আধুনিক যুগের সবচেয়ে বিস্ময়কর প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলোর মাঝে অন্যতম – গৌতম বুদ্ধের দেহাবশেষের সঙ্গে সম্পর্কিত ঐতিহাসিক রত্নসম্ভার বুধবার হংকংয়ে আয়োজিত বিখ্যাত আর্ট নিলাম কোম্পানি সোদেবি'স-এর নিলামে তোলা হচ্ছে।
১৮৯৮ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের একটি ধূলিধুসর টিলা খুঁড়ে পাওয়া মূল্যবান এই রত্নগুলো এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে একটি বেসরকারি ব্রিটিশ সংগ্রহাগারে প্রায় দৃষ্টিচক্ষুুর আড়ালে রাখা ছিল।
এখন যেহেতু রত্নগুলোর হাতবদলের সময় এসেছে, তাই নতুন সংগ্রাহকরা আগ্রহভরে এগুলো সংগ্রহের জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু এখানে একটা অস্বস্তিও তৈরি হয়েছে।
গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান লুম্বিনীর কাছাকাছি, বর্তমানে ভারতের উত্তর প্রদেশে একটি ইটের ঘরের ভেতর থেকে প্রায় এক হাজার ৮০০টি মুক্তা, রুবি, টোপাজ, নীলা ও নকশা করা সোনার পাত সংগ্রহ করা হয়েছিলো। তবে এই রত্নগুলোর সাথে সাথে একটি খোদাই করা পাত্রে হাড়ের টুকরোও পাওয়া যায়, যেগুলোকে গৌতম বুদ্ধের দেহাবশেষ বলে শনাক্ত করা হয়।
এই আবিষ্কার তখন প্রত্নতত্ত্বের জগতে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিলো।
সোদেবি'স এশিয়ার চেয়ারম্যান নিকোলাস চাউ মনে করেন, স্মরণকালের বিস্ময়কর প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলোর মাঝে এই রত্নসম্ভার অন্যতম।
তবে এগুলো নিলামে তোলার কারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তৈরি হয়েছে, যে – ভারতের ইতিহাসের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে থাকা এবং বৌদ্ধকের কাছে পবিত্র এই সম্পদ বিক্রি করা কি নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য?
১৮৯৮ সালে ব্রিটিশ এস্টেট ম্যানেজার উইলিয়াম ক্ল্যাক্সটন পেপ্পে লুম্বিনির ঠিক দক্ষিণে, পিপ্রাওয়ায় অবস্থিত একটি ঢিবি খনন করেন।
সেখান থেকেই প্রায় দুই হাজার বছর আগের ওই নির্দশনগুলো খুঁজে পাওয়া যায়।
ইতিহাসবিদদের মতে, প্রাপ্ত রত্নসম্ভার ও দেহাবশেষ, যা তখনও পর্যন্ত অক্ষত ছিল, গৌতম বুদ্ধের শাক্য বংশের এবং বিশ্বব্যাপী বৌদ্ধদের ঐতিহ্য। হাড়ের নিদর্শনগুলো থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমারের মতো বিভিন্ন দেশে বিতরণ করা হয়েছে, যেখানে ওগুলো এখনও পূজা করা হয়।
ভারতের শিল্প ইতিহাসবিদ নমন আহুজা প্রশ্ন করেন, "বুদ্ধের দেহাবশেষ কি এমন কোনও পণ্য যেগুলোকে শিল্পকর্মের মতো বাজারে বিক্রি করা যায়? যদি তা না যায়, তাহলে বিক্রেতা এগুলোকে নিলামে তোলার নৈতিক অনুমোদন কোথা থেকে পেল?"
"যেহেতু বিক্রেতা নিজেকে 'রক্ষক' হিসেবে দাবি করছেন, আমি জানতে চাই – কার পক্ষ থেকে তিনি এই দায়িত্ব পালন করছেন? রক্ষক হলে কি বিক্রির অধিকারও পাওয়া যায়?"
উইলিয়াম পেপ্পের প্রপৌত্র, অর্থাৎ নাতির ছেলে ক্রিস পেপ্পে বিবিসিকে বলেন যে, তার পরিবার এই রত্নগুলোকে দান করার কথা ভেবেছিলো শুরুতে।
কিন্তু তাতেও জটিলতা দেখা দিয়েছে। তাই, এই নিদর্শনগুলো বৌদ্ধদের কাছে হস্তান্তরের জন্য নিলামই "সবচেয়ে ন্যায্য ও স্বচ্ছ উপায়" বলে মনে হয়েছে— বলেন তিনি।
সোদেবি'স-এর নিউ ইয়র্কে হিমালয়ান আর্ট বিভাগের প্রধান জুলিয়ান কিং বিবিসিকে বলেন, নিলামে তোলার আগে তারা রত্নগুলোর ব্যাপারে বিস্তৃত পর্যালোচনা করেছেন।
"যেসব গুরুত্বপূর্ণ বস্তু সোদেবি'সে বিক্রির জন্য তোলা হয়, আমরা সেগুলো যথাযথভাবে যাচাই করি। যার মধ্যে রয়েছে উৎস, বৈধতা, নির্ভেজালত্ব, শিল্পকর্ম ও সম্পদের জন্য আমাদের বিদ্যমান নীতিমালা ও মানদণ্ড অনুযায়ী অন্যান্য বিবেচনা," বলেন জুলিয়ান কিং।
লন্ডনের সোয়াস বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাশলে থম্পসন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় শিল্পের বিশেষজ্ঞ কিউরেটর কনান চিওং একটি যৌথ বিবৃতিতে বিবিসিকে বলেন, "এখানে আরও একটি নৈতিক প্রশ্ন উঠে আসছে। মানুষের শরীরের দেহাবশেষ কি বাণিজ্যের বস্তু হতে পারে? কোনটি মানব দেহাবশেষ, আর কোনটি নয়, এটি কে ঠিক করবে?"
তার মতে, বিশ্বের অনেক বৌদ্ধদের কাছে বিক্রির জন্য নিলামে তোলা রত্নগুলো হাড় ও ছাইয়ের অংশ, আলাদা কিছু নয়।
এই নিদর্শনগুলোর বিক্রি বৌদ্ধ নেতাদের মাঝেও উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
লন্ডনভিত্তিক ব্রিটিশ মহাবোধি সোসাইটির অমল আবেয়াওয়ার্দেনে বিবিসিকে বলেন, "বুদ্ধ আমাদের শেখান যে অন্যের জিনিস অনুমতি ছাড়া নেওয়া উচিত নয়।"
এই নিদর্শনগুলো সুরক্ষার দায়িত্ব শাক্য বংশকে দেওয়া হয়েছিল। তাদের ইচ্ছা ছিল মৃতদেহের সাথে এসব অলঙ্কার থাকবে, যাতে বুদ্ধের অনুসারীরা চিরকাল সেগুলোকে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারেন— বলেন তিনি।
ক্রিস পেপ্পে লিখেছেন যে, এই রত্নগুলো তার দাদার ভাইয়ের কাছে ছিলো। সেখান থেকে এগুলো তার চাচাতো ভাইয়ের হাতে এসেছে এবং পরবর্তীতে ২০১৩ সালে ওগুলো তার এবং তার আরও দুই চাচাতো ভাইয়ের কাছে আসে। তখনই তিনি এসব নিয়ে গবেষণা শুরু করেন।
লস অ্যাঞ্জেলেসভিত্তিক টেলিভিশন পরিচালক ও চলচ্চিত্র পরিচালক ক্রিস পেপ্পে লিখেছেন, ১৮৯৮ সালে রয়টার্স থেকে শুরু করে নিউ ইয়র্ক ট্রিবিউনের মতো বিভিন্ন সংবাদপত্রে বুদ্ধের দেহাবশেষ উদ্ধারের খবর প্রকাশিত হয়েছিলো। তিনি ওগুলো খুঁজে পেয়েছেন।
"ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ আমার কাছে লজ্জার ইতিহাস ছিল এবং এখনও তা একই রয়েছে। কিন্তু যারা ভারত থেকে বিভিন্ন মূল্যবান রত্ন ইংল্যান্ডে লুট করে নিয়ে এসেছিলো, তাদের মাঝে কারও কারও প্রধান উদ্দেশ্য ছিল জ্ঞানার্জন করা," তিনি লেখেন।
তিনি বলেন যে, তিনি গবেষণা করে তার পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পেরেছেন। অথচ, তাদেরকে তিনি একসময় "পক্ষপাতদুষ্ট ভিক্টোরিয়ান" মনে করতেন।
"আমি জেনেছি যে উইলি পেপ্পের প্রথম স্ত্রী তাদের হানিমুনে ভারত ভ্রমণ করতে চেয়েছিলেন। তিনি ভারত ও ভারতীয় সংস্কৃতিকে ভালোবাসতেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তিনি অজানা রোগে মারা যান। আমি এও জানি যে আমার দাদী ভারতের ভূমি আইনের ব্যাপারে অসন্তুষ্ট ছিলেন।"
এছাড়া, ১৮৯৭ সালের দুর্ভিক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত প্রজাদের কাজের সুযোগ তৈরি করার উদ্দেশ্যে উইলিয়াম পেপ্পে ওই ঢিবি খননের কাজ শুরু করেছিলেন বলেও তিনি জানান।
ক্রিস পেপ্পে এও লেখেন যে তার প্রপিতামহের বিভিন্ন কারিগরি নকশা থেকে বোঝা যায় যে তিনি একজন দক্ষ প্রকৌশলী ছিলেন, যিনি কোনও প্রকল্পের সম্ভাবনাকে উপেক্ষা করতে পারতেন না।
উইলিয়াম পেপ্পে ওইসময় এসব নিদর্শন ঔপনিবেশিক ভারত সরকারের হাতে তুলে দেন। তার তুলে দেওয়া হাড়ের নিদর্শনগুলো যায় সিয়ামের বৌদ্ধ রাজার (রামা পঞ্চম) কাছে। আরও কিছু নিদর্শন পাঠানো হয় তৎকালীন ইম্পেরিয়াল মিউজিয়াম অব ক্যালকাটায়।
প্রাপ্ত নিদর্শনগুলোর অল্প কিছু অংশ (যেগুলোর প্রতিলিপি ছিল) তিনি নিজে রাখার অনুমতি পেয়েছিলেন, যা পরবর্তীতে পেপ্পে পরিবারের কাছে রয়ে যায়। নিলাম কোম্পানি সোদেবি'স বলছে, ওইসময় উইলিয়াম পেপ্পে প্রায় এক-পঞ্চমাংশ আবিষ্কারের মালিকানা পেয়েছিলেন।
সূত্র থেকে বিবিসি জানতে পারে, সোদেবি'স মনে করে যে উইলিয়াম পেপ্পের মালিকানায় থাকা ডুপ্লিকেট বস্তুগুলো মূল নিদর্শনের অংশ। ওগুলোকে বাড়তি হয়ে যাওয়ায় দান করা হয়েছিলো, পরে "ভারত সরকার উইলিয়াম পেপ্পেকে ওগুলো রাখার অনুমতি দিয়েছিলো।"
গত ছয় বছরে ওই রত্নগুলো বিশ্বের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রদর্শনীতে দেখানো হয়েছে। পেপ্পে পরিবার এ নিয়ে তাদের গবেষণা তুলে ধরে একটি ওয়েবসাইটও চালু করেছে।
অনেকে মনে করেন, বুদ্ধের নিদর্শনকে কখনোই পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা উচিত নয়।
" ঔপনিবেশিক সহিংস আচরণের অংশ হিসাবেই এই নিলাম অত্যন্ত পবিত্র এই বস্তুগুলোকে সোদেবি'স বিক্রয়যোগ্য বস্তুতে পরিণত করেছে, যা একটি মঠ থেকে বের করে নেয়া হয়েছে এবং সেখানে থাকা দেহের ছাই বা অস্থি থেকে আলাদা করে রত্ন হিসাবে ইউরোপীয়ানদের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে" বলেন থম্পসন ও চিওং ।
তবে ক্রিস পেপ্পে বিবিসিকে বলেন, তিনি যেসব মঠ পরিদর্শন করেছেন, সেগুলোতে কোনও বৌদ্ধ এই রত্নগুলোকে শারীরিক দেহাবশেষ হিসেবে গণ্য করেননি।
"পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করা কয়েকজন বৌদ্ধ একাডেমিক সম্প্রতি একটি জটিল এবং বাস্তবতাবিবর্জিত যুক্তির মাধ্যমে এগুলোকে দেহাবশেষ হিসেবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। যা সাধারণ বৌদ্ধদের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মেলে না," তিনি বলেন।
ক্রিস পেপ্পে বলেন যে, তার পরিবার প্রথমে এই নিদর্শনগুলো মন্দির ও জাদুঘরে দান করার চিন্তা করেছিলো।
"কিন্তু সেখানে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। তাই এই নিদর্শনগুলো বৌদ্ধদের কাছে হস্তান্তরের জন্য নিলামই সবচেয়ে স্বচ্ছ এবং ন্যায়সঙ্গত উপায় বলে আমরা মনে করি।"
উল্লেখ্য, রত্ন প্রসঙ্গ এলেই অনেক মানুষ কোহিনূরের প্রসঙ্গ টানেন, যেটি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দখল করেছিল এবং এখন এটি ব্রিটেনের রাজ রত্মভান্ডারের অংশ। অনেক ভারতীয় এটিকে ভারত থেকে চুরি করে আনা রত্ন হিসেবে দেখেন।
তাহলে বুদ্ধের দেহাবশেষের সাথে সম্পর্কিত রত্নগুলোর ব্যাপারে কী বলা হবে?
এর উত্তরে নমন আহুজা বলেন, "পুনরায় ফিরিয়ে আনা সবসময় প্রয়োজন হয় না।"
"কিন্তু এমন বিরল ও পবিত্র নিদর্শন, যা একটি ভূখণ্ডের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অংশ— তাই এ বিষয়টিতে সরকারের বিশেষ মনোযোগ দেওয়া উচিত," তিনি বলেন।