বিদায় নিচ্ছে ২০২৪। বছরজুড়েই আলোচনায় ছিল গাজা যুদ্ধ। ২০২৩ সালের অক্টোবরে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে গাজায় যুদ্ধ শুরু হয়, যা এখনো চলছে। গাজায় নজিরবিহীন নৃশংসতার মধ্যেই গত সেপ্টেম্বরে লেবাননে হামাসের মিত্র হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে হামলা জোরদার করে ইসরাইল। গত প্রায় ১৪ মাসে ইসরাইলি হামলায় ইরান-সমর্থিত সশস্ত্র সংগঠন হামাস ও হিজবুল্লাহর অনেক নেতা নিহত হয়েছেন।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরাইলি সীমান্তে অনুপ্রবেশ করে আকস্মিক হামলা চালায় ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস। এরপর থেকে গাজায় নৃশংস হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। একই সঙ্গে প্রতিশোধ হিসেবে ৭ অক্টোবরের হামাসের হামলার নেপথ্যের নায়কদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। গত সেপ্টেম্বরে লেবাননেও বিস্তৃত হয়েছে ইসরাইলের এই অভিযান। যুদ্ধ শুরুর পর গত ১৪ মাসে বোমা হামলা, গুপ্তহত্যাসহ বিভিন্ন কৌশলে ইরান সমর্থিত সংগঠনগুলোর নেতাদের হত্যার মিশনে রয়েছে ইসরাইল।
সবশেষ গত ১৭ নভেম্বর লেবাননের রাজধানী বৈরুতের রস আল-নাবা এলাকায় হিজবুল্লাহর মিডিয়া শাখার প্রধান মোহাম্মদ আফিফকে হত্যা করে ইসরাইল। এর আগে হামাসের শীর্ষ নেতা ইসমাইল হানিয়া, ইয়াহিয়া সিনওয়ার, ৩২ বছর ধরে হিজবুল্লাহর নেতৃত্ব দেয়া হাসান নাসরুল্লাহকেও হত্যা করে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী।
২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরাইলের হাতে নিহত হামাস ও হিজবুল্লাহর গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক:
সালেহ আল-আরৌরি
হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতা সালেহ আল-আরৌরি সংগঠনটির সামরিক শাখার একজন প্রতিষ্ঠাতা কমান্ডার এবং হামাস ও হিজবুল্লাহর মধ্যে প্রধান যোগাযোগকারী ছিলেন। চলতি বছরের ২ জানুয়ারি বৈরুতের দক্ষিণ উপকণ্ঠে হিজবুল্লাহর শক্ত ঘাঁটিতে ড্রোন হামলায় তিনি নিহত হন। ৫৭ বছর বয়সী আরৌরি ছিলেন ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর উপ-প্রধান এবং গ্রুপটির সশস্ত্র শাখা কাসাম ব্রিগেডের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।
১৯৮৭ সালে হামাসে যোগ দেন আরৌরি। এরপর তিনি পশ্চিম তীরে সংগঠনটি সামরিক উপস্থিতি বাড়ানোর ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেন। ইসরাইলি কারাগারে ১৫ বছর কাটানোর পর লেবাননে দীর্ঘদিন ধরে নির্বাসিত জীবনযাপন করছিলেন আরৌরি।
মারওয়ান ইসা
গত ১০ মার্চ গাজার নুসেইরারাত শরণার্থীশিবিরের নিচে টানেলে বোমা হামলায় নিহত হন হামাসের ডেপুটি কমান্ডার মারওয়ান ইসা। তাকে ইসরাইলে ৭ অক্টোবর হামলার অন্যতম মাস্টারমাইন্ড মনে করা হয়। হামাসের সামরিক শাখা আল-কাসাম ব্রিগেডের ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন ইসরাইলের কাছে মোস্ট ওয়ান্টেড। ইসা মারওয়ান প্রথম ফিলিস্তিনি ইন্তিফাদার সময় পাঁচ বছর ইসরাইলের কারাগারে বন্দি ছিলেন।
তালেব সামি আবদুল্লাহ
গত জুনে ইসরাইলি হামলায় নিহত হন হিজবুল্লাহর শীর্ষ কমান্ডার তালেব আবদুল্লাহ। জুন পর্যন্ত ইসরাইলের সঙ্গে লেবাননের সংঘর্ষ শুরুর পর থেকে নিহত কমান্ডারদের মধ্যে আবদুল্লাহ ছিলেন হিজবুল্লাহর সর্বোচ্চ পদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন।
মোহাম্মদ দেইফ
ইসরাইলে ৭ অক্টোবরের হামলার মাস্টারমাইন্ড মনে করা হয় মোহাম্মদ দেইফকে। গত ১৩ জুলাই খান ইউনিসে এক বোমা হামলায় নিহত হন। তবে ১ আগস্ট দেইফের মৃত্যুর কথা জানায় ইসরাইলি সামরিক বাহিনী।
গাজায় হামাসের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় অসংখ্য টানেল বা সুড়ঙ্গ রয়েছে। এ নেটওয়ার্ক উন্নয়নে কাজ করেছেন দেইফ। এছাড়া তিনি হামাসের বোমা বানানোর প্রকল্পে ভূমিকা রেখেছেন। সচরাচর প্রকাশ্যে আসতেন না দেইফ। জন্মের সময় দেইফের নাম রাখা হয়েছিল মোহাম্মদ ডিয়াব ইব্রাহীম আল-মাসরি। কিন্তু ইসরাইলি বিমান হামলা হতে বাঁচতে তাকে যেভাবে সারাক্ষণ যাযাবরের মতো জীবন-যাপন করতে হয়, পরে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেন ‘দেইফ’ নামে, আরবিতে যার অর্থ ‘অতিথি’।
ইসমাইল হানিয়া
গত ৩১ জুলাই ইরানে ইসরাইলি হামলায় নিহত হওয়া ইসমাইল হানিয়া ছিলেন হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধান। দায়িত্ব পালন করেছেন ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠনটির সূচনালগ্ন থেকেই এর সদস্য ছিলেন হানিয়া। ইরানের নতুন প্রেসিডেন্টের অভিষেক অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার পর তেহরানে যে বাড়িতে অবস্থান করছিলেন, সেখানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নিহত হন তিনি।
ফুয়াদ শুকর
গত জুলাইয়ের শেষ দিকে লেবাননে বিমান হামলা চালিয়ে হত্যা করে হিজবুল্লাহর শীর্ষ কমান্ডার ফুয়াদ শুকরকে। তিনি হিজবুল্লাহর প্রয়াত প্রধান হাসান নসরুল্লাহর সামরিক উপদেষ্টা ছিলেন। হিজবুল্লাহর এ কমান্ডার সশস্ত্র গোষ্ঠীটির অপারেশন সেন্টারের প্রধান হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন।
ইব্রাহিম আকিল
গত ২০ সেপ্টেম্বর ইসরাইলের বিমান হামলায় ইব্রাহিম আকিল নামে হিজবুল্লাহর এক জ্যেষ্ঠ কমান্ডার নিহত হন। লেবাননের রাজধানী বৈরুতের শহরতলিতে ইসরাইলের এ বিমান হামলা তিনি নিহত হন। ইব্রাহিম আকিল পরিচিত ছিলেন তাহসিন নামে। তিনি হিজবুল্লাহর শীর্ষ সামরিক দলে ছিলেন। ইব্রাহীম আকিলের মাথার জন্য ৭০ লাখ মার্কিন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছিল মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
হাসান নাসরুল্লাহ
১৯৯২ সালে মাত্র ৩২ বছর বয়সে হিজবুল্লাহর প্রধান হন হাসান নাসরুল্লাহ। গত ২৭ সেপ্টেম্বর বৈরুতে ইসরাইলের হামলায় নিহত হন তিনি। ওই দিন রাতে রাজধানী বৈরুতসহ লেবাননের বিভিন্ন জায়গায় রাতভর বিমান হামলা চালায় ইসরাইল। পরদিন ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘হাসান নাসরুল্লাহ আর বিশ্বে সন্ত্রাসবাদ পরিচালনা করতে পারবেন না।’ একইদিন হিজবুল্লাহর পক্ষ থেকেও হাসান নাসরুল্লাহর মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করে হিজবুল্লাহ।
ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দফতর থেকে হিজবুল্লাহপ্রধানকে হত্যার নির্দেশ দেন। তার নির্দেশ অনুযায়ী ইসরাইলের যুদ্ধবিমান যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া ২০০০ পাউন্ডের বোমা লেবাননের রাজধানী বৈরুতে ফেলে। এতে নাসরুল্লাহসহ বেশ কয়েকজন বেসামরিক নাগরিকও নিহত হন।
নাবিল কাওউক
হিজবুল্লাহর প্রয়াত প্রধান হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যার পর ২৮ সেপ্টেম্বর নাবিল কাওউক নামে আরেক হিজবুল্লাহ নেতাকে হত্যা করে ইসরাইল। নাবিল কাওউক হিজবুল্লাহর নিরাপত্তা কাউন্সিলের প্রধান ছিলেন। এছাড়া সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন তিনি।
হাশেম সাফিউদ্দিন
অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে বৈরুতের দক্ষিণের শহরতলিতে হিজবুল্লাহর সম্ভাব্য প্রধান হাশেম সাফিউদ্দিনকে লক্ষ্য করে ব্যাপক বিমান হামলা চালায় ইসরাইলি বাহিনী। এরপর থেকে সাফিউদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না বলে লেবাননের একটি নিরাপত্তা সূত্র নিশ্চিত করে।
৯ অক্টোবর ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু হিজবুল্লাহর সম্ভাব্য উত্তরসূরিদের নাম উচ্চারণ না করেই বলেন, ‘আমরা হিজবুল্লাহ’র সক্ষমতা ক্ষুণ্ণ করেছি। আমরা নাসরুল্লাহকে এবং নাসরুল্লাহর বিকল্প ও তারও বিকল্প নেতাসহ হাজার হাজার সন্ত্রাসীকে শেষ করে দিয়েছি।’ এরপর ২৩ অক্টোবর এক বিবৃতিতে হিজবুল্লাহ জানিয়েছে, কয়েক সপ্তাহ আগে ইসরাইলি বিমান হামলায় হিজবুল্লাহর অন্যতম শীর্ষ নেতা হাশেম সাফিউদ্দিন নিহত হয়েছেন।
ইয়াহিয়া সিনওয়ার
হামাস এবং হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযানে ইসরাইলের অন্যতম বড় সাফল্য মনে করা হয় ইয়াহিয়া সিনওয়ার হত্যাকাণ্ড। গত আগস্টে ইসমাইল হানিয়ার উত্তরসূরি হিসেবে হামাস তাদের রাজনৈতিক ব্যুরো প্রধান হিসেবে সিনওয়ারকে নির্বাচিত করে। গত ১৭ অক্টোবর হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে হত্যার দাবি করে ইসরাইল। ইসরাইলি সামরিক বাহিনী জানায়, দক্ষিণ গাজার রাফায় ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় সিনওয়ার নিহত হন।
৬১ বছর বয়সি ইয়াহিয়া সিনওয়ার বেশিরভাগ সময় গাজা উপত্যকার নিচে সুড়ঙ্গের ভেতরে লুকিয়ে ছিলেন। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামাসের নজিরবিহীন হামলার মাস্টারমাইন্ড, তথা মূল পরিকল্পনাকারী সিনওয়ার ছিলেন বলে ধারণা করা হয়।
ইয়াহিয়া সিনাওয়ার তরুণ বয়স থেকেই সম্পৃক্ত হন ইসলামি আন্দোলনের সঙ্গে। নেতৃত্ব দেন ইহুদিবিরোধী বিভিন্ন অভিযানে। ইসরাইলি সেনাদের হাতে গ্রেফতার হয়ে ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কারাগারে ছিলেন তিনি। ১৯৮০-এর দশকের শেষ দিকে হামাসে যোগ দেন। শুরুতে সংগঠনের সামরিক শাখা ইজ্জেদিন কাসেম ব্রিগেডের সদস্য হিসেবে কাজ শুরু করেন। তার নেতৃত্বে বেশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে হামাসের সামরিক কার্যক্রম।
মোহাম্মদ আফিফ
সবশেষ ১৭ নভেম্বর লেবাননের রাজধানী বৈরুতের মধ্যাঞ্চলে ইসরাইলের হামলায় হিজবুল্লাহর মুখপাত্র মোহাম্মদ আফিফ নিহত হন। বেশ কয়েক বছর ধরে আফিফ হিজবুল্লাহর গণমাধ্যম সম্পর্ক বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। প্রায়ই নাম না প্রকাশ করে তিনি স্থানীয় ও বিদেশি সাংবাদিকদের তথ্য সরবরাহ করতেন। ২০০৬ সালে হিজবুল্লাহ ও ইসরাইল যখন যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তখন প্রথম হিজবুল্লাহর টেলিভিশন চ্যানেল আল-মানারের তথ্য পরিচালক হিসেবে পরিচিতি পান আফিফ।