বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার দলীয় সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম (ডানে)
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া বাংলাদেশের ঝিনাইদহের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম নিকারি পরিবারের সন্তান এবং শুরুতে খেলাধুলার মাধ্যমেই কালীগঞ্জে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন।
মুসলিম মৎস্যজীবী পরিবারগুলোকে ওই অঞ্চলে নিকারি বলে অভিহিত করা হয়।
যদিও পরবর্তীতে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ও ওই অঞ্চলের সীমান্ত চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। মি. আজীম নিজেই তার নির্বাচনি হলফনামায় একুশটি মামলার তথ্য দিয়েছিলেন, যার মধ্যে হত্যা ও চোরাচালানের মামলাও ছিল।
জাতীয় পার্টির মাধ্যমে রাজনীতি শুরু করে বিএনপি হয়ে আওয়ামী লীগে এসে সংসদ সদস্য হতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি এবং পরপর তিনটি নির্বাচনে সরকারি দল আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হন।
এ সময়ে রাজনীতি, সংগঠনসহ ওই অঞ্চলে প্রভাবশালী নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন তিনি। দলের বাইরে ও ভেতরে তার বিরুদ্ধে যারা ছিলেন তাদের অনেকে নানাভাবে হামলার শিকার হয়েছেন এমন অভিযোগও আছে।
একসময় ইন্টারপোলের তালিকায় থাকা মি.আজীম অন্তত চার বছর আত্মগোপনে কিংবা ভারতে ছিলেন ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ও তার আগে। পরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ওই তালিকা থেকে নাম সরাতে সক্ষম হন তিনি।
ঝিনাইদহ ও কালীগঞ্জের একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা, স্থানীয় সাংবাদিক ছাড়াও মি. আজীমকে তার অল্প বয়স থেকেই চিনতেন- এমন কয়েকজনের সাথে আলাপ করে এমন ধারণাই পেয়েছে বিবিসি বাংলা।
কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আয়ুব হোসেন খান এক সময় আনোয়ারুল আজীমের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। যদিও গত সংসদ নির্বাচনে তিনি ওই এলাকার সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত আব্দুল মান্নানের ভাই আব্দুর রশিদ খোকনের পক্ষে সক্রিয় ছিলেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী মি. খোকনকে হারিয়েই এমপি হয়েছিলেন মি. আজীম।
“খেলাধুলার কারণে কালীগঞ্জে আনার সাহেবের জনপ্রিয়তা ছিল। একানব্বইয়ের নির্বাচনের আগে বিএনপি থেকে প্রথমে আব্দুল মান্নান ও পরে আনার সাহেব আওয়ামী লীগে এসেছিলেন। আমি চেষ্টা করেছিলাম রাজনীতিতে তাকে সহায়তার,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মি. হোসেন।
এক সপ্তাহ আগে নিখোঁজ হওয়া বাংলাদেশের ঝিনাইদহের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে বুধবার দুপুরে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। এই ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তারের কথাও জানান তিনি।
একই দিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেছেন, নিউ টাউনের যে ফ্ল্যাটে এমপি আজীমকে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে , সেখানে পুলিশ কোনো লাশ খুঁজে পায়নি।
ভারতে মি. আজীমের হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকার বিষয়ে যাদের নাম পুলিশ সূত্রের বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যমে এসেছে তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন আখতারুজ্জামান শাহীন।
তার ভাই ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর পৌরসভার মেয়র মো. সহিদুজ্জামান বিবিসি বাংলাকে বলেছেন তার ভাই আখতারুজ্জামানের সাথে মি. আজীমের বন্ধুত্ব ছিল গত কয়েক বছর ধরে।
“আনার সাহেবের (আনোয়ারুল আজিম) সাথে আমার বা আমার পরিবারের কারও কোনো বিরোধ ছিল না। আর আমার ভাই নব্বইয়ের দশকের শুরুতে অপি-১ ভিসা পেয়ে আমেরিকায় গিয়েছিল। মাঝে মধ্যে ফোন করতো। এর বাইরে যোগাযোগ ছিল না। সে যদি জড়িত থাকে এই ঘটনায় তাহলে আইনি প্রক্রিয়ায় যে শাস্তি হবে আমরা মেনে নিবো,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
তিনি বলেন তার ভাই মেরিন ইঞ্জিনিয়ার ও দীর্ঘদিন জাহাজে চাকরি করেছে। “সে রাজনীতিতে কখনোই জড়িত ছিল না,” বলছিলেন তিনি।
নিকারি পরিবার থেকে জনপ্রতিনিধি
মুসলিম মৎস্যজীবী পরিবারগুলোকে ওই অঞ্চলে নিকারি বলে অভিহিত করা হয়। মি. আজীমের পরিবার নিকারি হিসেবে পরিচিত ছিল। দশ ভাই বোনের মধ্যে চতুর্থ সন্তান আনোয়ারুল আজীম ছোটবেলা থেকেই ফুটবল ও ক্রিকেট খেলে এলাকায় বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন।
পরে পৌরসভা নির্বাচনে কমিশনার পদে দাঁড়িয়ে (বর্তমানে কাউন্সিলর) নির্বাচিত হন। মূলত এরপর থেকেই তার শক্ত অবস্থান তৈরি হতে থাকে।
বেশ কিছু হত্যা ও চোরাচালানের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় তার নাম ওঠে আসে। যদিও এর বেশিরভাগ মামলাই হয়েছিলো ২০০১ সালের পরের সরকারের সময়ে।
এর আগে ১৯৯১ সালের নির্বাচনের আগে তখনকার বিএনপি নেতা আব্দুল মান্নান ও পরে আনোয়ারুল আজীম আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছিলেন বলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা জানিয়েছেন।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শক্ত অবস্থান তৈরি হতে শুরু করে মি. আজীমের। সে সময় ঝিনাইদহ অঞ্চলে চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে সরকার যে অভিযান চালিয়েছিলো সেখানে মি. আজীমের ভূমিকা নিয়েও আলোচনা আছে।
পরে বিএনপি ক্ষমতায় এলে এলাকা ছেড়ে আত্মগোপনে যান তিনি এবং ওই অবস্থাতেই ২০০৪ সালে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। কিন্তু সেসময় পুরনো আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেককেই নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দিলে দলের অভ্যন্তরে ব্যাপক দ্বন্দ্ব ও কোন্দল তৈরি হয়।
২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর তার বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের মাধ্যমে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়, যা পরে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তুলে নেয়া হয়। পরে ধীরে ধীরে অন্যান্য মামলাগুলো থেকেও অব্যাহতি বা খালাস পান তিনি।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা জানিয়েছে, মি. আজীম ২০০৯ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং এরপর ২০১৪ সালের নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হন। কিন্তু এর মধ্যেই কিছু অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে নাম আসে তার।
“খেলাধূলার কারণে জনপ্রিয় ছিলেন, কমিশনার ছিলেন। পরে তিনি এমপি হতে চেয়েছেন। এর বাইরে আর কিছু আমার জানা নেই,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আইয়ুব হোসেন।
অন্যদিকে, মি. আজিমের মেয়ে সংবাদ মাধ্যমকে বলেছিলেন তার বাবার বিরুদ্ধে মামলা ছিল রাজনৈতিক এবং সে কারণেই তাকে দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে।
দলে আরও যত আলোচনা
আওয়ামী লীগেরই একটি অংশ বলছে, ২০০৭ সালের দিকে একটি বড় ধরনের সোনার চালান ধরা পড়ার ঘটনায় মি. আজীম বিপাকে পড়েন এবং সেই মামলায় তাকে আসামি করা হয়েছিলো। ওই মামলার সাথে সংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তি পরে খুন হলে তাতেও মি. আজীমের নাম আলোচনায় আসে।
“উনি এমপি হওয়ার পর থেকে এমন কোন খুন বা বড় চোরাচালানের ঘটনা ছিল না, যেটায় তার নাম আসেনি,” বলছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের মধ্যম সারির একজন নেতা।
যদিও মি.আজীমের মেয়ে সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন রাজনীতি আর সাংগঠনিক দক্ষতার কারণেই বিভিন্ন সময় মামলায় তার বাবার নাম জড়ানো হয়েছিলো।
অবশ্য আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা ও স্থানীয় সাংবাদিকরা এটিও বলছেন যে এলাকার তরুণদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা ছিল এবং সমালোচকদের সহ্য করতে না পারলেও সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেশার দক্ষতা ছিল তার।
এদিকে ভারতীয় গণমাধ্যমে সোনা চোরাচালানের সাথে আনোয়ারুল আজীমের জড়িত থাকার যে তথ্য প্রকাশ হয়েছে তার প্রেক্ষাপটে ঢাকায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, তার জনপ্রিয়তা দেখেই আওয়ামী লীগ তাকে মনোনয়ন দিয়েছে।
“তাকে আমরা তৃতীয়বার মনোনয়ন দিয়েছি জনপ্রিয়তা দেখে। এখন সে ভেতরে কোনো অপকর্ম করে কি না , এসব যখনই প্রমাণিত হয় প্রধানমন্ত্রী কিন্তু জিরো টলারেন্স। অন্যায়কারী বা অপরাধী দলের লোক হলেও তিনি ছাড় দেন না,” তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে এক সভায় তিনি একথা বলেন। বিবিসি বাংলা