থাইল্যান্ডে বঙ্গোপসাগরীয় দেশগুলোর আঞ্চলিক সহযোগিতা জোটের (বিমসটেক) শীর্ষ সম্মেলনে ফাঁকে সাইড লাইনে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
গত শুক্রবার (৪ এপ্রিল) দুই সরকার প্রধান প্রায় ঘণ্টাখানেক বৈঠক করেন। বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রতিবেশী দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে অধ্যাপক ইউনূসের এটাই প্রথম বৈঠক। তবে সেই বৈঠক শেষে দুই দেশের সরকার দুই রকম তথ্য পেশ করছে, যা থেকে মনে হতে পারে তারা আলাদা দুটো বৈঠকের কথা বলছেন!
বৈঠক হওয়া নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকলেও শেষ পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদিকে বৈঠকে বসাতে রাজি করানো গেছে এবং বাংলাদেশের ইস্যুগুলো সরাসরি তার সামনে তুলে ধরা গেছে, এটাকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ইউনূস সরকারের একটি বড় কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবেই তুলে ধরা হচ্ছে।
অন্যদিকে ভারত এতদিন বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে হিন্দুদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হওয়ার লাগাতার অভিযোগ করে আসছিল। কিন্তু তাদের (বাংলাদেশ সরকার) সঙ্গেই প্রধানমন্ত্রী মোদি কেন বিদেশের মাটিতে গিয়ে দেখা করলেন, দিল্লিকে এখন দেশের ভেতরেও সেই ব্যাখ্যা দিতে হচ্ছে।
দিল্লিতে প্রবীণ কূটনৈতিক পর্যবেক্ষক সুকল্যাণ গোস্বামী বিবিসিকে বলেন, সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে বৈঠকে সত্যিকারের আলোচনা যেটাকে বলে সেটা কমই হয়েছে – দু’পক্ষ যার যা বলার সেগুলো শুধু উত্থাপন করেছেন, এবং যার জন্য যেটা অস্বস্তিকর তারা সেটা পাশ কাটিয়ে গেছেন!
তিনি বলেন, আমি মনে করি দিল্লি ও ঢাকা দু’পক্ষের জন্যই এটা ছিল প্রধানত চেকবক্সে টিক দেওয়ার এক্সারসাইজ ... এটা তুলেছি, ওটা বলেছি – ব্যাস।
সুকল্যাণ গোস্বামীআরও বলেন, দুই প্রতিবেশী দেশের নেতার মুখোমুখি দেখা হওয়ার একটা আলাদা গুরুত্ব থাকেই, সেই অপটিক্সটা অবশ্য ছিলই। ফলে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে এরকম ব্যতিক্রমী বৈঠক যে বহু বছর হয়নি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
বৈঠক নিয়ে ভারতের সিদ্ধান্ত ঝুলিয়ে রাখা
ভারত যে এই বৈঠকে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে দ্বিধায় ভুগছিল এটা কোনো নতুন কথা নয়।
গত কয়েক সপ্তাহে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়ালকে যখন বারবার জিজ্ঞেস করা হয়েছে ব্যাংককে মোদি-ইউনূস বৈঠক হচ্ছে কি না, তিনি প্রতিবারই জানিয়েছেন ‘এ ব্যাপারে কিছু বলা সম্ভব নয় – সিদ্ধান্ত হলে আপনারা জানতে পারবেন।’
এমনকি, গত মাসের শেষ দিকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর পার্লামেন্টারি স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্যদেরও জানিয়েছিলেন বৈঠক হবে কি না, সে ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
বস্তুত শুক্রবার দুপুরে ওই বৈঠক হওয়ার ঠিক আগে পর্যন্ত ভারত একবারের জন্যও নিশ্চিত করেনি যে বৈঠকটি সত্যিই হচ্ছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের তরফ থেকে এই বৈঠক আয়োজনের অনুরোধই শুধু জানানো হয়নি, বৈঠকটি যাতে হতে পারে সে জন্য বারবার তাগাদাও দেওয়া হয়েছে।
বৈঠকের ব্যাপারে ভারত যখন মুখে কুলুপ এঁটে ছিল, তখন শেষ মুহূর্তেও বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে ইঙ্গিত দিয়েছেন বৈঠক হবে বলেই তারা আশাবাদী। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. খলিলুর রহমান বুধবারেও বলেছেন বৈঠক হওয়ার ‘জোরালো সম্ভাবনা’ আছে বলে তারা মনে করছেন।
বৈঠকের ব্যাপারে প্রথম ‘অফিশিয়াল কনফার্মেশন’ও এসেছে বাংলাদেশ সরকারের দিক থেকে – যখন বৃহস্পতিবার রাতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বৈঠকের সময়সূচি পর্যন্ত জানিয়ে নিশ্চিত করেন যে বৈঠক সত্যিই হচ্ছে! অথচ তখনও ভারতের দিক থেকে একটি শব্দও নেই – না ডিনায়াল, না কনফার্মেশন!
এই ঘটনাপ্রবাহ থেকে খুব সহজেই ধারণা করা সম্ভব, যেকোনো কারণেই হোক ভারত দেখাতে চেয়েছে বৈঠকে বসার ব্যাপারে তাদের দিক থেকে বিশেষ গরজ নেই – তাগিদটা বরং বাংলাদেশেরই বেশি।
অন্যদিকে বাংলাদেশও বোঝাতে চেয়েছে বৈঠক হোক, এ ব্যাপারে আগাগোড়াই তাদের সদিচ্ছার কোনো অভাব ছিল না।
দুই নেতার আলোচনার বিষয়বস্তু কী ছিল
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সবসময় বলে থাকে, দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন অন্য কোনো দেশের সর্বোচ্চ নেতার সঙ্গে বৈঠকে বসেন, তাতে আগে থেকে ঠিক করা কোনো ‘সেট এজেন্ডা’ থাকে না– দুই নেতা তাদের ইচ্ছেমতো যেকোনো বিষয় আলোচনার টেবিলে উত্থাপন করতে পারেন।
ব্যাংককের বৈঠকের পর দু’পক্ষের বক্তব্য থেকেও মনে হচ্ছে দুই নেতাই তাদের ইচ্ছেমতো নানা বিষয় তুলেছেন ঠিকই– কিন্তু তার মধ্যে কোনো ‘কমন’ বা অভিন্ন ইস্যু ছিল না!
বাংলাদেশের তরফে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বৈঠকের পরেই জানান, দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সব বিষয়েই দুই নেতার মধ্যে কথা হয়েছে।
তিনি বিশেষ করে এর মধ্যে যে ইস্যুগুলোর কথা উল্লেখ করেন, সেগুলো ছিল—
১) বিচারের জন্য শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ ও ভারতে বসে তার আক্রমণাত্মক বিবৃতি বন্ধ করার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ
২) সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যাকান্ড বন্ধ করার দাবিও তুলে ধরা হয়েছে।
৩) অমীমাংসিত তিস্তা চুক্তি নিয়ে কথা হয়েছে, আর গঙ্গা চুক্তির নবায়ন নিয়েও দুই নেতা আলোচনা করেছেন।
অন্যদিকে বৈঠকের পর ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রিকে যখন জিজ্ঞেস করা হয় ইউনূস-মোদি বৈঠকে কী কী নিয়ে আলোচনা হয়েছে, তখন তিনি তার জবাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু বিষয়ের কথা উল্লেখ করেন। শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ নিয়ে নির্দিষ্ট করে জানতে চাওয়া হলে সেই জবাবও এড়িয়ে যান।
বৈঠকের বেশ কয়েক ঘণ্টা পর নরেন্দ্র মোদি তার এক্স হ্যান্ডল থেকে যে পোস্ট করেন তাতে আবার উল্লেখ ছিল বৈঠকে আলোচিত এই সব বিষয়ের :
১) ভারত আবারও জানিয়েছে তারা সমর্থন করে একটি শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল, ‘ইনক্লুসিভ’ (অন্তর্ভুক্তিমূলক) ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশকে।
২) অবৈধভাবে সীমান্ত পারাপার কীভাবে বন্ধ করা যায় তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
৩) বাংলাদেশের হিন্দু ও অন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ ব্যক্ত করা হয়েছে।
দু’পক্ষের এই দু’রকম বক্তব্য শুনলে মনে হওয়াটা স্বাভাবিক তারা বোধহয় সম্পূর্ণ দু'টো আলাদা বৈঠকের কথা বলছেন!
আর একটা বিষয় লক্ষ্য করার মতো, নরেন্দ্র মোদি নিজে এই বৈঠক শেষ হওয়ার বেশ কয়েক ঘণ্টা পর তা নিয়ে টুইট করেছেন।
অথচ বিমস্টেকের অবকাশে নেপাল, ভুটান, থাইল্যান্ডসহ অন্য যেসব দেশের নেতাদের সঙ্গে তিনি বৈঠক করেছেন সেগুলো সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট করতে কিন্তু একটুকুও দেরি হয়নি।
একই কথা খাটে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়ালের ক্ষেত্রেও বেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর তিনি অবশেষে প্রধানমন্ত্রীর পোস্টটিই রিটুইট করেছেন, অথচ অন্য বৈঠকগুলোর ক্ষেত্রে তার কিন্তু একেবারেই দেরি হয়নি।
মোটের ওপর সব মিলিয়ে এটা মনে করাই যেতে পারে, ভারত খুব সচেতনভাবে মোদি-ইউনূস বৈঠকের গুরুত্বকে ‘ডাউনপ্লে’ করতে চেয়েছে – মানে সোজা কথায় এর গুরুত্ব খাটো করে দেখাতে চেয়েছে। অন্য দিকে বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গী ছিল ঠিক এর বিপরীত।
শফিকুল আলমের ফেসবুক পোস্ট এবং অতঃপর
বৈঠক শেষ হওয়ার প্রায় দেড়দিন পর শনিবার বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম নিজের ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট করেন, যা দিল্লিতেও রীতিমতো আলোড়ন ফেলে দেয়।
ওই পোস্টে শফিকুল আলম যে দাবিগুলো করেন সেগুলো ছিল এরকম—
১) বৈঠকের সময় ড. ইউনূসের কাজের ভূয়সী প্রশংসা করে নরেন্দ্র মোদি বলেন, শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে ভারতের যখন দারুণ সুসম্পর্ক ছিল, ‘তখনও আপনার প্রতি তার অমর্যাদাকর আচরণ আমরা লক্ষ্য করেছি, কিন্তু আপনার প্রতি আমাদের সম্মান ও মর্যাদা অটুট ছিল।’
২) অধ্যাপক ইউনূস যখন শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের ইস্যুটি তোলেন, তখনও (নরেন্দ্র মোদির) ‘রেসপন্স নেতিবাচক ছিল না।
৩) বৈঠকে বেশ কয়েকবার নরেন্দ্র মোদি উল্লেখ করেন, ভারতের সম্পর্ক বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে – কোনোএকটি রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তিবিশেষের সঙ্গে নয়!
পোস্টের কিছুক্ষণের মধ্যেই ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি অতি উচ্চপদস্থ সূত্র দিল্লির কূটনৈতিক সাংবাদিকদের কাছে এর অত্যন্ত কড়া প্রতিক্রিয়া দেন।
শফিকুল আলমের বক্তব্যকে ‘দুরভিসন্ধিমূলক’ ও ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে বর্ণনা করে ওই সূত্রটি পাল্টা দাবি করেন :
১) বাংলাদেশের বিগত সরকারের সম্পর্ক নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদির মুখে যে কথা বসানো হয়েছে, তা একেবারেই ঠিক নয়।
২) (শেখ হাসিনার) প্রত্যর্পণের অনুরোধ নিয়ে প্রেস সচিবের পর্যবেক্ষণের কোনো ভিত্তিই নেই।
৩) প্রধান উপদেষ্টার তোলা নির্দিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী তাকে বলেন এগুলো পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে আলোচনা করাই শ্রেয়।
৪) যেকোনো গণতন্ত্রে বৈধতার ভিত্তি যে নির্বাচন, সে কথাও উল্লেখ করেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হলে সেটা যে প্রধান উপদেষ্টার সুনামকেই নষ্ট করবে, সে কথাও মনে করিয়ে দেন তিনি।
দুই দেশের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের পর দু’পক্ষই নিজেদের মতো করে ‘স্পিন’ দিয়ে বিষয়গুলো তুলে ধরতে চায়, সেটা খুবই স্বাভাবিক।
কিন্তু ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ের কোনো বৈঠককে ঘিরে বিবরণে এতটা ফারাক সম্ভবত বিএনপি বা জেনারেল এরশাদের আমলেও কখনও হয়নি।