বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (ববি) উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই একের পর এক বিতর্কিত নিয়োগ দিয়ে সমালোচিত হচ্ছেন অধ্যাপক শুচিতা শরমিন। একাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেট সভার তোয়াক্কা না করে বিভিন্ন পদ থেকে ডজনখানেক কর্মকর্তাকে সরিয়ে শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই এমন ব্যক্তিদের পদায়নের অভিযোগও উঠেছে তার বিরুদ্ধে। এ ছাড়া মতের মিল না হওয়ায় সিন্ডিকেট থেকে সরিয়ে দিয়েছেন এক অধ্যাপকসহ তিন শিক্ষককে। এসব নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে তীব্র অসন্তোষ ও ক্ষোভ। উপাচার্যের পদত্যাগের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সেই ক্ষোভের বিস্ফোরণ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
লোকপ্রশাসন ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের মোকাব্বেল শেখ বলেন, ‘ফ্যাসিবাদ ও বৈষম্য নির্মূলে জুলাই আন্দোলনে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রণী ভূমিকা পরাজিত ফ্যাসিবাদী অপশক্তি সহ্য করতে পারেনি। ষড়যন্ত্র এখনও চলছে। বারবার দাবি জানানোর পরও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি দপ্তরে এখনও ফ্যাসিবাদী আমলের সেটআপে স্বৈরচারীর দোসরদের বহাল রেখে বর্তমান উপাচার্য আমাদের শহিদদের রক্তের সাথে প্রতিনিয়ত মশকরা করেই যাচ্ছেন। তাছাড়া জুলাইয়ে শিক্ষার্থীদের পাশে থাকা একজন সম্মানিত প্রফেসরকে সিন্ডিকেট থেকে বাদ দেওয়ার মাধ্যমে উপাচার্যের ফ্যাসিবাদী অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্য স্পষ্ট। আমরা অনতিবিলম্বে এসব পতিত দোসরদের বিচার চাই।
যথোপযুক্ত কারণ না দেখিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে অধ্যাপক ড. মুহসিন উদ্দীন, সহকারী অধ্যাপক মো. মোস্তাকিম রহমান এবং প্রভাষক মো. ফরহাদ উদ্দিনকে। মুহসিন উদ্দীন বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র অধ্যাপক।
এর প্রতিবাদে গত বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা। এ প্রসঙ্গে মুহসিন উদ্দীন জানান, তিনি সহ তিন শিক্ষককে পুরোপুরি বেআইনিভাবে সিন্ডিকেট থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এখন ভিসি কীভাবে সিন্ডিকেট চালাবেন, তা তিনিই জানেন।
২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের GST গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের ১ম বর্ষ স্নাতক (সম্মান) শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষার জন্য বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রের অর্থ বণ্টন উপ-কমিটি মার্কেটিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল কাইউম আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। সর্বশেষ ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে প্রক্টরের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ ও হিসাব শাখার উপপরিচালক বরুণ কুমার দেকে ১৫ এপ্রিল তাপসী রাবেয়া ছাত্রীনিবাসে উপ রেজিস্ট্রার পদে বদলি করা হয়। কিন্তু ওই হলে সেকশন অফিসারের ওপরে আর কোনো পদই নেই। নিয়মবহির্ভূতভাবে এই পদায়ন করা হয়েছে। বরুণ কুমার বলেন, মহিলা কর্মকর্তা থাকার পরও মহিলা হলে পুরুষ কর্মকর্তাকে কেন দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে, বুঝতে পারছি না।
একই দপ্তরের প্রধান কর্মকর্তা অতিরিক্ত পরিচালক সুব্রত কুমার বাহাদুরকে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তরের রুটিন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। উপ-রেজিস্ট্রার বাহাউদ্দিন গোলাপকে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির উপলাইব্রেরিয়ান করা হয়েছে। যদিও এই পদে যাওয়ার জন্য যে উচ্চতর ডিগ্রি দরকার, তা তার নেই। একইভাবে সহকারী রেজিস্ট্রার হাবিবুর রহমানকে হলের দায়িত্বে পাঠানো হয়েছে। সহকারী রেজিস্ট্রার সাকিজ উদ্দিন সরকারকে পাঠানো হয়েছে সহকারী পরীক্ষানিয়ন্ত্রক হিসেবে।
কর্মকর্তাদের সরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, কর্মকর্তাদের রদবদলের কারণ রুটিনওয়ার্ক। উপাচার্যের নির্দেশে তা করা হয়েছে।
এর আগে, সহকারী রেজিস্ট্রার মনোয়ার হোসেনকে সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তরে, উপরেজিস্ট্রার দিদার হোসেন খানকে রেজিস্ট্রার দপ্তরে, ভিসির একান্ত সচিব বোরহান উদ্দিনকে উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তরে এবং ভিসির পিএ-২ রুহুল আমিনকে টিএসসিতে বদলি করা হয়। জানা গেছে, উপাচার্যের বিরুদ্ধাচরণ করলেই শাস্তি হিসেবে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তরে পাঠানো হয়। ওই দপ্তরের অন্তত পাঁচজনকে বদলি করা হয়েছে, যাদের বসার জায়গা নেই।
এ প্রসঙ্গে পরীক্ষানিয়ন্ত্রক দপ্তরের রুটিন দায়িত্ব পাওয়া সুব্রত কুমার বাহাদুর বলেন, তিনি আসার আগ পর্যন্ত এ দপ্তরে কয়েকজনের বসার জায়গা ছিল না। তার বসারও কক্ষ নেই। তিনি এখন বসার ব্যবস্থা করছেন।
এর আগে, তিনবার প্রক্টর পরিবর্তন করেছেন উপাচার্য ড. শুচিতা শরমিন। সব হলে নিয়োগ দিয়েছেন নিজস্ব প্রভোস্ট। অভিযোগ উঠেছে নতুন দায়িত্ব পাওয়া অনেকেই পতিত সরকারের দোসর ছিলেন।
জানতে চাইলে ট্রেজারার মামুন অর রশিদ বলেন, ববিতে ভাইস চ্যান্সেলর ফ্যাসিস্টদের পুনর্বাসন করছেন। ছাত্র আন্দোলনের সময় কাইউমের হুকুমে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা হল। অথচ সেই কাইউমকে নানা দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। মুহসিন উদ্দীন বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র অধ্যাপক। তাকে অনৈতিকভাবে নির্বাহী আদেশে সিন্ডিকেট থেকে সরানোর সুযোগ নেই।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে উপাচার্য শুচিতা শরমিন বলেন, অধ্যাপক মুহসিনকে সিন্ডিকেট থেকে বাদ দেওয়ার কারণ তিনি সভা বয়কট করেছেন। এর আগে পদত্যাগও করেছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগের দোসর হিসেবে ওই সময় নানা সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন।
তবে উপ-উপাচার্য গোলাম রাব্বানী বলেন, কোনো শিক্ষককে যদি একাডেমিক কাউন্সিল কিংবা সিন্ডিকেট থেকে অব্যাহতি দেওয়ার প্রয়োজন হয়, তাহলে তা একাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেট সভার মাধ্যমেই হওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে এককভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া আইনবহির্ভূত।আরটিভি