ইউক্রেনের কর্মকর্তারা বলছেন রুশ সেনাবাহিনী চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।
প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা মিখাইলো পোডোলিয়াক মন্তব্য করেছেন বৃহস্পতিবারের 'সম্পূর্ণ অর্থহীন হামলা' এই মুহুর্তে 'ইউরোপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকি তৈরি করেছে।'
১৯৮৬ সালে চেরনোবিল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিস্ফোরণকে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ পারমাণবিক দুর্যোগ - ক্ষতি ও মৃত্যু, দুই হিসেবেই - মনে করা হয়।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট সতর্ক করেছেন যে রুশ বাহিনী তাদের অভিযান অব্যাহত রাখলে চেরনোবিলের মত আরেকটি বিপর্যয় আবারো ঘটতে পারে।
টুইটারে প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি লিখেছেন: "আমাদের রক্ষকরা তাদের জীবন উৎসর্গ করছে যেন ১৯৮৬ সালের মত ট্র্যাজেডির পুনরাবৃত্তি না হয়।"
"এটি পুরো ইউরোপের বিপক্ষে যুদ্ধের ঘোষণা।"
ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও সতর্ক করেছেন যে চেরনোবিলে আরেকটি 'পরিবেশগত বিপর্যয়' সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।
চেরনোবিলের 'বর্জিত এলাকা' বা 'এক্সক্লুশন জোন' - পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চারদিকে ৩২ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের অঞ্চল - বিস্ফোরণের ৩৬ বছর পরেও জনপ্রাণী বিহীন একটি এলাকা হিসেবে ঐ বিপর্যয়ের সাক্ষী হয়ে আছে।
একটি ত্রুটিপূর্ণ রিঅ্যাক্টরের কারণে ১৯৮৬ সালে ব্যাপক মাত্রার বিস্ফোরণটি হয়েছিল।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অন্য তিনটি রিঅ্যাক্টর ২০০০ সালে বন্ধ করে দেয়া হয় এবং তখন থেকেই এই কেন্দ্রটি অকার্যকর অবস্থায় রয়েছে।
২০১৯ সালে এইচবিও'র একটি সিরিজের পর ঐ অঞ্চলটি পর্যটক আকর্ষণের কেন্দ্র হিসেবে জনপ্রিয়তা পায়।
১৯৮৬ সালের বিস্ফোরণের পর থেকেই ঐ অঞ্চলের তেজস্ক্রিয়তা বিপজ্জনকভাবে বেশি মাত্রায় বিরাজ করছে।
খবরে বলা হচ্ছে যে, রাশিয়ান সেনারা ইউক্রেনে প্রবেশ করার আগে বৃহস্পতিবার 'এক্সক্লুশন জোন'-এ প্রবেশ করে।
হোয়াইট হাউজ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে যে, তাদের পাওয়া খবর অনুযায়ী ঐ স্থাপনার কর্মীদের জিম্মি করে রেখেছে রুশ সেনারা।
ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ থেকে ১৩০ কিলোমিটার (৮০ মাইল) উত্তরে চেরনোবিলের অবস্থান। হামলাকারী বাহিনীর রাজধানী কিয়েভে ঢোকার একটি সম্ভাব্য পথ হতে পারে এই শহর।
যুক্তরাষ্ট্রের একটি নিরাপত্তা বিষয়ক সংস্থা ট্রুম্যান ন্যাশনাল সিকিউরিটি প্রজেক্টের নিরাপত্তা বিষয়ক ফেলো সামান্থা টার্নার মন্তব্য করেন যে এই এলাকা 'যুদ্ধের গতিপথ নির্ধারণ' করার মত তাৎপর্যপূর্ণ না হলেও এখান থেকে নিপ্রো নদীর দিকে যাওয়ার পথ সুগম হতে পারে রুশ বাহিনীর।
নদীটি উত্তরে বেলারুশের সাথে আর দক্ষিণে কিয়েভের সাথে সংযুক্ত।
মিজ টার্নার বলেন, "এটি তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি পথ। এর মাধ্যমে সেনাবাহিনী অগ্রসর হওয়ার নতুন রাস্তা পাবে এবং গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।"
ঐ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি কার্যকর নয় এবং ঐ অঞ্চলে মানুষের বসবাসও নেই। তবে সেখানে সরাসরি যুদ্ধ শুরু হলে তেজস্ক্রিয় বর্জ্য নি:সরণ শুরু হতে পারে বলে মিজ টার্নার সতর্ক করছেন।
তবে শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তেজস্ক্রিয় বর্জ্য বিষয়ের অধ্যাপক ক্লেয়ার কর্কহিল মন্তব্য করেন বিশ্বের সবচেয়ে অভিজ্ঞ নিউক্লিয়ার অপারেটরদের মধ্যে রাশিয়ানরা অন্যতম।
গত ছয় বছর ধরে তিনি চেরনোবিলের তেজস্ক্রিয় বর্জ্য নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে তৈরি আন্তর্জাতিক একটি দলের সাথে কাজ করছেন। এর মধ্যে তিনবার তিনি বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি সফরও করেছেন।
এই দলটি তেজস্ক্রিয়তা নিঃসরণকারী রিঅ্যাক্টরটির চারপাশে ৩২ হাজার টন ওজনের একটি গম্বুজ তৈরি করেছেন, যেটি ৩০টিরও বেশি দেশ প্রায় দেড়শো কোটি ডলার খরচ করে তৈরি করেছে।
মিজ কর্কহিলের আশঙ্কা, ইউক্রেনে অভিযানের ফলে এই কাজগুলো বাধাগ্রস্ত হবে।
বিবিসিকে তিনি বলেন, "দুর্ঘটনার পর ৩০ বছর পার হয়ে গেছে। আমরা এখনও পুরোপুরি তেজস্ক্রিয় বর্জ্য পরিস্কার করতে পারিনি। আরো অন্তত ৫০ বছরের কাজ বাকি আছে।"
"মানুষ যদি ঐ স্থাপনায় যথাযথভাবে কাজ করতে না পারে, তাহলে এটি বড় ধরণের সমস্যা তৈরি করতে পারে।"
১৯৮৬ সালের ঐ বিস্ফোরণ পাঁচ বছর পর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে ভূমিকা রেখেছিল বলে মনে করেন অনেকে।
যুক্তরাজ্যের জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংস্থা হেনরি জ্যাকসন সোসাইটির ফেলো ডক্টর তারাস কুজিও মনে করেন, ঐ বিবেচনায় চেরনোবিল দখল করা প্রেসিডেন্ট পুতিনের জন্য একরকম প্রতীকী বিজয়।
"পুতিন এমন মানসিকতার একজন মানুষ, যিনি ৩০ বছর আগের সোভিয়েত ইউনিয়নের বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিষয়টি কখনোই মেনে নিতে পারেননি। আর ঐ বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঘটনার শুরুটা হয়েছিল পাঁচ বছর আগে চেরনোবিল বিপর্যয় থেকে," বলেন ইউক্রেনিয়ান বংশদ্ভূত ড. কুজিও ।