News update
  • Fire breaks out at Sundarbans     |     
  • “Working to close gap that makes heated city unlivable for women”      |     
  • Guideline on heat-related illnesses to be launched tomorrow     |     
  • Flood-hit Kenya and Tanzania on alert as cyclone nears     |     
  • Mangoes dropping early in Rajshahi amid intense heat     |     

ফুলন দেবী: দস্যুরানী থেকে ভারতে সংসদ সদস্য হওয়ার কাহিনী

গ্রীণওয়াচ ডেস্ক গনতন্ত্র 2023-06-09, 2:44pm

3cea7f60-f870-11ed-9cdc-d91215386158-eecbbeaed3b4709e623fc02025f71ac81686300279.jpg




ভারতে আশির দশকে একটা সময় দস্যুরানী ফুলন দেবীর নাম বলিউড সিনেমা 'শোলে’র ভিলেন গব্বর সিংয়ের চেয়েও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। সেসময় অনেক নারীই তাদের বিরক্ত করলে ফুলন দেবীর উদাহরণ দিয়ে হুমকি দিতেন।

বলা হতো, ফুলন দেবী তার লক্ষ্যে যতটা দৃঢ়, তার হৃদয় তার চেয়েও বেশি কঠোর। তরুণ বয়সে ফুলন দেবীর সাথে ঘটে যাওয়া একের পর এক নৃশংস ঘটনাই তাকে কঠোর হৃদয়ের মানুষে পরিণত করেছিল বলে বলা হয়ে থাকে।

তার কঠোরতার উদাহরণ দেয়া হত এমন কথা বলে যে, ২২ জনকে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করার পরও তিনি বিন্দুমাত্র অনুশোচনা অনুভব করেননি।

উত্তর প্রদেশের কানপুরের বেহমাই গ্রামে ১৯৮১ সালে হওয়া ঐ হত্যাকাণ্ড এতটাই আলোড়ন তুলেছিল যে ঐ ঘটনার পর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের শিশুদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে ‘দস্যুরানী’ ফুলন দেবীর নাম।

বিয়ে, ধর্ষণ ও ডাকাত দলে যোগ

ফুলন দেবীর জীবনের ঘটনা নিয়ে একাধিক বই লেখা হয়েছে, সিনেমাও তৈরি হয়েছে বেশ কয়েকটি।

তবে তার নাম ভারতের বাইরে ব্যাপক পরিচিতি পায় ১৯৯৪ সালে শেখর কাপুর পরিচালিত সিনেমা ‘ব্যান্ডিট কুইন’ রিলিজ হওয়ার পর।

সিনেমাটি মূলত মালা সেনের লেখা ফুলন দেবীর জীবনী ‘ইন্ডিয়া’স ব্যান্ডিট কুইন: দ্য ট্রু স্টোরি অব ফুলন দেবী’ বইয়ের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছিল।

উত্তর প্রদেশের একটি গ্রামে নিম্ন বর্ণের হিন্দু পরিবারে ফুলন দেবীর জন্ম ১৯৬৩ সালে।

এগারো বছর বয়সে চাচাদের চাপে তার পরিবার তাকে বিয়ে দিতে বাধ্য হয় পুতিলাল নামে ত্রিশোর্ধ্ব এক ব্যক্তির সাথে, যে ফুলন দেবীকে শারীরিক ও যৌন নির্যাতন করতো।

অত্যাচারের মুখে শিশু ফুলন দেবী বেশ কয়েকবার স্বামীর বাড়ি থেকে নিজ বাড়িতে ফিরে আসলেও সামাজিক চাপের মুখে বারবার তাকে স্বামীর বাড়িতে ফেরত পাঠানো হয়।

ডাকাত দলেরই উচ্চ বর্ণের সদস্য শ্রীরাম জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বিক্রমকে হত্যা করে ফুলন দেবীকে অপহরণ করে নিয়ে যায় কানপুরের কাছে বেহমাই গ্রামে।

বেহমাই গ্রামে প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে ফুলন দেবীকে গণধর্ষণ করে শ্রীরাম সহ আরো অনেকে, যারা অপেক্ষাকৃত উচ্চ বর্ণের ঠাকুর গোত্রীয় ক্ষত্রিয় শ্রেণীর হিন্দু।

মালা সেন তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন, বেহমাই গ্রামে থাকার সময় নিজের ওপর হওয়া নির্যাতনের বর্ণনা দেয়ার সময় ফুলন দেবী বলেছিলেন যে গ্রামবাসীর সামনে দিয়ে নগ্ন অবস্থায় কুয়া থেকে পানি আনতেও পাঠানো হয়েছিল তাকে।

'কুখ্যাত' হয়ে ওঠা

বেহমাই থেকে পালিয়ে আরেক দস্যু মান সিংয়ের সাথে ডাকাত দল তৈরি করেন ফুলন দেবী। এরপর ১৯৮১ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি দল নিয়ে বেহমাই গ্রামে ফিরে যান ফুলন দেবী।

সেখানে গিয়ে তারা গ্রামবাসীর বলেছিলেন শ্রীরামকে তার হাতে তুলে দিতে। কিন্তু পুরো গ্রামে শ্রীরামকে খুঁজে না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে ২২ জন ঠাকুর সম্প্রদায়ের পুরুষকে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে ফুলন দেবীর দলের সদস্যরা।

পরে ফুলন দেবী যখন আত্মসমর্পণ করেন, তখন তিনি দাবি করেছিলেন যে ঐ হত্যাকাণ্ডের সময় তিনি ঘটনাস্থলে ছিলেনই না।

স্থানীয় কয়েকজন স্বাক্ষীর ভাষ্যেও পরবর্তীতে উঠে এসেছিল যে বেহমাই হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ ফুলন দেবী দেননি।

তবে অধিকাংশ বর্ণনাতেই পাওয়া যায় যে বেহমাই হত্যাকাণ্ডে ফুলন দেবীর সরাসরি সংশ্লিষ্টতা ছিল।

সাংবাদিক খুশবন্ত সিং তার বই ‘ফুলন দেবী: কুইন অব ডাকোয়েটস’এ একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা দিয়ে ওই বর্ণনা দিয়েছেন।

আত্মসমর্পণ করা

বেহমাই হত্যাকাণ্ডের পর ফুলন দেবীকে ধরার জন্য চাপ পড়ে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর।

প্রায় এক বছর চেষ্টা করে ফুলন দেবীকে গ্রেফতার করতে না পেরে তাকে আত্মসমর্পণ করার জন্য চাপ দেয়ার চেষ্টা করে মধ্য প্রদেশের পুলিশ।

ফুলন দেবীর সাথে আলোচনার দায়িত্ব দেয়া হয় মধ্য প্রদেশের ভিন্ড জেলার সেসময়কার এসপি রাজেন্দ্র চতুর্বেদির ওপর।

রাজেন্দ্র চতুর্বেদি ১৯৮২ সালের ডিসেম্বর মাসে ফুলন দেবীর সাথে দেখা করতে মধ্য প্রদেশ থেকে উত্তর প্রদেশের চম্বল জেলার খেদান এলাকায় একা যাত্রা করেন। তিনি প্রায় ১২ ঘণ্টা ছিলেন ফুলন দেবী ও তার দলের সাথে।

বিবিসির রেহান ফজলকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মি. চতুর্বেদি বলেছিলেন যে প্রায় চার-পাঁচ ঘণ্টা মোটর সাইকেলে বসে এবং আনুমানিক ৬ কিলোমিটার হাঁটার পর ডিসেম্বরের ৬ তারিখ ভোর রাতে ফুলন দেবীর সাথে তার দেখা হয়।

“যাদের সাথে আমি উপত্যকার কাছে যাই, তারা সেখানে আমাকে দাঁড় করিয়ে চলে যায় ও বলে যে রুমালের সিগন্যাল পেলে এগিয়ে যেতে। কিছুক্ষণ পর সিগন্যাল দেখে আমি এগিয়ে একটি টিলার ওপর গিয়ে দাঁড়াই।

সেখানে একটি গাছের আড়াল থেকে লম্বা গড়নের একজন পুরুষ এগিয়ে আসে আমার দিকে। তিনি নিজেকে মান সিং বলে পরিচয় দেন।”

“মান সিং আমাকে এগিয়ে যেতে ইশারা করতেই দেখতে পাই একটি বাতির পেছন থেকে নীল বেল বটম ও নীল কুর্তা পড়া এক নারীকে আমার দিকে এগিয়ে আসতে। লাল একটি রুমাল দিয়ে তার ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুল বাঁধা ছিল। কাঁধে ঝুলছিল রাইফেল।”

“সারা বিশ্বে ‘দস্যু সুন্দরী’ নামে খ্যাত ফুলন দেবী আমার সামনে এসে পাঁচশো এক টাকা আমার পায়ের সামনে রাখলেন।”

ফুলন দেবী সেদিন নিজ হাতে রাজেন্দ্র চতুর্বেদিকে চা বানিয়ে খাইয়েছিলেন।

কথোপকথনের এক পর্যায়ে ফুলন দেবী জিজ্ঞেস করেন, “আপনি কেন এসেছেন এখানে?” জবাবে মি. চতুর্বেদি বলেন, “আমরা চাই আপনি আত্মসমর্পণ করেন।”

সেসময় ফুলন দেবী হঠাৎই ক্রুদ্ধ হয়ে বলে ওঠেন, “আপনারা বললেই আমি অস্ত্র জমা দেব! আমি ফুলন দেবী, আপনাকে এখনই গুলি করতে পারি।”

এসপি রাজেন্দ্র চতুর্বেদি সেদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলছিলেন যে ফুলন দেবীকে ক্রুদ্ধ হতে দেখে তিনি ভেবেছিলেন যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।

মান সিং তখন পরিস্থিতি কিছুটা ঠান্ডা করার জন্য মি. চতুর্বেদিকে পাশে নিয়ে দলের অন্যান্য সদস্যদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন।

কিছুক্ষণ পর ফুলন দেবীর মেজাজ কিছুটা ঠান্ডা হলে তিনি আবার মি. চতুর্বেদিকে জিজ্ঞেস করেন, “আমি আত্মসমর্পণ করলে আপনারা আমাকে ফাঁসি দেবেন?”

জবাবে মি. চতুর্বেদি বলেছিলেন, “যারা অস্ত্র জমা দেয়, আমরা তাদের ফাঁসি দেই না।”

প্রায় ফুলন দেবী ও তার দলের সাথে থাকার পর মি. চতুর্বেদি যখন ফিরে যাচ্ছিলেন, তখন ফুলন দেবী তার মায়ের জন্য একটি আংটি তার কাছে দিয়ে দেন।

তবে মি. চতুর্বেদি যে মুখ্যমন্ত্রীর তরফ থেকেই মীমাংসা করতে এসেছে, তা নিশ্চিত করতে ডাকাত দলের একজন সদস্যকে মি. চতুর্বেদির সাথে যেতে বলেন।

এসপি মি. চতুর্বেদি ঐ ডাকাত সদস্যকে নিয়ে মধ্য প্রদেশের মুখ্য মন্ত্রী অর্জুন সিংয়ের সাথে দেখা করান।

তারপর মুখ্য মন্ত্রী অর্জুন সিং ও রাজেন্দ্র চতুর্বেদি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করেন এবং তার কাছ থেকে অনুমতি নেন যেন আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া শুরু করতে পারেন।

পরের দুই মাসে রাজেন্দ্র চতুর্বেদি একাধিকবার ফুলন দেবীর সাথে দেখা করেন। একবার তিনি তার স্ত্রীকেও ফুলন দেবীর সাথে দেখা করতে নিয়ে যান।

ফুলন দেবী ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হওয়া নিজের আত্মজীবনী ‘আই, ফুলন দেবী’ বইয়ে লিখেছেন: “চতুর্বেদির স্ত্রী খুবই সুশ্রী এবং দয়ালু মহিলা। তিনি আমাকে শাল, কাপড় ও উপহার দিয়েছিলেন। তিনি ঘরে রান্না করা খাবারও এনে দিয়েছিলেন আমাদের।”

বিবিসির রেহান ফজল রাজেন্দ্র চতুর্বেদিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, তিনি কেন তার স্ত্রীকে ফুলন দেবীর সাথে দেখা করাতে নিয়ে গেলেন।

সেসময় মি. চতুর্বেদি বলেছিলেন, “আমি ফুলনকে দেখাতে চেয়েছিলাম যে আমি তাকে কতটুকু বিশ্বাস করি।”

১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভিন্ড জেলায় ফুলন দেবী ও তার দলের আত্মসমর্পণের দিন ঠিক করা হয়।

রাজেন্দ্র চতুর্বেদি বলছিলেন তার আগের দিন রাতে থাকার জন্য একটি ডাক বাংলো ঠিক করা হয়েছিল।

“ঐ ডাক বাংলো থেকে যখন আমরা গাড়ি দিয়ে ভিন্ড যাচ্ছিলাম, তখন তারা (ফুলন দেবীর দল) ফাঁকা গুলি চালাতে চালাতে যায়। যেখানে আত্মসমর্পণ হওয়ার কথা ছিল, সেখানে স্টেজে মুখ্যমন্ত্রী অর্জুন সিং আগে থেকেই ছিলেন।”

“স্টেজে পৌঁছেই সেখানে রাখা গান্ধীজীর ছবিতে ফুলন দেবী প্রনাম করেন। তারপর সেখানে উপস্থিত মানুষের দিকে তাকিয়ে তার হাতের রাইফেল উঁচু করে, তারপর সেটি অর্জুন সিংয়ের পায়ের কাছে রাখেন।”

১৯৮৩ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত ফুলন দেবী জেলে ছিলেন।

তবে এর মধ্যে তাকে কখনোই উত্তর প্রদেশের কোনো জেলে নেয়া হয়নি।

১৯৯৪ সালে তার বিরুদ্ধে থাকা সব মামলা তুলে নেয়া হয় এবং তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান।

এরপর ১৯৯৬ সালে তাকে সমাজবাদী পার্টি লোকসভা নির্বাচনের টিকেট দিলে তিনি মধ্য প্রদেশ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

এরপর ১৯৯৯ সালে তিনি দ্বিতীয় দফায় লোকসভা নির্বাচনে জেতেন।

সাংসদ থাকা অবস্থাতেই ২০০১ সালের ২৫শে জুলাই তার দিল্লির বাসভবনের সামনে তাঁকে গুলি করে হত্যা করে শের সিং রানা নামের এক যুবক।

আততায়ীর হাতে নিহত

ফুলন দেবীকে গুলি করে হত্যা করার আগে এই শের সিং রানা তার পরিবারের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলেন বলে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ফুলন দেবীর স্বামী উমিদ সিং।

“আমাদের একটি সামাজিক সংগঠন ছিল একলব্য সেনা। ঐ সংগঠনে উত্তরাখন্ডের এক নারী ছিল যার আমাদের বাসায় যাওয়া আসা ছিল। ঐ মেয়েটির গাড়ির ড্রাইভার ছিল শের সিং রানা।”

“ঐ মেয়েটির সাথে সাথেই শের সিং আমাদের ঘরে আসা শুরু করে।”

“যেদিন খুন হয়, সেদিনও ছেলেটি আমাদের বাসায় আসে। সেদিন ছিল নাগ পঞ্চমীর দিন”, বলছিলেন উমিদ সিং।

“সেদিন ফুলন দেবী শের সিংকে নিজের হাতে তৈরি করা ক্ষীরও খাওয়ান। খাওয়া শেষে উনি ১১ টার দিকে পার্লামেন্ট চলে যান। তখন শের সিংয়ের গাড়ি আমাদের বাসার দরজার সামনেই রাখা ছিল।”

“পার্লামেন্ট থেকে তিনি ফেরত আসার পর গাড়ি থেকে নামার সাথে সাথেই তাকে গুলি করে পালিয়ে যান শের সিং।”

ফুলন দেবীর গায়ে সেদিন ৯টি গুলি লেগেছিল আর তার দেহরক্ষীর গায়ে দুটি গুলি লাগে।

আততায়ী শের সিং রানাকে দুইদিনের মধ্যেই গ্রেফতার করা হয় এবং তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে হাই সিকিউরিটি তিহার জেলে পাঠানো হয়।

তিন বছরের মধ্যে ২০০৪ সালে জেল থেকে আদালতে নেয়ার সময় তিনি পালিয়ে যান এবং ২০০৬ সালে আবার ধরা পড়েন।

২০১৪ সালে দিল্লির একটি আদালত ফুলন দেবী হত্যার দায়ে শের সিং রানাকে দোষী সাব্যস্ত করলেও ২০১৬ সালে জামিনে মুক্তি পান তিনি। তথ্য সূত্র আরটিভি নিউজ।