দায়িত্ব নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যাদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ অর্থনীতির বহুমাত্রিক সমস্যা থেকে দেশের অবস্থার উন্নতি ঘটিয়ে স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে আসা বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
অর্থনীতি বিশ্লেষকদের মতে, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের দুই বছর আগে থেকেই দেশের অর্থনীতি ছিল নানাবিধ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। অভ্যন্তরীণ সমস্যা থেকে শুরু করে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট কোনোটাই বাংলাদেশের অনুকূলে ছিল না। এ অবস্থায় পুরো অর্থ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর দিকে জোর দিয়েছেন তারা।
দেশে চলমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে নতুন সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ল’ অ্যান্ড অর্ডার কায়েম করা উল্লেখ করে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন সময় সংবাদকে বলেন, দেশের অর্থনীতিকে আবারও চাঙা করতে চাইলে সবার আগে আইনশৃঙ্খলা ঠিক করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কার্যকর করে ল’ অ্যান্ড অর্ডার কায়েম করার মাধ্যমে থেমে থাকা অর্থনীতিকে সচল করতে হবে।
মানুষের মাঝে নিরাপত্তাহীনতা কাজ করলে অর্থনীতির গতি আরও মন্থর হয়ে যাবে। বিশেষ করে নিরাপত্তার অভাবে দেশের বেশিরভাগ ব্যাংক এবং এটিএম বুথে লেনদেন এখনও আগের মতো চাঙা হয়ে ওঠেনি। ব্যাংক বা বুথ থেকে টাকা তুলে মানুষ ঘরে ফিরতে নিরাপদ বোধ করছেন না। অর্থনীতির একদম শুরুর দিকেই এই যে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়েছে এটি দূর করা সবচেয়ে জরুরি বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের সাবেক এ কর্মকর্তা।
এর বাইরে দেশে আগে থেকে চলে আসা অর্থনৈতিক সমস্যার প্রসঙ্গ টেনে জাহিদ হোসেন বলেন, আন্দোলনের আগে থেকেই দেশের অর্থনীতি নাজুক অবস্থায় ছিল। বিশেষ করে ভুল পরিসংখ্যান প্রকাশ করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে। রফতানি আয়ে পরিসংখ্যানের সঙ্গে অর্জিত অর্থের ফারাক ১৪ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) যে মূল্যস্ফীতির হিসাব দেয় সেখানে বড় রকমের গোঁজামিল আছে।
বাজারে গেলে পণ্যের দাম দেখে বোঝা যায়, দেশে মূল্যস্ফীতির পরিমাণ ১৫-২০ শতাংশ। কিন্তু পরিসংখ্যানে ৯-১০ শতাংশের বেশি দেখা যায় না। আবার রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রেও একই রকমের গোঁজামিল। গত অর্থবছরে সিএনএইচের ডেটার সঙ্গে রাজস্ব বিভাগের পরিসংখ্যানে অর্থের ফাঁরাক ৯৫ হাজার কোটি টাকা। এই লক্ষ কোটি টাকার গোঁজামিল দেয়া পরিসংখ্যানকে ঠিক করতে হবে। নাহলে দেশের অর্থনীতির বর্তমান চিত্র কী সেটা নিরূপণ করা সম্ভব হবে না বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ।
নতুন সরকার দায়িত্ব নিলে বাজারে মূল্যস্ফীতি নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে উল্লেখ করে জাহিদ হোসেন বলেন, সরবরাহ ব্যবস্থা এখনও ঝুঁকির মুখে আছে। পণ্য নিয়ে ট্রাক বা অন্য পরিবহনগুলো স্বাভাবিক সময়ের মতো চলাচল করতে পারছে না। এই সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক করতে না পারলে বাজার আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে।
এতদিন সিন্ডিকেটের যে দাপটের কথা শোনা গেছে, যারা রাজনৈতিক পরিচয়কে পুঁজি করে নিজেদের পকেট ভারী করেছে সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে তারা অনেকটা দুর্বল হয়ে গেছে। বাজারে যারা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম নিয়ন্ত্রণ করে তারা যাতে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে, সে দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে বলে জানান তিনি।
জাহিদ বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে খাদ্য মূল্যস্ফীতি সবার আগে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। টিভি-ফ্রিজের দাম বেড়ে গেলে স্বল্প আয়ের মানুষ যতটা-না ঝামেলায় পড়ে তার চেয়ে বেশি ঝামেলায় পড়ে চাল, ডাল, লবণ, চিনির দাম বেড়ে গেলে। খাবারের দাম জোগাতে গিয়ে তারা অন্যান্য মৌলিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক যে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করেছিল, সেটি খাতা-কলমেই রয়ে গেছে। নানা ধাপ্পাবাজি ও দুর্নীতির কারণে নতুন এ নীতি আলোর মুখ দেখতে পারছে না। এটিকে কার্যকর করা গেলে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে।
এর বাইরে আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু প্রতিষ্ঠানকে অগ্রাধিকার দেয়া হতো। তাদের একচেটিয়া বাজারের কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গিয়েছে। এখানে লাগাম টেনে ধরতে হবে। দেশে যেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠান আছে তাদের বর্তমান অবস্থা বুঝতে ব্যালেন্স শিটগুলো যাচাই-বাছাই করতে হবে। সব মিলিয়ে বড় একটি সংস্কারের মধ্য দিয়ে যেতে পারলে দেশের অর্থনীতি আবারও ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন জাহিদ হোসেন।
অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, বাজার ব্যবস্থা এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংস্কারের পাশাপাশি দেশের ব্যাংকিং খাতে বড় রকমের সংস্কারের প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) গবেষণা পরিচালক মাহফুজ কবির সময় সংবাদকে বলেন, সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ব্যাংক খাতকে ঢেলে সাজানো। বিগত কয়েক দশকে ব্যাংক খাতে যেসব অনিয়ম দেখা দিয়েছে সেগুলো দূর করে ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে না পারলে দেশের অর্থনীতি ভবিষ্যতে আরও খারাপ হবে।
খেলাপি ঋণের প্রসঙ্গ তুলে মাহফুজ কবির বলেন, দেশে বর্তমান খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকার উপরে। এই ঋণ আদায়ের আশা একরকমের ত্যাগ করেছিল বিগত সরকার। কিন্তু এসব ঋণ উদ্ধার করার দিকে জোর দিতে হবে এখন থেকে।
আদৌ খেলাপি ঋণ আদায় করা যাবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে মাহফুজ কবির বলেন, যারা ঋণখেলাপি তারা সবাই তলিতল্পা গুটিয়ে দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন এমন না। এখনও অনেক বড় বড় খেলাপি শিল্পপতি আছেন চাইলে যাদের চাপ দিয়ে ঋণ আদায় করা সম্ভব। পুরো খেলাপি আদায় করা না গেলেও যদি অর্ধেকও আদায় করা যায় সেটিও দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক।
খেলাপি ঋণের পাশাপাশি অনেক প্রশ্নবিদ্ধ ঋণ ছাড় করা হয়েছে। অনেক ঋণ পাইপলাইনে আছে। চটদজলদি হাতছাড়া হয়ে যাওয়া বা যাওয়ার পথে এসব টাকা ফেরাতে নতুন সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে বলে জানান এ অর্থনীতিবিদ।
শেখ হাসিনার পদত্যাগের পরদিন থেকেই ব্যাংকগুলোতে এক রকমের অস্থিরতা দেখা গেছে। বড় কর্মকর্তারা তাদের পদ ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেকে আবার এসব পদে যেতে রাজনৈতিক প্রভাব খাটাচ্ছেন। ব্যাংক খাতে রাজনীতিকরণের পরিণাম প্রসঙ্গে মাহফুজ বলেন, কোনোভাবেই আর এ খাতে রাজনীতিকরণ বা মেরুকরণের সুযোগ দেয়া যাবে না। ব্যাংকের ভেতর রাজনীতি ঢুকলে অর্থনীতি আরও মুখ থুবড়ে পড়বে। তখন আর কিছুই সামাল দেয়া যাবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিকাঠামোতে পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে এ গবেষক বলেন, পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান যেসব রীতিনীতি আছে সেগুলোতে পরিবর্তন আনতে হবে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, একসময়ের নামজাদা ন্যাশনাল ব্যাংক পরিবারতন্ত্রের কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে। আবার এক শিল্পগোষ্ঠীর হাতে পড়ে শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলোর নাজেহাল অবস্থা। গোষ্ঠীভিত্তিক এই যে ক্ষমতা ধরে রাখার প্রবণতা, এটি থেকে ব্যাংক খাতকে উদ্ধার করতে হবে।
শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলো নিয়ে নতুন সরকারের নীতি কেমন হওয়া উচিত, সে প্রসঙ্গে মাহফুজ বলেন, আগে দেখতে হবে ব্যাংকগুলোর বর্তমান অবস্থা কী। কী ধরনের সহায়তা করলে ব্যাংকগুলো আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে, সেটি বিবেচনায় নিয়ে এগোতে হবে। হুটহাট কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না। আবার টাকা ধার দিয়ে ব্যাংক টিকিয়ে রাখার নীতিও নেয়া যাবে না। শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলোকে শুধু বিপদ থেকে রক্ষা করলে হবে না নেতিবাচক প্রভাব খাটানো থেকেও রক্ষা করতে হবে।
শেয়ারবাজার দুদিনে ঘুরে দাঁড়ালেও ব্যাংকের ঘুরে দাঁড়াতে সময় লাগবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ব্যাংকিং ব্যবস্থা পুরোটা দাঁড়িয়ে আছে সুশাসনের ওপরে। ব্যাংক যদি নিজেই অর্থ পাচারে জড়িত থাকে, তাহলে সেখান থেকে সুশাসন আশা করা যায় না। যেসব অর্থ পাচার হচ্ছে এবং যেসব ঋণ খেলাপি আছে সেগুলো ফিরিয়ে আনতে পারলে ব্যাংকের সুদের হার কমে আসবে। এতে অর্থনীতির ওপর চাপও কমবে বলে মনে করেন তিনি।
কোটা আন্দোলন থেকে সরকার পতনের প্রায় এক মাস ধরে চলা আন্দোলনে ব্যবসা খাত বড় রকমের ক্ষতির মুখে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে আপাতত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের জন্য কোনো প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হবে না। এ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে মাহফুজ বলেন, এ সিদ্ধান্তটি বর্তমান পরিস্থিতিতে ঠিক না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের জন্য একটি সফট ফান্ডের ব্যবস্থা করা। তাহলে ব্যবসায়ীরা ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবেন। আর সফট ফান্ড না থাকলে ব্যাংকেরই লোকসান। আমানতকারীদের টাকা কমে যাবে ব্যাংক থেকে। ব্যাংকের নিজে সচল থাকার জন্য ব্যবসায়ীদের সাহায্য করা উচিত।
পুরো ব্যাংকিং খাতকে ঢেলে সাজাতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ কেমন হওয়া উচিত এমন প্রশ্নের জবাবে মাহফুজ কবির বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ খুব বেশি বা খুব কম কোনোটাই হওয়া উচিত নয়। এটা বোঝা জরুরি রাজনৈতিক দলগুলোর তৃণমূল পর্যায়ে যে সংগঠিত অবস্থা আছে, তা সুশীল সমাজের সরকারের থাকবে না। তারা বেশিদিন ক্ষমতায় থাকলে তখন বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। আবার কয়েক মাস যদি ক্ষমতায় থাকে তাহলে এসব ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেয়ার উপায় থাকবে না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ চেক অ্যান্ড ব্যালান্সের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা উচিত। সময় সংবাদ