News update
  • FAO Warns of ‘Silent Crisis’ as Land Loss Threatens Billions     |     
  • Indices tumble on both bourses amid broad-based sell-off     |     
  • BNP Names 237 Possible Candidates for Polls     |     
  • Bangladeshi leader of disabled people of world Dulal honoured     |     
  • UN Report Warns Inequality Fuels Global Pandemic Vulnerability     |     

এভারেস্টের চূড়ায় যেভাবে পা রাখেন প্রথম ভারতীয় নারী

গ্রীণওয়াচ ডেস্ক বিবিধ 2024-05-27, 9:52pm

vddsgsg-4cb56f7ee91620de94144742f021175e1716825170.jpg




ছোটবেলা থেকেই বিশ্বের উঁচু পর্বতশৃঙ্গগুলো জয়ের স্বপ্ন দেখতেন ভারতীয় নারী বাচেন্দ্রি পাল। যার মধ্যে সবার আগে ছিল পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্ট। আর তার সেই স্বপ্ন পূরণের সুযোগ আসে একেবারেই অপ্রত্যাশিতভাবে।

প্রথম ভারতীয় নারী হিসাবে এভারেস্টের চূড়ায় পা রেখে তিনি ইতিহাস সৃষ্টি করেন ১৯৮৪ সালের ২৩শে মে।

অভিযানের প্রতিটি পর্যায় ছিল তার জন্য দুর্দান্ত চ্যালেঞ্জে ভরা, তার প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল তার প্রচণ্ড আত্মপ্রত্যয়ের সাক্ষী। পর্বতারোহণের প্রতিটি পদে তিনি আবিষ্কার করেছিলেন নিজেকে।

“পর্বতারোহণ আমায় নিজেকে ভাল করে জানার সুযোগ করে দিয়েছিল। আমি কে? আমি কোন ধাতুতে গড়া? আমার সীমাবদ্ধতা কোথায়? আমার শক্তি কতটা?” বিবিসির জেন উইলকিন্সনকে বলেছিলেন বাচেন্দ্রি পাল।

স্বাধীন জীবনের স্বপ্ন

বাচেন্দ্রির জন্ম ১৯৫৪ সালে উত্তর ভারতের এক গ্রামে এক গরীব শ্রমজীবী পরিবারে। তারা বাবা সীমান্ত এলাকায় ব্যবসাপাতি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। ঘোড়া আর গাধার পিঠে ফুল আর চাল পাঠানোর ব্যবসায় জড়িত ছিলেন তিনি।

“আমরা ছিলাম পাঁচ ভাই বোন,” বলছিলেন বাচেন্দ্রি। “অভাবের সংসারে সবসময় ভাইদেরই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হতো। বাবা-মা ভাবতেন মেয়েদের তো বিয়েই দিয়ে দিতে হবে। কিন্তু আমি সবসময়ে একটা স্বপ্নের জগতে বাস করতাম। আমি স্বপ্ন দেখতাম স্বাধীন জীবনের।”

সেই স্বাধীনতার মূল চাবিকাঠি ছিল শিক্ষা। বাচেন্দ্রি ছিলেন বুদ্ধিমতী। তাদের গ্রামে তিনিই প্রথম মহিলা, যিনি স্নাতক পাশ করেন।

শিক্ষা বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নেবার পর তার পরিবার ভেবেছিল বাচেন্দ্রি শিক্ষিকা হবেন। কিন্তু হঠাৎ করেই নেহেরু ইনস্টিটিউট অফ মাউন্টেনিয়ারিং স্কুলের প্রধানের সাথে তার আলাপ হয়ে যায়। আর সেখান থেকেই পুরো বদলে যায় তার জীবন, তার ভবিষ্যতের পথচলা।

“আমার সঙ্গে কথা বলে খুবই খুশি হন তিনি। আমাকে উৎসাহ দিয়ে বলেন তুমি পাহাড়ে ওঠার প্রশিক্ষণ নাও না কেন! কিন্তু পর্বতারোহণ সম্পর্কে আমি প্রায় কিছুই জানতাম না। আমার সামনে আদর্শ বলতেও কোন পর্বতারোহী নারীও ছিলেন না। আমি ছিলাম সাদাসিধে গ্রামের মেয়ে। তবে খেলাধুলায় আমি ছিলাম বেশ চৌকস।”

জীবনের মোড় ঘোরানো ‘চিঠি’

তবে, প্রস্তাবটা মনে ধরে যায় বাচেন্দ্রি পালের। সেই বছরই তিনি ভর্তি হয়ে যান মাউন্টেনিয়ারিং কোর্সে।

কিন্তু পাহাড়ে ওঠার নেশায় পাগল বাচেন্দ্রি পাল কখনও স্বপ্নেও ভাবেননি তিনি কোনও দিন হিমালয়ের মতো কোন পর্বতের শিখরে পা রাখতে পারবেন।

খেলাধুলায় বাচেন্দ্রির পারদর্শিতা আর তার পাহাড়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষার সাথে ওই প্রশিক্ষণের মেলবন্ধন তাকে সাফল্যের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। প্রশিক্ষণ শেষ করেন তিনি সর্বোচ্চ গ্রেড নিয়ে।

এরপর হঠাৎই একদিন ডাকে আসে এক চিঠি।

“চিঠিটা আসে ইন্ডিয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ফাউন্ডেশান থেকে, যেটা পর্বতারোহণে ভারতের সর্বোচ্চ সংস্থা,” বলেন বাচেন্দ্রি পাল।

“চিঠিতে বলা হয় মাউন্ট এভারেস্ট অভিযানের বাছাই পর্বের জন্য তোমাকে আমরা নির্বাচন করেছি। আমি তো মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতেই পারছিলাম না। এভারেস্ট? এটা কি সত্যি না স্বপ্ন? পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ে আমি উঠব? আমার মনে হল – না না এটা হতেই পারে না- এ চিঠি আমার জন্য নয়।”

বাচেন্দ্রি বলছিলেন তিনি সেই চিঠির উত্তর দেননি। পরে তার প্রশিক্ষকদের কাছে বিষয়টা উল্লেখ করতে তারা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান।

“তারা বলেন ‘তুমি গ্রামের সাদাসিধে মেয়ে- তাই এর তাৎপর্য বুঝতে পারছ না। দিল্লি, বম্বে বা কলকাতার কেউ এই চিঠি পেলে সুযোগটা লুফে নিত!' কথাটা শোনার পর আমার অভীষ্ট হয়ে ওঠে এভারেস্ট বিজয়। আমার প্রতিটা চিন্তা, প্রতিটা কাজ, প্রতি মুহূর্তের পা ফেলায় লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় একটাই- এভারেস্টের চূড়ায় ওঠা।”

প্রস্তুতি পর্ব

ভারতে এভারেস্ট জয়ের অভিযানে প্রথম নারী-পুরুষ মিশ্র পবর্তারোহী দলে যোগ দেন বাচেন্দ্রি পাল। শুরু হয় প্রস্তুতি। নিজের গ্রামে বসেই তিনি প্রশিক্ষণ চালিয়ে যেতে থাকেন। ভারী পাথর বোঝাই ব্যাগ পিঠে নিয়ে শুরু করেন পাহাড়ে ওঠার তালিম। চড়াই ওঠার জন্য বেছে নেন সবচেয়ে কঠিন, সবচেয়ে দুর্গম, ঝুঁকিপূর্ণ পথ। এভারেস্ট জয়ের নায়ক তেনজিং নোরগের আরোহণ প্রণালীগুলোর অনুসরণ শুরু করেন।

তার এই কঠিন প্রস্তুতি পর্ব দেখে তার পরিবার ছিল বিভ্রান্ত, হতভম্ব।

“আমার কাণ্ড দেখে আমার মায়ের খুব মন খারাপ হতো। মা বলতেন- ‘মেয়েকে এত কষ্ট করে বড় করলাম, লেখাপড়া শেখালাম। এখন সে কী করছে! ব্যাগে পাথর ভরে খালি কাছের পাহাড়ে উঠছে।’ মাঝে মাঝে মা আমাকে জিজ্ঞেস করতেন- ‘আচ্ছা বাচেন্দ্রি এসব কেন করছ’?”

শেষমেশ ১৯৮৪ সালে এপ্রিলের গোড়ার দিকে বাচেন্দ্রি পালের জন্য এল পরীক্ষার সেই চরম মুহূর্ত। দলটি হাজির হল এভারেস্টের বেস কাম্পে।

বাচেন্দ্রি বিবিসিকে বলছিলেন, “আমার দারুণ উত্তেজনা হচ্ছিল। মোটেই ভয় করছিল না। তবে তখনকার দিনে মেয়েরা তো এ ধরনের অভিযানে অংশ নিত না! কাজেই সবাই চাইছিল এভারেস্টের চূড়ায় একজন নারীকে দেখতে।”

মৃত্যুর মুখোমুখি

শুরু হল পাহাড়ে ওঠা। তাপমাত্রা নামতে লাগল ক্রমশ- তাপমাত্রা পৌঁছল মাইনাস ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস - শূন্যর ৩০ ডিগ্রি নিচে। সেই সাথে তুষারের দমকা ঘূর্ণি হাওয়া। একসময় দলটি পৌঁছল সাত হাজার মিটার উঁচুতে। সেখানেই তাঁবু গাড়ল তারা।

বাচেন্দ্রি আর অন্যরা যখন তাদের তাঁবুতে রাত কাটানোর জন্য তৈরি হচ্ছে, তখনও তারা জানত না তাদের ভাগ্যে কী অপেক্ষা করছে।

“হঠাৎ রাত বারোটা নাগাদ শুনলাম বিকট একটা আওয়াজ। আমি ভাবলাম তাঁবুর বাইরে আমরা যে অক্সিজেনের সিলিন্ডার রেখেছি সেখানে বোধহয় বিস্ফোরণ হয়েছে। কিন্তু তারপরই মনে হল আমার শরীরের ওপর ভারী একটা কিছু চেপে বসেছে। দেখলাম বিশাল একটা বরফের চাঙড়। বুঝলাম বরফের ধস নেমেছে,” তার ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছিলেন বাচেন্দ্রি পাল।

“আমি আমার জায়গা থেকে নড়তে পারছি না। মনে হল মরে যাব। পর্বত অভিযানে আমার জুটি যিনি ছিলেন তিনি একটা ছোট পকেট ছুরি বের করলেন। তাঁবু কেটে প্রথমে নিজে বেরলেন, তারপর আমাকে টেনে বের করলেন।”

সেখানেই ইতি ঘটতে পারতো তাদের অভিযানের। বাচেন্দ্রির স্বপ্নেরও সেখানেই সমাধি হতো। কিন্তু মৃত্যুর মুখোমুখি হবার পরেও তার উদ্যমে ভাঁটা পড়েনি। হাল ছাড়তে নারাজ ছিলেন বাচেন্দ্রি।

‘মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়া’

তাদের দলনেতা ওই অবস্থায় প্রত্যেককে জনে জনে জিজ্ঞেস করেন তার এগিয়ে যেতে চান, নাকি ফিরে যাওয়ার পক্ষে।

“তিনি আমাকে যখন জিজ্ঞেস করলেন, আমি বললাম – স্যার সুযোগ যদি দেন আমি এগিয়ে যেতে চাই। আমার মনের ভেতর কে যেন জোরের সঙ্গে বলছিল ঈশ্বর এভারেস্টে পৌঁছনর জন্যই তোমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। ঈশ্বর চান – তুমি ওপরে ওঠো – তিনি চান তুমি সর্বোচ্চ পয়েন্টে পৌঁছও। ওই সিদ্ধান্ত সত্যি বলতে কী আমার জীবনকে বদলে দিয়েছিল,” প্রত্যয়ের সঙ্গে বললেন বাচেন্দ্রি।

দলের অর্ধেক পর্বতারোহী আহত হওয়ার ফলে ফিরে যেতে বাধ্য হয়, কিন্তু বাচেন্দ্রি থেকে যান যারা এগিয়ে যাবার জন্য তৈরি, তাদের দলে। উপরে ওঠার শেষের এই পর্যায় পর্যন্ত যারা টিকে গিয়েছিলেন তাদের মধ্যে বাচেন্দ্রিই ছিলেন একমাত্র মহিলা।

“আমরা যাত্রা শুরু করি ভোর ৬টা বিশ মিনিটে। ওপরে ওঠাটা ছিল যেন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়া। বরফ ছিল একেবারে জমাট পাথরের মত। দড়ির সাহায্য নিয়ে ওঠার চেষ্টা সেখানে অসম্ভব। একবার পা হড়কালেই হাজার ফুট নিচে পড়ে যাবার আশঙ্কা।”

দলের সঙ্গে বাচেন্দ্রি পাহাড়ের চূড়ায় পা রাখেন ১৯৮৪র ২৩শে মে দুপুর একটা বেজে সাত মিনিটে। এডমান্ড হিলারি আর তেনজিং নোরগের এভারেস্ট বিজয়ের ঠিক ৩১ বছর পরে সেটা ছিল প্রথম কোন ভারতীয় নারীর এভারেস্ট শিখরে পা রাখা।

“বরফে ব্যবহারের শাবল গেঁথে আমি সেখানে দাঁড়ালাম। তারপর চারিদিকে তাকালাম। চারিদিকে শুধু বরফে ঢাকা পর্বতশৃঙ্গ – সেই তিব্বত পর্যন্ত। আমি মাথা নোওয়ালাম। বাবা মাকে স্মরণ করলাম। তাদের আর্শীবাদ মাথা পেতে নিলাম। তাদের সততা, তাদের কর্মঠ জীবনের কথা স্মরণ করলাম।

"আমাকে দলনেতা অভিনন্দন জানালেন। বললেন- বাচেন্দ্রি দেশ ও দেশের মানুষ যাদের নিচে রেখে এসেছ তারা এখন তোমাকে সম্পূর্ণ আলাদা চোখে দেখবে। আমার মনে হল – হ্যাঁ আমি একটা দারুণ কিছু করেছি,” বললেন বাচেন্দ্রি পাল।

চূড়ায় পা রাখার অনুভূতি কেমন ছিল?

বাচেন্দ্রি পাল যখন সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আট হাজার মিটারের বেশি উচ্চতায় পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু পয়েন্টে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন তখন কেমন ছিল তার অনুভূতি? লক্ষ্য অর্জনের প্রবল আনন্দে আর উত্তেজনায় কি টগবগ করছিলেন তিনি?

“একেবারেই না,” বললেন বাচেন্দ্রি। “এভারেস্ট শিখরে পৌঁছনর পথে আমি কয়েকটা মৃতদেহ দেখেছিলাম। শুনেছিলাম অধিকাংশ দুর্ঘটনাই ঘটে আর অভিযাত্রীদের বেশির ভাগই মারা যান নামার সময়। ফলে সেখানে দাঁড়িয়ে সেই মুহূর্তে ঠিক আনন্দে ডগমগ হতে পারছিলাম না,” আশঙ্কা আর ভয় যে তখনও কালো ছায়া বিছিয়ে রেখেছিল, সে কথাই স্মরণ করলেন তিনি।

তিনি বলেন, একেবারে নিচে নেমে যখন মানুষের মুখ দেখেন, তখন লক্ষ্য অর্জনের প্রবল আনন্দটা প্রথম অনুভব করতে শুরু করেন। “নিচে নামার পর মানুষের ভালবাসা, স্নেহ আর সম্মান আমাকে অভিভূত করেছিল।”

নতুন ‘দায়িত্বের বন্ধন’

প্রশংসা আর অভিনন্দন আসে বাচেন্দ্রি পালের আদর্শ আরেক নারীর কাছ থেকে – ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।

“মিসেস গান্ধী তার বাসভবনে আমাকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন বাচেন্দ্রি তোমাকে অন্য নারীদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। বিশেষ করে গ্রামের মেয়েদের। এটা বিশাল এক দায়িত্বের বন্ধন!

“আমার মনে হয়েছিল সত্যিই তো, গ্রামের মেয়েদের জন্য আমায় কিছু করতে হবে। আমি আজ যেখানে পৌঁছেছি সেখানে পৌঁছতে আমাকে যেরকম সংগ্রাম করতে হয়েছে তাদের যেন সেটা করতে না হয়। সেটাই ছিল আমার অঙ্গীকার।

আজ ভারতের শিক্ষার্থীরা পাঠ্য বইয়ে বাচেন্দ্রি পালের এভারেস্ট অভিযানের কাহিনি পড়ে, তার সংগ্রাম ও আত্মপ্রত্যয়ের সাথে পরিচিত হয়ে ওঠে। বাচেন্দ্রি বলেন, তিনি মনে করেন তার অভিজ্ঞতা, তার আত্মবিশ্বাসী মনোবল যেন দেশের আর দশের উপকারে লাগে।

পরের বছরগুলোতে বাচেন্দ্রি পুরো নারী পর্বতারোহী দল নিয়ে পাহাড়ে গেছেন। এভারেস্ট অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছেন। গঙ্গার খরস্রোতা অংশে দুঃসাহসিক নৌকা বাইচের অভিযানও চালিয়েছেন।

তার ঝুলি ভরে উঠেছে অজস্র পুরস্কার ও সম্মাননায় – পর্বতারোহণে তার সাফল্যের স্বীকৃতিতে পেয়েছেন ভারতের সর্বোচ্চ খেতাব পদ্মভূষণ। বিবিসি বাংলা