চলমান শ্রমিক আন্দোলন মোকাবিলা এবং অন্তর্বর্তী সরকারকে পোশাক খাতের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বোঝাতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বলে অভিযোগ ওঠেছে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) পরিচালনা বোর্ডের বিরুদ্ধে।
অভিযোগে আরও বলা হয়, এ শিল্পকে ধ্বংস করতে একটি গোষ্ঠী কলকাঠি নাড়ছে, বিদেশি ক্রেতারা অর্ডার কমিয়ে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। তারপরও সরকারের কাছে তারা শিল্পের বাস্তব অবস্থা তুলে ধরছে না এবং বিদেশি ক্রেতাদের আস্থায় আনতে উদ্যোগ গ্রহণ করছে না।
শনিবার (৫ অক্টোবর) রাজধানীর কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবে সংগঠনটির নির্বাচনে অংশ নেয়া একটি গ্রুপ ফোরাম আয়োজিত এক সভায় সাধারণ গার্মেন্টস মালিকরা এসব অভিযোগ করেন।
পোশাক শিল্পের চলমান অস্থিরতা নিরসনে করণীয় খুঁজতে ফোরাম এ সভার আয়োজন করে। এতে ফোরাম সাধারণ সম্পাদক এবং নেক্সাস গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুর রশিদ হোসাইনী বলেন, ‘পোশাক শিল্পে অস্থিরতা আগেও ছিল; তবে তা কখনই এতো দীর্ঘায়িত হয়নি। এর পেছনে কাদের ইন্ধন থাকতে পারে। এরা শ্রমিক অসন্তোষের নামে দেশের অর্থনীতিকে ধূলিস্মাৎ করতে চায়।
‘গার্মেন্টস করে অনেকে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করেনি, বিদেশে টাকা পাচার করেছে। এদের কারণে বেকায়দায় থাকেন সত্যিকারের মালিকরা। এখন গোয়েন্দা সংস্থা পাসপোর্টের তথ্য চাচ্ছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে -- এটাই কি গার্মেন্টস মালিকদের অপরাধ। বিজিএমইএ বোর্ড সরকারকে গার্মেন্টস শিল্পের প্রকৃত অবস্থা বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে।’
ডুকাটি ফ্যাশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খায়ের মিয়া বলেন, ‘গত নভেম্বরে বেতন বাড়ানোর পর শ্রমিকদের পক্ষ থেকে এখন আবার বেতন বাড়ানোর দাবি জানানো হয়েছে। ১০ টাকা বেতন বাড়ানোর সক্ষমতা নেই অনেক মালিকের। বর্তমান বিজিএমইএ বোর্ড শ্রমিক অসন্তোষ মোকাবিলায় ভূমিকা রাখতে পারছে না। তাদের সেই যোগ্যতা নেই। কারণ জোর করে, ভোট কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে।’
সীমা ফ্যাশনের প্রোপ্রাইটর আবুল হোসেন বলেন, ‘সরকারের উপদেষ্টাদের গার্মেন্টস সম্পর্কে জ্ঞান নাও থাকতে পারে। এ অবস্থায় বিজিএমইএ বোর্ডও সরকারের কাছে সেক্টরের সমস্যা তুলে ধরতে পারছে না। তারা বোধ হয়, শুধু নিজেদের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। আশুলিয়া এলাকায় আগস্টের বেতন ব্যাংক থেকে ১৫ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে দিতে হয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসে অনেক কারখানায় একদিনও কাজ হয়নি। সেসব কারখানা বেতন দেবে কীভাবে। সেই ক্ষমতা কারও আছে বলে মনে হয় না।’
চলমান সংকট মোকাবিলায় বিজিএমইএ বোর্ডকে ৪টি পরামর্শ দিয়ে সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি ফয়সাল সামাদ বলেন, ‘আশুলিয়া এলাকায় ২৫-৩০টি কারখানা এখনো বন্ধ আছে। একটি টাস্কফোর্স গঠন করে সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। আশুলিয়ায় রেসকিউ (উদ্ধার) প্যাকেজ ঘোষণা করা যেতে পারে। এর আওতায় গার্মেন্টস মালিকদের জন্য ব্যাংকঋণসহ যাবতীয় সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেয়া উচিত।’
তৈরি পোশাক খাতের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি নিয়ে গবেষণা হতে পারে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, বিজিএমইএ সদস্যদের কারখানার সক্ষমতার ভিত্তিতে ক্যাটাগরি করে পৃথক পলিসি প্রণয়ন করা যেতে পারে। এখনই উপযুক্ত পদক্ষেপ নিয়ে না পারলে শ্রীলঙ্কা থেকে তামিল বিদ্রোহীদের কারণে নব্বইয়ের দশকে যেভাবে গার্মেন্টস শিল্প বাংলাদেশে এসেছিল, সেভাবে বাংলাদেশ থেকে এ ব্যবসা অন্য দেশে চলে যেতে পারে।
রাইজিং গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, ‘এ মুহূর্তে আশুলিয়ায় যা হচ্ছে, সেটা শ্রম আইন বিষয়ক সমস্যা না; এটা আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা। সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দেয়া হলেও তা ব্যবহার হচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন না বা করতে পারছেন না। আইন ভঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা গেলে এতোদিনে এ সমস্যার সমাধান হয়ে যেত।’
তিনি আরও বলেন, শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নিয়ে সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে অনেক কথা বলা হয়। কিন্তু গার্মেন্টসই একমাত্র খাত যেখানে অদক্ষ শ্রমিকদের ওভারটাইমসহ বেতন ১৫ হাজার টাকা পড়ে।
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ড. রুবানা হক বলেন, ‘সরকার চায় গার্মেন্টস মালিকরা শান্তিতে ব্যবসা করুক। প্রধান উপদেষ্টা পোশাক খাত নিয়ে ভীষণ বিচলিত। তিনি এর সমাধান খুঁজছেন। কিন্তু সরকারের সঙ্গে দর কষাকষি বা নিজেদের দাবি আদায় করার মতো মুখ খুঁজে পাচ্ছি না।’
চলমান পরিস্থিতিতে বায়ারদের আস্থায় আনা ভীষণ জরুরি জানিয়ে রুবানা হক আরও বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা বিদেশি বায়ারদের সঙ্গেও আলোচনায় বসতে রাজি আছেন। ওনার মতো বিশ্ববরেণ্য মানুষকে ব্যবহার করতে না পারলে সেটা আমাদেেই (বিজিএমইএ) ব্যর্থতা। এছাড়া, এক্সিট পলিসি নিয়ে কাজ করারও এখন উপযুক্ত সময়।’ সময় সংবাদ