News update
  • 2 dead, six hurt in Sherpur micro-autorickshaw-motorbike crash     |     
  • One killed over loud music row at wedding party in Natore     |     
  • Fire breaks out at jacket factory in Chattogram     |     
  • Dhaka, Delhi agree to bring down border killings to zero     |     
  • Natore’s Baraigram OC closed over negligence in bus robbery case     |     

দুর্গাপুজোর সঙ্গে ইলিশ খাওয়ার কী সম্পর্ক?

বিবিসি নিউজ বাংলা, কলকাতা বিবিধ 2024-09-22, 11:15am

kdhjehjh-49fd1a0a4a4fb640401d246692dcd9eb1726982100.jpg




হিন্দু বাঙালিদের সবথেকে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপুজোর সময় ভারতে ইলিশ মাছ পাঠানো- না পাঠানো নিয়ে বহু আলোচনার পর অবশেষে তিন হাজার টন ইলিশ রপ্তানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

গত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশ সরকার দুর্গাপুজোর আগে কয়েক হাজার টন ‘পদ্মার ইলিশ’ ভারতে রফতানি করে আসছে। সেই মাছের চালান মূলত আসে পশ্চিমবঙ্গের বাজারগুলিতে।

যদিও এর আগে সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছিল, দেশের মানুষ যাতে 'দামী মাছ' ইলিশ খেতে পারে, তাই ভারতে ইলিশ রপ্তানি করা হবে না। তবে শেষ পর্যন্ত সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরকার দৃশ্যত সরে এসেছে।

কিন্তু দুর্গাপুজোর সঙ্গে সত্যিই কি ইলিশ মাছ, আরও বিশেষ করে পদ্মার ইলিশ খাওয়ার কোনও যোগ আছে?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন দুর্গাপুজোর যে ধর্মীয় আচার, সেখানে কোথাও ইলিশ মাছ বা পদ্মার ইলিশের প্রসঙ্গ নেই। এটি মূলত: প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা একটি লোকাচার, যা এখন বাঙালিদের একাংশের ‘হুজুগ’-এ পরিণত হয়েছে।

হিন্দু পুরাণে ইলিশ

দুর্গাপুজোর সময়ে, অর্থাৎ শরৎকালে ইলিশ মাছ খাওয়ার ‘হুজুগ’ সম্প্রতি শুরু হলেও গাঙ্গেয় বঙ্গদেশে ইলিশ মাছের কথা প্রাচীন সাহিত্যকর্ম এবং পুরাণে একাধিকবার উল্লেখিত হয়েছে বলে জানা যায়।

ইলিশ মাছ নিয়ে লেখা বই ‘ইলিশ পুরাণ’-এ পশ্চিমবঙ্গের ইলিশ-গবেষক দিগেন বর্মন লিখছেন, “ইল্লিশো মধুর / স্নিগ্ধো রোচনো/ বহ্নিবর্জনঃ/ পিত্তিকৃৎ কফকৃৎ/ কিঞ্চিল্লঘু ধর্মোহ নিলাজহঃ, অর্থাৎ ইলিশ মাছ মধুর, স্নিগ্ধ, রোচক ও বলবর্দ্ধক, পিত্তকারী, কিঞ্চিৎ কফকারী, লঘু পুষ্টিকর ও বাতনাশক। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে ইলিশ মাছের গুণাগুণ নিয়ে এভাবেই লেখা আছে। এ থেকে প্রমাণিত হয় ইলিশ মাছের প্রতি আমাদের আসক্তি অতি প্রাচীন।

“আর একটি উদ্ভট শ্লোক লেখার লোভ সামলাতে পারছি না। ইলিশো খলিশশ্চৈব্ ভেটকিমর্দগুর এবচ/ রোহিতো মৎসরাজেন্দ্রঃ পশ্চমৎস্যা নিরামিষাঃ।। সব থেকে ভাল যে পাঁচটি মাছ তার মাথায় রয়েছে ইলিশ। নিরামিষ ভোজীরাও নির্দ্বিধায় নিরামিষ হিসাবে ইলিশ মাছ খেতে পারে অবশ্য তাদের যদি তেমন খাবার ইচ্ছা থাকে,” লিখেছেন গবেষক দিগেন বর্মন।

তিনি আরও লিখেছেন, “পদ্মপুরাণে রান্নার নানারকম বিবরণ আছে – তারকা তার নন্দাই লখিন্দরের জন্য যে রান্না করেছিলেন তাতে মাছ আর শাক দিয়ে রান্নার কথায় – রোহিতের মুণ্ড দিয়া রান্ধে মুলাশাক/ সরিষার শাক রান্ধে ইলিশার শিরে।“

মি. বর্মনের লেখা থেকে এটা স্পষ্ট হয় যে বাঙালির রান্নায় ইলিশ মাছের উপস্থিতি বহু যুগ ধরেই রয়েছে। যদিও দুর্গাপুজোর সঙ্গে ইলিশ মাছের কোনও সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় না বলে জানিয়েছেন পুরাণ গবেষক শরদিন্দু উদ্দীপন।

দুর্গাপুজোয় ইলিশ

পুরাণ গবেষক শরদিন্দু উদ্দীপন জানাচ্ছেন যে প্রাক-আর্যকাল থেকেই বাংলার নানা অঞ্চলের লোক-উৎসবে ইলিশ মাছ খাওয়ার প্রচলন ছিল।

তার কথায়, “ইলিশ মাছের সঙ্গে বাঙালীর খাদ্যাভ্যাসের একটা নিবিড় যোগ আছে। তার ফলে এই সময়ে নিম্ন বঙ্গে যতগুলো খাদ্যোৎসব হয়ে আসছে প্রাচীন কাল থেকে, তার সবগুলিতেই ইলিশের উপস্থিতি পাওয়া যায়। সেই উৎসবগুলিকে এখনও এই অঞ্চলের লোক-জীবনকে ঘিরে রেখেছে।

“কুড়মিদের করম উৎসব বা সাঁওতালদের কারাম উৎসবে যে নবপত্রিকার আরাধনা করা হয়, শাকাম্ভরী দুর্গাপুজোতেও সেই নবপত্রিকার পুজো আমরা দেখে থাকি। প্রাচীন লোক-উৎসবগুলির সঙ্গে এখনকার দুর্গাপুজোর যোগটা এখানে।আবার গাসি পুজো, কুলোয় পুজো বা দক্ষিণবঙ্গের আরেকটি বিখ্যাত পুজো – রান্না পুজোতেও ইলিশ বাধ্যতামূলক। রান্না পুজোতে হাজার ব্যঞ্জন রান্না করা হলেও ইলিশ মাছ থাকবেই,” বলছিলেন গবেষক শরদিন্দু উদ্দীপন।

তিনি বলছিলেন, দুর্গাপুজোয় ইলিশ মাছ ভোগ দেওয়ার যে প্রথা এখন দেখা যায়, তার কোনও পৌরাণিক ব্যাখ্যা নেই। এই প্রথা শুরু হয় অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, কলকাতায় যখন রাজা নব কৃষ্ণ দেব দুর্গাপুজো শুরু করলেন, তার পর থেকে। গোড়ার দিকের ওইসব দুর্গাপুজোয় মূলত: বৈভব প্রদর্শনের অঙ্গ হিসাবেই ইলিশের প্রচলন শুরু হয়। তার আগে পর্যন্ত অবিভক্ত বঙ্গে ইলিশ মাছ ছিল লোক-উৎসবের অংশ।

ইলিশ খাওয়ার সময়কাল

বাঙালি হোটেল রেস্তরাঁয় তো বটেই, অনেক পশ্চিমা কায়দার হোটেলেও দুর্গাপুজোর স্পেশাল মেনুতে ইলিশের পদ থাকে। আবার পূর্ববঙ্গীয়দের বাড়িতে লক্ষ্মীপুজোর দিনে জোড়া ইলিশ খাওয়ার চল রয়েছে।

সে দিনই ইলিশ খাওয়া বন্ধ হয়ে যায় প্রজননের সময় শুরু হয় বলে, আবার জানুয়ারির শেষ বা ফেব্রুয়ারিতে সরস্বতী পুজোর দিনে ইলিশ খাওয়া শুরু হয়।

দুর্গাপুজোর আচার-রীতির সঙ্গে ইলিশ মাছের কোনও যোগ না পাওয়া গেলেও নিম্ন-বঙ্গ অঞ্চলে যে বর্ষাকালের লোক-উৎসবগুলিতে ইলিশের প্রচলন ছিল, তা একাধিক গবেষক জানাচ্ছেন।

তারা আবার এটাও বলছেন পশ্চিমবঙ্গীয় এবং পূর্ববঙ্গীয় মানুষদের মধ্যে ইলিশ খাওয়ার সময়কালে ফারাক রয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গীয়রা দুর্গাপুজোর আগেই ইলিশ খাওয়া বন্ধ করে দেন, অন্যদিকে পূর্ববঙ্গীয়দের একাংশ দুর্গাপুজোর পরে লক্ষ্মীপুজোয় ইলিশ খেয়ে তার পরে ইতি টানেন।

খাদ্য-গবেষক-লেখক ও ফুড ভ্লগার সুরবেক বিশ্বাস বলছিলেন অবিভক্ত বাংলার দুই অঞ্চলের মানুষের ইলিশ খাওয়ার সময়কালের এই ফারাক।

“যারা খাঁটি পশ্চিমবঙ্গীয়, যাদের আমরা ঘটি বলে থাকি, এরকম বেশ কয়েকটি বনেদী পরিবারের কাছ থেকে আমি জেনেছি যে তারা বর্ষাকালের তিন-সাড়ে তিন মাস ইলিশ খান আর তা শেষ হয় রান্না পুজোয় ইলিশ খাওয়ার মধ্যে দিয়ে,” বলছিলেন মি. বিশ্বাস।

দক্ষিণবঙ্গের একটা বড় অঞ্চলে রান্না পুজোর যে চল আছে, সেটা সাধারণত দুর্গাপুজোর দিন ১৫ আগে পালন করা হয়। এইদিনেই বাঙালি হিন্দুদের একাংশ বিশ্বকর্মা পুজো করেন। বিশ্বকর্মাকে বাঙালি হিন্দুদের একাংশ কারিগরির দেবতা বলে মনে করেন।

“পশ্চিমবঙ্গীয় বনেদী পরিবারগুলি মনে করে যে রান্না পুজোর পরে যে ইলিশ পাওয়া যায়, সেগুলো কোল্ড স্টোরেজ থেকে আসে। আবার পূর্ববঙ্গীয়দের মধ্যে অনেকে আছেন যারা লক্ষ্মী পুজোর দিনে জোড়া ইলিশ খেয়ে তারপরে সেবছরের জন্য ইলিশ পার্বণে ইতি টানেন,” জানাচ্ছিলেন সুরবেক বিশ্বাস।

তিনি আরও জানাচ্ছিলেন, “দুর্গাপুজোয় পাঁঠা বলি হত, আবার যেসব বাড়িতে প্রাণীহত্যা করা হয় না, সেখানে চালকুমড়ো বলি দেওয়া হয়। কিন্তু দেবীকে ইলিশ ভোগ দেওয়া হচ্ছে, এটা সচরাচর শোনা যেত না। ইলিশ একটা উৎসবকে চিহ্নিত করে, এটা পুজোর নয়। এটা এখন একটা হুজুগ। শরৎকাল, আশ্বিন মাস তো ইলিশ খাওয়ার সময়ও নয়।“

পদ্মার ইলিশ না গঙ্গার ইলিশ?

দুর্গাপুজোর আগে বাংলাদেশ থেকে ‘পদ্মার ইলিশ’ ভারতে রফতানি না হওয়া নিয়ে যারা সমাজ মাধ্যমে বিমর্ষ ভাব প্রকাশ করছেন, তাদের অতটাও মন খারাপ হওয়ার কিছু নেই বলে মনে করছেন খাদ্য রসিক ও গবেষকরা।

ইলিশ গবেষক দিগেন বর্মন তার বই ‘ইলিশ পুরাণ’-এ লিখেছেন, “আমরা গঙ্গার ইলিশ খেতে ভাল না পদ্মার ইলিশ ভাল তা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তর্ক করি। শুধু তাই নয় ঘটি আর বাঙালদের মধ্যে এ এক অন্যতম ঝগড়ার বিষয়। কমলকুমার মজুমদার ও রাধাপ্রসাদ গুপ্তর মতে গঙ্গার ইলিশ আর পদ্মার ইলিশের থেকে ভাল।

আবার সাহিত্যিক “বুদ্ধদেব গুহ একবার বলেছিলেন ঢাকা থেকে বন্ধুর পাঠানো ইলিশ খেয়ে কলম ঠিক মত ধরতেই পারছি না। ইমপোর্টেড পদ্মার ইলিশের তেলে কলম পিছলে যাচ্ছে। সুলেখক যতীন্দ্রমোহন দত্ত ইলিশ নিয়ে তাঁর লেখায় গঙ্গা আর পদ্মার ইলিশ নিয়ে এক ভারসাম্য আনার চেষ্টা করেছিলেন। তা হল, ‘পুবদেশের মাছে তেল আর কলকাতার ইলিশে সুগন্ধ বেশি।

“এটাই মনে হয় অনেকটা সত্য,” লিখেছেন ইলিশ গবেষক দিগেন বর্মন।

আবার এক বর্ষীয়ান ‘মাছ-শিকারি’ যোগেন বর্মন, যিনি ষাট বছর ধরে মাছ ধরেন, তাকে উদ্ধৃত করে দিগেন বর্মন লিখেছেন, “গঙ্গা, মেঘনা, পদ্মা ও বঙ্গোপসাগরে তিনি মাছ ধরেছেন। তার মতে গঙ্গার ইলিশের টেস্ট ভাল। গঙ্গার ইলিশের মতোই টেস্ট গোমতীর ইলিশে। ধলেশ্বরী নদীর ইলিশ আর ডায়মন্ডহারবারের (কলকাতার কাছে ভাগীরথী নদীর তীরের শহর) ইলিশ দেখতে ও খেতে প্রায় একই রকম। তাঁর মতে পদ্মার ইলিশ যদি মেঘনায় চলে যায় এবং কয়েকদিন থাকে তাহলেই তার টেস্টও অন্য রকম হয়ে যায়।“

খাদ্য গবেষক সুরবেক বিশ্বাস ভারত আর বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ইলিশের তুল্যমূল্য বিচার করতে গিয়ে বলছিলেন, “মাছের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে ইলিশ আর ইলিশের মধ্যে সেরা হল পদ্মার ইলিশ – এটা ধরে নেওয়া হয়। তবে আমি বাংলাদেশের বন্ধুদের কাছে শুনেছি এখন নাকি পদ্মার থেকেও মেঘনার ইলিশের স্বাদ বেশি ভাল। আবার পশ্চিমবঙ্গের কথা যদি ধরা যায়, একটা সময়ে কোলাঘাটের ইলিশ বলে যেটা বাজারে পাওয়া যেত, রূপনারায়ণ নদীর ইলিশ, সেটা এখন প্রায় পাওয়াই যায় না। দূষণের কারণে মূলত এটা হয়েছে।

“গত কয়েক বছরে ভাগীরথীর মোহনার কাছাকাছি অঞ্চলের ইলিশ খুব বেশি পাওয়া যাচ্ছে কলকাতা বা লাগোয়া এলাকার বাজারে। সেটার স্বাদও খুব ভাল। আবার ওড়িশা থেকেও উচ্চাঙ্গের ইলিশ আসছে। আসলে আমাদের মাথায় একটা ধারণা গেঁথে গেছে যে পদ্মার ইলিশই সেরা,” বলছিলেন সুরবেক বিশ্বাস।

তাই পদ্মার ইলিশ না হলেও ভাল মানের, ভাল স্বাদের ইলিশের অভাব নেই পশ্চিমবঙ্গে, এমনটাই বলছেন গবেষকরা।