মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (ইউএসএআইডি) কর্মীসংখ্যা ১০ হাজার থেকে কমিয়ে তিনশরও নিচে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা করেছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশে ইউএসএআইডি-নির্ভর মানবিক সহায়তা, স্বাস্থ্যসেবা ও উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাপকভাবে ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বৃহস্পতিবার (৬ ফেব্রুয়ারি) নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে।
কর্মী ছাঁটাই ও ইউএসএআইডি বন্ধে আইনি লড়াই
ইউএসএআইডির কর্মীদের প্রতিনিধিত্বকারী দুটি ইউনিয়ন ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে, যেখানে দাবি করা হয়েছে কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়া সংস্থাটি বিলুপ্ত করা যাবে না।
এদিকে, এএফপির পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলেও মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য করেনি।
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউএসএআইডি প্রায় ৮০০টি অনুদান ও চুক্তি বাতিলের নির্দেশ দিয়েছে। এতে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রকল্পগুলোও ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।
বিশ্বজুড়ে ইউএসএআইডির কার্যক্রম ও সংকট
ইউএসএআইডি বিশ্বের ১২০টিরও বেশি দেশে স্বাস্থ্য, খাদ্য নিরাপত্তা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, শিক্ষা ও গণতন্ত্র উন্নয়নে অর্থায়ন করে থাকে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ইউএসএআইডি প্রতি বছর প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলারের উন্নয়ন সহায়তা প্রদান করে। এখন এই ছাঁটাইয়ের ফলে আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতপূর্ণ দেশগুলোতে খাদ্য নিরাপত্তার ভয়াবহ সংকট দেখা দিতে পারে। সারা বিশ্বের বহু দেশে এইচআইভি প্রতিরোধ, টিকাদান কর্মসূচি ও মাতৃস্বাস্থ্য প্রকল্প ঝুঁকির মুখে পড়বে। ভূমিকম্প, বন্যা বা মহামারির মতো দুর্যোগে জরুরি সহায়তার পরিমাণ কমে যেতে পারে।
বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র, মুক্ত সাংবাদিকতা ও মানবাধিকার উন্নয়নে ইউএসএআইডি যে সহায়তা দিয়ে আসছে, তা ব্যাপকভাবে সঙ্কুচিত হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক প্রভাবের হ্রাস
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউএসএআইডির সঙ্কোচন যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক প্রভাব কমিয়ে দেবে এবং এর ফলে চীন, রাশিয়া ও ইউরোপীয় দাতাদের প্রভাব বাড়তে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) ইতোমধ্যেই বহু উন্নয়নশীল দেশে প্রভাব বিস্তার করছে। ইউএসএআইডি দুর্বল হলে চীনের বিনিয়োগ আরও প্রভাবশালী হয়ে উঠতে পারে।
ট্রাম্প প্রশাসনের অবস্থান
ট্রাম্প ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইলন মাস্ক ইউএসএআইডিকে আক্রমণ করে বলেছেন, এটি ‘উগ্র-বামপন্থি মার্ক্সবাদীদের আস্তানা’।
মার্কিন প্রশাসনের দাবি, সরকারি ব্যয় সঙ্কোচন ও আমেরিকানদের ওপর থেকে করের চাপ কমানোর জন্য ইউএসএআইডির মতো সংস্থাগুলো কমানো প্রয়োজন।
কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ
মার্কিন কংগ্রেসের কিছু সদস্য ইউএসএআইডির বিরুদ্ধে ট্রাম্প প্রশাসনের এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করছেন। পাশাপাশি জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পদক্ষেপের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক নেতৃত্বের অবস্থান দুর্বল হতে পারে এবং বৈশ্বিক মানবিক সংকট আরও গভীর হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশে ইউএসএআইডির কার্যক্রম
বাংলাদেশে ইউএসএআইডি দীর্ঘদিন ধরে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, কৃষি, নারী অধিকার ও গণতন্ত্র উন্নয়নসহ বিভিন্ন খাতে সহায়তা দিয়ে আসছে।
বর্তমানে ইউএসএআইডি বাংলাদেশে ব্যাপক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। বিশেষ করে এইচআইভি প্রতিরোধ, ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ, শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহায়তা কর্মসূচি ইউএসএআইডির অর্থায়নে পরিচালিত হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বৈদেশিক সহায়তা সংক্রান্ত ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, ২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশকে প্রতিবছর দেওয়া সহায়তার পরিমাণ ৫০০ মিলিয়ন বা ৫০ কোটি ডলারের কাছাকাছি। এর আগের বছরগুলোতে ২৫০ থেকে ৩০০ মিলিয়ন ডলারের মার্কিন সহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ। সর্বশেষ ২০২৪ সালে এই পরিমাণ প্রায় ৪৯০ মিলিয়ন ডলার।
ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট বা ইউএসএইড এর তথ্য বলছে, এই অর্থ যেসব খাতে ব্যবহৃত হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, গণতন্ত্র ও শাসনব্যবস্থা, পরিবেশ ও জ্বালানি ও মানবিক সহায়তা। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের জরুরি সহায়তার জন্যও বরাদ্দ ছিল এতে।
সম্ভাব্য প্রভাব
অন্যান্য বরাদ্দ বন্ধ হয়ে গেলেও রোহিঙ্গাদের খাদ্য ও পুষ্টি কার্যক্রমের অর্থায়ন বজায় থাকবে, ইউএসএইডের বরাতে এমনটি জানিয়েছে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং।
বিশ্লেষকদের মতে, ইউএসএআইডির কার্যক্রম সঙ্কুচিত হলে বাংলাদেশে মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য প্রকল্পে অর্থায়ন কমতে পারে।
বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় ইউএসএআইডির বিভিন্ন কর্মসূচি ব্যাহত হতে পারে। নারী শিক্ষা, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ ও লিঙ্গ-সমতার উন্নয়নে চলমান বহু প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ার হুমকিতে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ও বাংলাদেশের কূটনৈতিক কৌশল
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউএসএআইডি বন্ধ হয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশে কৌশলগত উপস্থিতি কমে যাবে, যা চীন, ভারত ও ইউরোপীয় দাতাদের প্রভাব বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করতে পারে।
ঢাকার কূটনৈতিক মহল মনে করছে, বাংলাদেশ সরকার এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিকল্প আন্তর্জাতিক উৎস থেকে তহবিল সংগ্রহের চেষ্টা করবে।
এদিকে, মার্কিন কংগ্রেসের কিছু প্রভাবশালী সদস্য ইউএসএআইডি সঙ্কোচনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তবে, ট্রাম্প প্রশাসন আপাতত তার সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার ইউএসএআইডির ভবিষ্যৎ কর্মসূচি নিয়ে ওয়াশিংটনের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে, তবে এখনও চূড়ান্ত কোনো ঘোষণা আসেনি। এনটিভি।