তৈরি পোশাকসহ কিছু বাংলাদেশি পণ্য স্থলপথে আমদানি নিষিদ্ধ করে যে বিধিনিষেধ ভারত সরকার আরোপ করেছে, তার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব কেমন হবে তা নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা চলছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই এটি বাংলাদেশের বিষয়ে 'ভারতের একটি কড়া পদক্ষেপ' হিসেবে বর্ণনা করছেন। দুই দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক সম্পর্কের কারণে কেউ কেউ এটিকে দেখছেন 'পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ' হিসেবেও।
ভারত এর আগে গত মাসের শুরুতে তৃতীয় দেশে রপ্তানি পণ্য পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে দেওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রত্যাহার করে নিয়েছিলো। এরপর বাংলাদেশও স্থলবন্দর দিয়ে ভারতীয় সূতা আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করেছিলো।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এখন আবার স্থলবন্দর ব্যবহারে বিধিনিষেধ প্রয়োগের এই সিদ্ধান্ত বহাল থাকলে তাতে বাংলাদেশি পণ্যের রফতানি আরও জটিল ও বাধাগ্রস্ত হবে। যদিও এতে ভারতীয় আমদানিকারকরাও ক্ষতির মুখে পড়বেন বলে তারা কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলছেন, বিষয়টি নিতান্তই অর্থনৈতিক নয়, বরং এতে দুই দেশের সম্পর্কের টানাপোড়েনের প্রতিফলন ঘটেছে। ফলে এ সংকটের সমাধান রাজনৈতিকভাবেই করতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।
প্রসঙ্গত, গত বছর অগাস্টে বাংলাদেশে আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই দুই দেশের সম্পর্কে সংকট তৈরি হয়েছে। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন ভারতে অবস্থান করছেন।
ভারতের নতুন বিধিনিষেধে কী আছে
ভারতের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফরেন ট্রেড (ডিজিএফটি) শনিবার যে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে তাতে বলা হয়েছে, কোনো স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ থেকে কোনো ধরনের পোশাক পণ্য ভারতে ঢুকতে পারবে না।
এছাড়া এই আদেশে ফল, ফলের-স্বাদযুক্ত পানীয় ও কার্বোনেটেড ড্রিংকস; বেকারি, চিপস, স্ল্যাকস এবং কনফেকশনারিতে তৈরি প্রক্রিয়াজাত খাবার; তুলা ও সুতার ঝুট; পিভিসিসহ বিভিন্ন প্লাস্টিক পণ্য এবং কাঠের তৈরি আসবাবপত্র আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, মিজোরাম এবং পশ্চিমবঙ্গের চেংড়াবান্ধা ও ফুলবাড়ী দিয়ে ভারতের আমদানি বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
তবে মাছ, এলপিজি, ভোজ্যতেল ও পাথর আমদানি বহাল রেখেছে দেশটি। সেই সাথে ভারতের ওপর দিয়ে ভুটান ও নেপালে বাংলাদেশি পণ্যের রফতানিও অব্যাহত থাকার কথা জানিয়েছে তারা।
তাছাড়া তৈরি পোশাক এখন থেকে কেবল কলকাতা ও মুম্বাইয়ের নভসেবা সমুদ্রবন্দর দিয়ে ভারতে প্রবেশ করতে পারবে।
এর আগে গত মাসেই বাংলাদেশ স্থলবন্দর দিয়ে ভারতীয় সুতা আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলো।
ব্যবসায় কেমন প্রভাব পড়বে
বাংলাদেশ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভারতে প্রায় ১৫৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে পোশাক, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যই বেশি। পাশাপাশি ছিলো বিভিন্ন কোম্পানির প্লাস্টিক পণ্য ও আসবাব সামগ্রী।
আবার আমদানির বিষয়টি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারত থেকে আমদানি করেছে ৯০০ কোটি ডলারের পণ্য।
অন্যদিকে গত বছর বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৩৮ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করা হয়েছে। এর মধ্যে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি পণ্য রপ্তানি হয়েছে ভারতের বন্দর ব্যবহার করে, যা ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধার আওতায় পেয়েছিলো বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা বিশেষ করে পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানি বাড়ছিলো।
এছাড়া সেভেন সিস্টার্স হিসেবে পরিচিত উত্তরপূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোতেও বাংলাদেশি পণ্যের বাজার সম্প্রসারিত হয়েছে। এই রাজ্যগুলোকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন কোম্পানি নতুন নতুন বিনিয়োগের পরিকল্পনাও করছিলেন।
এখন ভারতের নতুন বিধিনিষেধে এর দুটিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে ধারণা করছেন ব্যবসায়ীদের অনেকে। কারণ তৈরি পোশাক স্থল বন্দরের পরিবর্তে সমুদ্র বন্দর দিয়ে পাঠাতে হলে খরচ ও সময় দুটি বেশি লাগবে।
তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ'র সাবেক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ফয়সাল সামাদ অবশ্য বলছেন ভারতের এ সিদ্ধান্তে উভয় দেশের জন্যই ক্ষতির কারণ হবে।
"স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য পাঠালে আমাদের খরচ ও সময় কম লাগে। সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে পণ্য পাঠালে ব্যয় বাড়বে, আবার সময়ও অনেক বেশি লাগবে। কিন্তু এতে যে শুধু আমাদের ক্ষতি হবে তা নয়, ভারতীয় আমদানিকারকদেরও তো খরচ বাড়বে," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ থেকে এখন প্রায় ৭০ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি হয় ভারতে, যা প্রতিবছরই বাড়ছিলো।
মি. সামাদ বলছেন এর বড় অংশই স্থলবন্দর ব্যবহার করে রফতানি হচ্ছিলো, যার ফলে দুই পক্ষই লাভবান হচ্ছিলো।
ওদিকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন আজ ঢাকায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছেন, নতুন বিধিনিষেধের বিষয়টি ভারত এখনো বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি।
তবে তার দাবি ভারতই বাংলাদেশে বেশি রফতানি করে বলে স্থলবন্দর কেন্দ্রিক বিধিনিষেধে বাংলাদেশের চেয়ে ভারতীয় ব্যবসায়ীরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অবশ্য আলোচনার মাধ্যমে সমস্যাটির সমাধান করা সম্ভব বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
তবে ভারতীয় রপ্তানিকারকদের ওপর কোনো বিধিনিষেধ না থাকায় তারা কীভাবে প্রভাবিত হবে, তা পরিষ্কার নয়।
অন্যদিকে একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভারতের সবচেয়ে বেশি পণ্য রফতানি করে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। ভারতে তাদের রফতানির পরিমাণ বছরে ৫০ মিলিয়ন ডলারের বেশি।
প্রতিষ্ঠানটি ভারত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে বেশি পণ্য রফতানি করে। তাদের পণ্যের মধ্যে খাদ্য, কনফেকশনারি ও প্লাস্টিক সামগ্রীর বড় বাজার হলো ভারতের ওই এলাকা।
প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ভারতের বিধিনিষেধ কার্যকর হলে বা বহাল থাকলে তাতে তাদের পণ্য রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
"যে সাতটি বন্দর আমরা ব্যবহার করি রফতানির জন্য, তার পাঁচটাই এই বিধিনিষেধের আওতায় পড়েছে। উত্তর পূর্ব ভারত আমাদের বড় বাজার। এই বিধিনিষেধ সেখানে বড় প্রভাব ফেলবে," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের শিক্ষক ড. মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম বলছেন, ভারতে বাংলাদেশের রফতানির পরিমাণ বেশি নয় এটি সত্যি, কিন্তু বাংলাদেশের মোট রফতানির অনুপাতে সেটি আবার একেবারে কমও নয়।
"ফলে ভারতের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের বাণিজ্যে প্রভাব ফেলবে। কারণ আমাদের বাজার ও পণ্য বৈচিত্র্য কম। ভারতে যেসব পণ্য রফতানি হয় তার অধিকাংশই উন্নত দেশে রফতানি সম্ভব হবে না। আবার সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে পণ্য পাঠাতে খরচ অনেক বেড়ে যাবে রফতানিকারকদের," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
এছাড়া একটি রফতানি বাজার নিয়ে কোন সংকট তৈরি হলে তা থেকে উত্তরণের কোন পূর্ব পরিকল্পনাও বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে দেখা যায় না। এ কারণেই ভারতের রফতানি যেটুকু আছে সেটুকু বাধাগ্রস্ত হলে উত্তরণ বা বিকল্প কী হবে তা কারও জানা নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি।
দুই দেশের সম্পর্কের প্রতিফলন?
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলছেন, ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের যে টানাপোড়েন আছে বিগত সরকারকে কেন্দ্র করে, এটিকে (নতুন বিধিনিষেধ) তার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, সম্প্রতি ব্যাংককে নরেন্দ্র মোদী ও অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকের পরেও এ ধরনের সিদ্ধান্ত তাকে বিস্মিত করেছে।
"এ ধরনের পদক্ষেপ এমনি এমনি হয় না। এটা (সম্পর্ক) যে ক্রমবর্ধমানভাবে জটিল ও অনুপযোগী হয়ে উঠছে চিন্তার বিষয়। এ থেকে উত্তরণের জন্য রাজনৈতিক প্রচেষ্টা লাগবে। অভিন্ন স্বার্থ ও পারস্পারিক শ্রদ্ধার নিরিখে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক যে নতুন ভিতের ওপর নবায়ন হবে সেই পদক্ষেপ নেয়া দরকার," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
তার মতে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কালে সীমান্ত কেন্দ্রিক বাণিজ্য যে চাপের মুখে পড়েছে সেটা এখন পুরোপুরি দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।