেঁয়াজ আমদানিকারক ও শ্যামবাজার পেঁয়াজ আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আব্দুল মাজেদ সময় সংবাদকে বলেন, ‘গত কয়েক মাস ধরেই দেশের বাজারে পেঁয়াজের সংকট চলছে। দেশে এখন আর পেঁয়াজের তেমন মজুত নেই। তাই দামও ঊর্ধ্বমুখী। প্রতিদিনই কেজি ৫-১০ টাকা করে বাড়ছে। বর্তমানে আড়তে প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ৯৫-১০০ টাকায়।’
দেশে পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমদানির বিকল্প নেই জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজ আমদানি করতে চায়, কিন্তু সরকার থেকে আইপি (ইমপোর্ট পারমিট) দেয়া হচ্ছে না। সরকারের উচিত দ্রুত আইপি দেয়া। আমদানি হলে পেঁয়াজের দাম ৫০ টাকায় নেমে আসবে।’
পেঁয়াজের দামের হঠাৎ এই ঊর্ধ্বমুখিতায় বিপাকে পড়েছেন ভোক্তারা। তাদের দাবি, বাজারে নতুন করে সিন্ডিকেট শুরু হয়েছে। পাইকারি, মোকাম ও আড়তে এখন থেকেই নজরদারি বাড়াতে হবে, তা না হলে সামনে পেঁয়াজের দাম আরও বেড়ে যাবে।
নাবিল নামে ক্রেতা জানান, ‘বাজারে পেঁয়াজের দাম ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় এখন স্বাভাবিক দামে প্রয়োজনমতো পেঁয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না। এভাবে চললে দাম নাগালের বাইরে চলে যাবে। চাপ বাড়বে সংসারের বাজেটে।’
এই পরিস্থিতিতে বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারে সরবরাহ কমেছে ঠিকই, তবে যে হারে দাম বাড়ছে, তা অস্বাভাবিক। আবারও বাজার সিন্ডিকেট সক্রিয় হয়েছে, যারা কৃত্রিম সংকট তৈরির মাধ্যমে মুনাফা লুটছে। কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, এলসি খোলার অনুমতি না দেয়ায় ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ রয়েছে। এখন কৃষকের হাতেও পেঁয়াজ কিছুটা কম। তবে দাম হঠাৎ করে এত বাড়ার মতো পরিস্থিতি এখনও তৈরি হয়নি।
বাজারে তেমন কার্যকরী মনিটরিং ব্যবস্থা নেই বলেও অভিযোগ করেন তিনি। নাজের হোসাইন বলেন, এই সুযোগটাই কাজে লাগাচ্ছে ব্যবসায়ীরা। কারণ অসাধু ব্যবসায়ীরা সুযোগ পেলেই দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করে। এবারও তাই হয়েছে।
ক্যাব সভাপতি এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, দেশে এখন পেঁয়াজের সরবরাহ কিছুটা কম। তাই দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। তবে কৃষি মন্ত্রণালয় আমদানিকারকদের আইপি দিচ্ছে না। আইপি দিয়ে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির সুযোগ দিতে হবে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, ‘দেশের পেঁয়াজের মৌসুম শেষে দিকে। এ সময় আমদানি না হলে কিছুটা সরবরাহ সংকট দেখা দেয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ব্যবসায়ীদের কৃত্রিম সংকট তৈরির পাঁয়তারা। এখন বাজারে সেটিই হচ্ছে; এবং দাম বাড়ছে।’
তবে দেশে এখনও তেমন সরবরাহ সংকট তৈরি হয়নি, যার কারণে দাম হুঁ হুঁ করে বাড়বে। ব্যবসায়ীরা এখানে বড় কারসাজি করছে বলে অভিযোগ করেন ড. জাহাঙ্গীর আলম। তিনি আরও বলেন, ‘মুড়িকাটা পেঁয়াজ বাজারে আসতে এখনও এক-দুই মাস সময় বাকি রয়েছে। তাই এখন ভারত বা অন্য দেশ থেকে কিছু পরিমাণে পেঁয়াজ আমদানি করা যেতে পারে। তবে বেশি পরিমাণে আমদানি করলে পেঁয়াজের দাম একদম কমে যেতে পারে; সেটা আবার কৃষকদের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।’ সময়