News update
  • UN Warns Nearly 900 m Poor Face Climate Peril     |     
  • Global Finance Leaders Eye Gaza’s $70b Reconstruction Plan     |     
  • Over 1 million tickets sold for 2026 World Cup in North America: FIFA     |     
  • Daily struggles persist in Gaza even as ceasefire offers some respite     |     

শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষা মায়ের দুধের বিকল্প নেই

মতামত 2022-08-13, 9:38pm

Breast-feeding



সেলিনা আক্তার

একটি সুস্থ জাতি গঠনে মায়ের সুস্বাস্থ্যের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, একজন সুস্থ মা-ই পারেন একজন সুস্থ শিশুর জন্মদান করতে। জন্মের পর নবজাতকের সুস্থতা ও বিকাশের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় এবং অত্যাবশ্যক শিশুখাদ্য হচ্ছে মায়ের দুধ।সন্তানের জন্য মায়ের দুধের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত তখনই হয়, যখন মা নিজে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হন। 

প্রতিবছর বিশ্বের ১৭০টি দেশে ১ থেকে ৭ আগস্ট বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ পালন করা হয়। শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর উৎসাহ দিতে এবং শিশুদের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতে এই কর্মসূচি। বুকের দুধ খাওয়ানোয় জোর দিতে ১৯৯০ সালের আগস্ট মাসে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও ইউনিসেফের যৌথ ঘোষণাকে সফল করতেই এই কর্মসূচি। ১৯৮১ সালের মে মাসে বিশ্বস্বাস্থ্য সম্মেলনে ইন্টারন্যাশনাল কোড অব ব্রেস্ট সাবস্টিটিউট অনুমোদিত হয়।

এর পর থেকে মায়ের দুধের প্রতি প্রাধান্য বা গুরুত্ব বাড়ানোর লক্ষ্যে এর বিকল্প পণ্যের প্রচার বন্ধে রেডিও-টেলিভিশন, সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা শুরু হয়।  বাংলাদেশে ১৯৯২ সাল থেকে প্রতিবছর ১ থেকে ৭ আগস্ট বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে জাতীয়ভাবে এই সপ্তাহ পালিত হয়।

২০২২ সালে বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহের মূলমন্ত্র হলো ‘স্টেপ আপ ফর ব্রেস্ট ফিডিং: এডুকেট অ্যান্ড সাপোর্ট’। প্রকৃতপক্ষে, উপযুক্ত শিক্ষা ও সহযোগিতার মাধ্যমেই শিশুর স্তন্যপানকে এগিয়ে নিতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে। ২০০৯ সালে বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী, ২০১০ সাল থেকে আমাদের দেশে প্রতিবছর ‘বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ’ পালিত হয়ে আসছে। এতে নিয়োজিত রয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের জাতীয় পুষ্টি সেবা বিভাগ। নবজাতক ও শিশুদের শারীরিক সংকট থেকে মুক্ত করে তাদের বাঁচিয়ে তোলা এবং তাদের স্বাস্থ্য ও শরীরের উন্নতির জন্য মায়ের দুধের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিতেই এই কর্মসূচি।

একটি পরিবারের আনন্দের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে শিশু। তাই সুস্থভাবে বেড়ে ওঠা নিশ্চিত করতে সঠিক পরিচর্যার পাশাপাশি শিশুর সুষম খাদ্যগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। জন্মের পর থেকে ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শিশুর প্রধান এবং একমাত্র খাবার হলো মায়ের দুধ। শুধু বুকের দুধ পান করানোর মাধ্যমে বছরে আট লাখের বেশি ছয় মাসের কম বয়সি শিশুর জীবন রক্ষা করা সম্ভব।

শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি লক্ষণীয়। মাতৃদুগ্ধ পানে সারা বিশ্বে ৯৮টি দেশের মধ্যে শীর্ষস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে ‘সবুজ’রঙের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। ছয় মাসের কম বয়সি শিশুদের শুধু মায়ের দুধ খাওয়ানোর হার ৬৪ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। সবার সচেতনতায় এ সাফল্য অর্জিত হয়েছে। মাতৃমৃত্যু হার হ্রাসের পর এটি একটি নতুন সাফল্য। মাতৃমৃত্যু হার প্রতি লাখে ১৪৩-এ নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। ওয়ার্ল্ড ব্রেস্ট ফিডিং ট্রেন্ডস ইনিশিয়েটিভ (ডব্লিউবিএফটিআই) ও বাংলাদেশ ব্রেস্ট ফিডিং ফাউন্ডেশনের তথ্যে দেখা যায়, শিশুর জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে মায়ের দুধ খাওয়ালে মৃত্যুঝুঁকি ৩১ শতাংশ হ্রাস করা যায়। এ ছাড়া ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শুধু মায়ের দুধ পান করালে শিশুর মৃত্যুঝুঁকি হ্রাস পায় আরও ১৩ শতাংশ।

প্রতিটি মায়ের জন্য সন্তান জন্মদান একটি বিশেষ মুহূর্ত। মায়ের জন্য সবচেয়ে মানসিক প্রশান্তির মুহূর্তটিও হলো যখন তিনি সন্তানকে বুকের দুধ পান করান। এর মধ্য দিয়ে মা ও শিশুর মধ্যে একটি শক্তিশালী বন্ধন তৈরি হয়। যদিও এখনও কিছু মা শিশুদের বুকের দুধ খাওয়ানোর বিষয়ে অনাগ্রহ দেখান। জন্মের পর থেকে শিশুকে ফিডার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলেন। এটা শিশুর জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। জন্মের পর থেকে যেসব শিশু বিকল্প দুধ পান করেছে, মাতৃদুগ্ধ পানকারী শিশুর তুলনায় তাদের ডায়রিয়ার আক্রান্তের হার ২৫ গুণ বেশি এবং শ্বাসতন্ত্রের ইনফেকশনে মৃত্যুর আশঙ্কা চারগুণ বেশি। অন্য এক জরিপে দেখা গেছে, মাত্র ৪৩ শতাংশ নবজাতক জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে মায়ের দুধ পান করে এবং ৪১ শতাংশ শিশুকে পূর্ণ ৬ মাস বয়স পর্যন্ত শুধু মায়ের দুধ পান করানো হয়। বাংলাদেশে এই হার বর্তমানে যথাক্রমে ৬৯ শতাংশ এবং ৬৫ শতাংশ।

শিশুকে ২৪ মাস বয়স পর্যন্ত মায়ের দুধ পান করানোর হার এখন ৮৭%। যদিও ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী শিশুর পূর্ণ ৬ মাস বয়স পর্যন্ত শুধু মায়ের দুধ পান করানোর হার ৫০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয়েছে। আর বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই তা অর্জন করেছে । 

সমীক্ষায় দেখা গেছে, সন্তানকে মায়ের দুধ না খাওয়ানোর কারণে শিশুর স্বাস্থ্যগত বিভিন্ন জটিলতায় প্রতিবছর বিশ্বে দুই লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশে এই ক্ষতির পরিমাণ বছরে প্রায় ৫৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা, যা উন্নয়নশীল দেশের বার্ষিক প্রবৃদ্ধিতে (জিডিপি) বড়ো ধরনের নেতিবাচক ভূমিকা রাখছে। পাশাপাশি যেসব শিশু মায়ের দুধ খাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়, তাদের মৃত্যুর ঝুঁকি সাধারণ শিশুর চেয়ে ১৪ শতাংশ বেশি। এসব শিশু ডায়রিয়া, আমাশয়, নিউমোনিয়াসহ বিভিন্ন জটিল রোগে ভোগে। একটি স্বনির্ভর জাতি গঠনে ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে মাতৃদুগ্ধ খাওয়ানোর কোনো বিকল্প নেই।

মাতৃদুগ্ধ শিশুর জন্য একটি সম্পূর্ণ খাবার। এতে শিশুর দেহের উপযোগী উপাদানগুলো যে পরিমাণে থাকে, তাতে ছয় মাস বয়স পর্যন্ত অন্য কোনো খাবার এমনকি পানিরও প্রয়োজন হয় না। মায়ের দুধের সব উপাদান শিশুর দেহে সহজে হজম ও শোষিত হয়। এটি শিশুর মস্তিষ্কের গঠন ও বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। মায়ের বুকের দুধ পানকারী শিশুদের জন্ম-পরবর্তী নানা ধরনের ইনফেকশন হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে; শিশুর শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়। মায়ের দুধে ভিটামিন ‘এ’ থাকায় শিশু অন্ধত্বের শিকার হয় না। এটি শিশুর শরীরে ক্যালসিয়ামের শোষণ বাড়িয়ে দিয়ে হাড়ের গঠন মজবুত করে। বুকের দুধ খাওয়ার ফলে শিশুর মুখমণ্ডলের হাড় ও মাংসপেশি সুগঠিত হয়। মায়ের দুধে রয়েছে বিশেষ ফ্যাটি অ্যাসিড, যা শিশুর বুদ্ধিদীপ্ততা ও চোখের জ্যোতি বাড়ায়। মায়ের দুধ শৈশবে লিউকোমিয়া হওয়া থেকে রক্ষা করে এবং ডায়াবেটিস টাইপ-১ এবং উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার আশঙ্কাও কম থাকে। মায়ের দুধে প্রায় ১০০ ধরনের উপাদান রয়েছে, যার প্রতিটি উপাদানই শিশুর জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। সন্তানকে বুকের দুধ পান করানো মায়ের জন্যও বিশেষ উপকারী। শিশুকে বুকের দুধ পান করালে স্তন ক্যানসার ও জরায়ু ক্যানসারের ঝুঁকি হ্রাস পায়। ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো হলে শতকরা ৯৮ ভাগ ক্ষেত্রে তা জন্মনিয়ন্ত্রণে সহায়ক হয়। বুকের দুধ খাওয়ানোর মধ্য দিয়ে মা ও শিশুর মধ্যে একটি আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে, শিশু অনেক বেশি নিরাপদ বোধ করে।

মায়ের দুধের বিকল্প কোনো দুধের অসুবিধা হলো বিকল্প দুধ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্লাস্টিকের বোতলে খাওয়ানো হয়, প্লাস্টিক স্বাস্থ্যের জন্য হানিকর। বোতলের নিপল ও দুধ তৈরিতে ব্যবহার করা পানির সঙ্গে রোগজীবাণু থাকার আশঙ্কা থাকে, ফলে শিশু ঘন ঘন অসুখে পড়ে। বেশিরভাগ সময়ই তাড়াহুড়োর কারণে বোতল ভালোভাবে পরিষ্কার করা হয় না, শিশু অসুখে আক্রান্ত হয়। টিনজাত দুধ বা গরুর দুধ পান করলে শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক কমে যায়, ফলে ডায়রিয়াসহ অন্যান্য রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। বিকল্প দুধে লৌহজাতীয় পদার্থ (আয়রন) কম থাকায় শিশু রক্তস্বল্পতায় ভোগে। বুকের দুধ অপেক্ষা বিকল্প দুধের পুষ্টি উপাদানগুলো শিশুর শরীরে সহজে শোষিত হয় না। পুষ্টি উপাদানের ঘাটতির ফলে শিশু অপুষ্টির শিকার হয়। গরুর দুধ সহজে হজম না হওয়ায় শিশু কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগে। বিকল্প দুধের বড়ো অসুবিধা হলো এটি ব্যয়বহুল হওয়ায় সঠিক নিয়মে খাওয়াতে হলে মাসে প্রচুর টাকা খরচ হয়। এতে অনেক মা-ই নির্দেশিত নিয়ম অনুযায়ী শিশুকে খাওয়ায় না। ফলে শিশুর পুষ্টির ঘাটতি থেকে যায়। ব্রেস্ট ফিডিংয়ের ক্ষেত্রে সন্তানের সঙ্গে মায়ের যে বন্ধন তৈরি হয়, বিকল্প দুধ খাওয়ালে সে বন্ধন তৈরি হয় না।

বর্তমান সরকার মাতৃ ও শিশুপুষ্টি উন্নয়নকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে গত ১০ বছরে ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে। মাতৃত্বকালীন ছুটি বেতনসহ ছয় মাসে উন্নীতকরণ এবং সরকারি-বেসরকারি অফিসে ব্রেস্টফিডিং কর্নার স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে নিরাপদে মাতৃদুগ্ধ পান করাতে ঢাকা শহরে ২৫টি, বিভাগীয় শহরে ৫টি, জেলা শহরে ১৩টি সহ মোট ৪৩টি ডে-কেয়ার সেন্টার চালু রয়েছে।এছাড়াও গার্মেন্টসে কর্মরত নারীদের সন্তানদের জন্য ঢাকা, চট্টগ্রাম, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর ও নারায়নগঞ্জের প্রতিটিতে ৩০ আসন বিশিষ্ট ১৫টি ডে কেয়ার সেন্টার চালু রয়েছে। হত দরিদ্র গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকালী মায়েদের ভাতা ৫০০/- টাকার স্থলে ৮০০/- টাকা করা হয়েছে। মাতৃত্বকালীন ভাতার মেয়াদ ২ বছর থেকে বাড়িয়ে ৩ বছর করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্রেস্টফিডিং ফাউন্ডেশনকে শক্তিশালী করারও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মাধ্যমে মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। প্রতি জেলায় একজন করে পুষ্টিবিদ নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। পরে প্রতিটি হাসপাতালে একজন করে পুষ্টিবিদ নিয়োগ দেওয়া হবে। এরই মধ্যে ৫৯৪টি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে শিশুবান্ধব হাসপাতাল করার জন্য প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করা হয়েছে।

মাতৃদুগ্ধ পান নিশ্চিত করার সাফল্যের ক্ষেত্রে পরিবারের সব সদস্যের শিক্ষা ও সহযোগিতার কোনো বিকল্প নেই। প্রসূতি মাসহ স্বামী ও আত্মীয়স্বজনদের স্তন্যপানের উপকারিতার শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে। পাশাপাশি প্রসূতি মা যাতে নির্বিঘ্নে শিশুকে স্তন্যদান করাতে পারেন, সে ব্যাপারে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। তাহলেই নবজাতকের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা সম্ভব হবে এবং আমরা একটি মেধাবী ও সক্ষম জাতি দেশকে উপহার দিতে পারব।

পিআইডি ফিচার