News update
  • France to Break Away from UK & US in Recognising Palestine as Nation State     |     
  • Storm Alert Issued for Dhaka and Eight Other Regions     |     
  • 58 killed in deadliest US strike on Yemen     |     
  • BNP Opposes Reforms to Constitution’s Core Principles      |     
  • Time to Repair Bangladesh–Pakistan Ties     |     

পাকিস্তান থেকে যে রাস্তা দিয়ে লন্ডন যাওয়া যায়

গ্রীণওয়াচ ডেস্ক বিবিধ 2025-02-26, 6:37pm

fdffre-74470be2f016b2fc240962a0c5ab4fbc1740573449.jpg




পাকিস্তানের বালুচিস্তান প্রদেশের রুক্ষ পাহাড়ের মধ্য দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তাটিকে এক নজরে দেখে কেউ বিশ্বাসই করতে পারবেন না যে কয়েক দশক আগে পর্যন্তও এটাই ছিল পর্যটকদের কাছে ইউরোপ থেকে স্থলপথে পাকিস্তান আসার প্রধান পথ।

রাস্তাটার নাম ‘লন্ডন রোড’।

আমি নিজে বালুচিস্তানের নোশকি জেলা লাগোয়া ইরানের সীমান্ত পর্যন্ত অনেকবার গিয়েছি এই রাস্তা দিয়েই। কিন্তু রাস্তাটার ইতিহাস আমার অজানা ছিল।

বর্তমানে এই রাস্তাটি 'ডাঙ্কি রুট' নামেই বেশি পরিচিত কারণ এই সড়কপথই পাকিস্তান থেকে অবৈধভাবে ইউরোপে যাওয়ার প্রধান রুট হয়ে উঠেছে, আর সে কারণেই বারবার এই রাস্তাটি খবরে উঠে আসে।

তবে একটা সময় ছিল যখন শত শত ইউরোপীয় পর্যটক বাস ও মোটরবাইকে করে এই পথ দিয়ে পাকিস্তানে আসতেন।

লন্ডন রোড কেন নাম?

এই রাস্তাটার কাহিনি অনেক পুরানো। সে কথায় যাওয়ার আগে একটু ইতিহাসের দিকে নজর দেওয়া যাক।

বালুচিস্তানের রাজধানী কোয়েটা থেকে তাফতান পর্যন্ত পাকিস্তানের সীমান্ত বরাবর অবস্থিত এই রাস্তাটি।

সেখান থেকে ইরান, তুরস্ক, গ্রীস ও ইউরোপীয় দেশ পেরিয়ে ব্রিটেনে পৌঁছায় রাস্তাটি। এর চূড়ান্ত গন্তব্য লন্ডন, তাই রাস্তার নাম লন্ডন রোড।

ইতিহাসবিদরা বলছেন যে ব্রিটিশরা ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে প্রতিরক্ষার ব্যাপারে এই রাস্তাটির গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিল। সেই সময়ে রাশিয়া দক্ষিণ অংশে তাদের প্রতিরক্ষা-শক্তি বৃদ্ধির একটা জোর চেষ্টা চালিয়েছিল।

ইতিহাসবিদ ও গবেষক ইয়ারজান বাদিনি বলছিলেন, শাহ মোহাম্মদ হানিফি তার 'মাউন্টস্টুয়ার্ট এলফিনস্টোন ইন সাউথ এশিয়া' গ্রন্থেও এই বিষয়টির উল্লেখ করেছেন।

মি. হানিফি তার বইতে লিখেছেন যে বালুচিস্তান অঞ্চল সম্পর্কে অনেকেই কিছু জানত না কারণ জায়গাটি বহু শতাব্দী ধরে কোনো দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থার অধীনে ছিল না।

তিনি বলেছেন যে ব্রিটিশদের ভয় ছিল যে একদিকে রাশিয়া অন্যদিকে নেপোলিয়ন ভারত দখল করে নিতে পারে। সে জন্য এই এলাকার তথ্য সংগ্রহ করতে ১৮০৯ সালে তারা ভারত ও পারস্যের মধ্যবর্তী বালুচিস্তানে কয়েকজন গুপ্তচর পাঠায়।

তাদের দায়িত্ব ছিল সেখানকার ইতিহাস, মানুষের জীবনযাত্রা, পণ্য ও গবাদি পশু ইত্যাদির ব্যাপারে খবরাখবর সংগ্রহ করা।

মি. হানিফির লেখা অনুযায়ী যে দুজন গুপ্তচরকে বালুচিস্তানে পাঠানো হয়েছিল তাদের মধ্যে ছিলেন লেফটেন্যান্ট হেনরি পটিঙ্গার এবং চার্লস ক্রিস্টি।

মি. পটিঙ্গার ঘোড়া ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে বালুচিস্তানে পৌঁছিয়েছিলেন।সেখান থেকে তিনি ইরান এবং তারপরে তুরস্ক পর্যন্ত গিয়েছিলেন।

মনে করা হয় যে সেই প্রথমবার কেউ ভারত থেকে বালুচিস্তান, ইরান হয়ে অটোমান সাম্রাজ্য পর্যন্ত গিয়েছিলেন।

লন্ডন রোডে চলত দোতলা বাস

বালুচিস্তানের প্রাক্তন প্রধান সচিব আহমেদ বকশ্ লাহোরি বলছিলে যে ব্রিটিশ আমলের আগে মুঘল জমানায় এই লন্ডন রোডকে প্রতিরক্ষার কাজে ব্যবহার করা হত।

মুঘল এবং ব্রিটিশরা এই রাস্তাটি প্রতিরক্ষার জন্য ব্যবহার করলেও, ভারত ভাগের পরবর্তী দশকগুলিতে ইউরোপ ও পাকিস্তানের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে উঠে আসে এই রাস্তাটি।

আগে যে রাস্তায় ঘোড়া চলত, সেখানেই শুরু হলো বাস আর মোটরসাইকেলে চেপে লন্ডন থেকে কোয়েটা পর্যন্ত যাত্রা।

এই প্রতিবেদনের জন্য গবেষণার সময়ে আমি ১৯৬০ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত বেশ কিছু পুরনো ছবি খুঁজে পাই।

এগুলোর মধ্যে যেমন রয়েছে কোয়েটার কাছে লন্ডন রোডের ওপরে বেশ কয়েকটি মাইলস্টোনের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ব্রিটিশ পর্যটকদের ছবি, তেমনই পেয়েছি দোতলা বাসের একটি ছবি আর তার যাত্রীরা রাস্তার ধারে পিকনিক করছিলেন।

গবেষক ইয়ারজান বাদিনি এই ছবিগুলো যাচাই করে দেখেছেন। তিনি বলেন, সেই সময়ে ইউরোপের দেশগুলো থেকে মানুষ বাসে করে কোয়েটায় যেতেন এবং সেখান থেকে ভারতের দিকে রওয়ানা হতেন তারা।

পথের ধারে হোটেল, সরাইখানা

এই সড়কে যাতায়াতের পথে অনেক সরাইখানা ও চায়ের দোকান দেখা যায়। ইয়ারজান বাদিনি জানাচ্ছেন যে ওইসব সরাইখানা তীর্থযাত্রী বা সাধারণ যাত্রীদের জন্য গড়ে উঠেছিল।

এরকমই একটা চায়ের দোকান ১৯৭০-র দশকে চালু করেন তাজ মোহাম্মদ।

তার ছেলে মুমতাজ আহমেদ বললেন যে প্রথমে সেটি ছিল একটি সরাইখানা। সেখানে যাত্রীদের রাত কাটানোর ব্যবস্থা ছিল। তবে ১৯৯৯ সালে তার বাবার মৃত্যুর পরে সেটি একটি চায়ের দোকানে রূপান্তরিত করা হয়।

তার কথায়, "এখন বেশি লোক আসে না কারণ বেশিরভাগ মানুষ বিমানে চেপেই ভ্রমণ করেন। কিছু মোটরসাইকেল আরোহী আসে যারা শুধু চা-ই পান করেন।”

সেখানেই আমার সঙ্গে মি. আশফাক নামে এক শিক্ষকের দেখা হয়। এই রাস্তা নিয়ে তার অনেক স্মৃতি আছে।

তিনি বলছিলেন যে এই রাস্তাটিকে এন৪০-ও বলা হয়। এর বাণিজ্যিক গুরুত্ব হলো কোয়েটা থেকে ফল, শাকসবজি এবং অন্যান্য সামগ্রী এই লন্ডন রোড দিয়েই ইরানে যায়।

মি. আশফাক বলেন, “ছোটবেলায় বহুবার দেখেছি যে ডবল ডেকার বাসে চড়ে ব্রিটিশরা কোয়েটায় আসত। আমার বাবা-মা ইংরেজি ভাষা জানতেন না, কিন্তু তারা ইশারা দিয়ে বুঝিয়েই তাদের আমন্ত্রণ জানাতেন আমাদের বাড়িতে।”

এই রাস্তা দিয়ে কোয়েটা যাওয়ার পথে যে হোটেলগুলো তৈরি হয়েছিল তার মধ্যে ছিল লোডজ্ এবং ব্লুমস্টার হোটেল। আরও কয়েকটি ছোট হোটেলও ছিল।

লোডজ্ হোটেলটি ফিরোজ মেহতা নামে এক পার্শি চালু করেছিলেন ১৯৩৫ সালে।

এক সময় ওই হোটেলে বিদেশিদের ভিড় থাকত। কিন্তু এখন সেনা ছাউনির সীমানার মধ্যে পড়ে যাওয়ায় ওখানে যারা বেড়াতে আসেন তাদের কঠোর নিরাপত্তা তল্লাশির মুখোমুখি হতে হয়। তাই পর্যটকদের সংখ্যা অনেকটাই কমে গেছে।

লোডজ্-এর মালিকও আর পাকিস্তানে থাকেন না। হোটেলটির দেখাশোনা করেন মি. ডার নামে এক ম্যানেজার। তিনি আমাদের সঙ্গে কথা বলতে চাইছিলেন না।

তবে অন্যদিকে ব্লুমস্টার হোটেলের মালিক ফাহিম খান বিবিসি-র সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি জানালেন যে ১৯৭০-এর দশকে তার বাবা এই হোটেলটি চালু করেছিলেন।

তার কথায়, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা তার হোটেলে আসতেন এবং এখনও তাদের নাম, দেশের নাম এসব রেজিস্টারে রাখা আছে।

তিনি বলেন, “একটা সময় ছিল যখন এখানে পা ফেলার জায়গা থাকত না। মানুষ কোনো না কোনোভাবে চলে আসত এখানে।”

নিরাপত্তার বাড়াবাড়িতে বিরক্ত পর্যটকরা

ফাহিম খান আরও বলেন, নিরাপত্তা তল্লাশির কারণে পর্যটকদের সমস্যায় পড়তে হয়।

“যদি কেউ ইউরোপ থেকে এখানে আসন, তাকে সব জায়গায় ছাড়পত্র দেখাতে হয় অথবা ছাড়পত্র পাওয়ার জন্য হোটেলে অপেক্ষা করতে হয়। মানুষ বিরক্ত হয়ে যান এর ফলে। এই কারণে অনেক ইউরোপিয়ান পাকিস্তানে তিন-চার দিন থাকেন, অথচ ভারতে মাস ছয়েকও থেকে যান।”

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কারণে ইউরোপ থেকে পর্যটকদের সংখ্যা কমে যায়।

একই সঙ্গে অবৈধভাবে বিদেশে যাতায়াতকারীদের সহজ রুট হিসেবে কুখ্যাত হয়ে ওঠে এই সড়কপথ।

এরকম অনেক ঘটনা সামনে এসেছে যেখানে মানব পাচারকারীরা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখিয়ে পাকিস্তানি যুবকদের ইরান এবং তারপর তুরস্ক হয়ে এই রাস্তা দিয়েই ইউরোপে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে।

পরে ওই সব দেশের সীমান্ত পুলিশের হাতে এই যুবকরা হয় ধরা পড়ে বা গুলিতে প্রাণ হারায়।

কিন্তু রাস্তাটির নাম 'ডাঙ্কি রুট' হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও, এই সড়কটির ঐতিহাসিক গুরুত্বের কারণেই লন্ডন রোড দিয়ে যেতে চান, এমন পর্যটকেরও অভাব নেই।

দুমাস ধরে লন্ডন থেকে পাকিস্তান সফর

কোয়েটার বাসিন্দা ফটোগ্রাফার দানিয়াল শাহর বহু বছর ধরে ইচ্ছা ছিল এই রাস্তা দিয়ে ভ্রমণ করার। তিনি নিজের সেই ইচ্ছা পূরণ করেছেন।

মি. শাহ এখন বেলজিয়ামে পড়াশোনা করছেন।

বিবিসির সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মি. শাহ বলছিলেন, এই রাস্তা পেরোতে তার দুমাস সময় লাগে।

কথা বলার সময়ে তিনি রাস্তাটির নাম ‘ডাঙ্কি রুট’ বলেই উল্লেখ করছিলেন। তিনি এও বললেন যে অবৈধ অভিবাসীরা যেহেতু এই রাস্তা বেশি ব্যবহার করেন, তাই ইউরোপের কয়েকটি দেশের নিরাপত্তা চেকপোস্টে তাকে বাড়তি সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছিল।

তিনি বলেন, “যাত্রা শুরু করার পরেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম যে এই রাস্তা দিয়ে একজন পাকিস্তানি এবং একজন ব্রিটিশ পর্যটকের ভ্রমণের মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক। নিরাপত্তা চেকপোস্টে আমাকে যে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে, তা কিন্তু ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে আগতদের মোকাবিলা করতে হয় না।”

একটি উদাহরণ দিয়ে দানিয়াল শাহ বলছিলেন যে ক্রোয়েশিয়ায় তাকে অন্য যাত্রীদের থেকে আলাদা করা হয় এবং বেশ দুর্ব্যবহার করা হয়। এর একটাই কারণ, এই রাস্তাটি অবৈধ কাজের জন্য ব্যবহৃত হয়।

তিনি বলছিলেন এমনকি যারা পাকিস্তানে পৌঁছান, সেখানেও তাদের পিছু নেন নিরাপত্তা কর্মীরা। এরফলে এই রাস্তা দিয়ে ভ্রমণের অভিজ্ঞতাটা কিছুটা যেন তিক্ত হয়ে যায়।

"কিন্তু কী করা যাবে! ইউরোপীয় পর্যটকদের নিরাপত্তাটাও তো গুরুত্বপূর্ণ,” বলছিলেন দানিয়াল শাহ।