News update
  • Dhaka seeks global pressure on Myanmar for lasting peace     |     
  • BSEC Chairman’s resignation urged to stabilise stock market     |     
  • Rain, thundershowers likely over 8 divisions: BMD     |     
  • First freight train leaves Mongla carrying molasses     |     
  • 2 dead, six hurt in Sherpur micro-autorickshaw-motorbike crash     |     

যেভাবে রাখাইন রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী

বিবিসি বাংলা সংঘাত 2024-12-16, 6:17pm

img_20241216_181229-31b1cbd844334439efc5e14208390b881734351434.png




প্রথমে ভাঙা ভাঙা শব্দে মাইকে আত্মসমর্পণের আহ্বান, তারপর প্রচণ্ড শব্দে গোলাবর্ষণ, রকেট ও রাইফেলের গুলির শব্দ, যা ভবনের বড় একটি অংশ ধসিয়ে দেয়। এই ভবনগুলোতে শত শত সৈন্য লুকিয়ে ছিল।
বিজিপি-৫ অর্থাৎ বর্ডার গার্ড পুলিশ ছিল উত্তর রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার শেষ প্রতিরোধ স্থল, যার অবস্থান বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেঁষে।
বিদ্রোহী আরাকান আর্মির (এএ) ঘাঁটি ঘেরাও করার এক ভিডিওতে দেখা যায়, তাদের রঙচটা পোশাক পরা এবং খালি পায়ে থাকা যোদ্ধারা বিভিন্ন অস্ত্র নিয়ে ঘাঁটিতে গুলি চালাচ্ছে। তখন তাদের মাথার উপর দিয়ে বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমান উড়ছিল।
এটি ছিল এক ভয়াবহ যুদ্ধ – হয়তো এখন পর্যন্ত মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী ঘটনা, যা ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে চলছে।
"তারা ঘাঁটির চারপাশে বড় গর্ত খুঁড়ে তাতে ধারালো খুঁটি বসায়," আরাকান আর্মির এক সদস্য বিবিসিকে জানায়।
"সেখানে বেশ কয়েকটি বাঙ্কার ও প্রতিরক্ষা ভবন ছিল। তারা এর আশেপাশে এক হাজারের বেশি স্থল মাইন পুঁতে রেখেছিল, যেগুলো পার হতে গিয়ে আমাদের অনেক যোদ্ধা হাত-পা হারিয়েছে, অনেকে মারা গিয়েছে।"
এক বছরের সামরিক বিপর্যয়ের পর এটি অভ্যুত্থানকারীদের নেতা জেনারেল মিন অং হ্লাইং-এর জন্য আরেকটি শোচনীয় পরাজয় ছিল।
প্রথমবারের মতো তার সেনাবাহিনী পুরো একটি সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। মিয়ানমার ও বাংলাদেশের ২৭০ কিমি (১৭০ মাইল) সীমান্ত এখন পুরোপুরি আরাকান আর্মির দখলে।
এখন শুধুমাত্র রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিতওয়ে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আছে, তবে এটি দেশের বাকি অংশ থেকে আলাদা।
আরাকান আর্মি সম্ভবত প্রথম কোনও বিদ্রোহী গোষ্ঠী, যারা পুরো একটি রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিতে চলেছে।
মিয়ানমার সেনাবাহিনী চলতি বছরের শুরু থেকেই আরাকান আর্মির কাছে পরাজিত হয়ে একের পর এক শহরের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে।
সেপ্টেম্বরে সেনাবাহিনীর সবশেষ ইউনিট বিজিপি-৫ এ গিয়ে অবস্থান নেয়, যা মংডু সীমান্ত শহরের বাইরে প্রায় ২০ হেক্টর এলাকা জুড়ে অবস্থিত, যেখানে আরাকান আর্মি তাদেরকে ঘিরে রাখে।
বিজিপি-৫ তৈরি হয়েছিল মুসলিম রোহিঙ্গা গ্রামের মিও থু জি নামে এক অঞ্চলে। যে জায়গাটি থেকে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের উৎখাত করেছিল সশস্ত্র বাহিনী এবং তারা রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরও পুড়িয়ে দেয়।
বিবিসি সংবাদদাতা ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে সামরিক অভিযানের পর মংডুতে যান। সেখানে তিনি পুড়ে যাওয়া গ্রাম দেখতে পান, সেখানকার গাছপালায়ও পোড়ার চিহ্ন পাওয়া যায়।
সে সময় অনেক রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছিল, যার কারণে বহু রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
দুই বছর পর সেই একই জায়গায় গিয়ে বিবিসি সংবাদদাতা দেখতে পান, নতুন পুলিশ কমপ্লেক্স তৈরি হয়েছে, সব গাছ কেটে ফেলা হয়েছে যাতে হামলাকারীদের সহজেই দেখা যায়।
আরাকান আর্মির সদস্য বিবিসিকে জানায়, তারা ধীরে ধীরে ক্যাম্পের দিকে এগিয়েছে, আর নিজেদের আড়াল করার জন্য গর্ত খুঁড়েছে।
তবে আরাকান আর্মি তাদের ক্ষয়ক্ষতির সংখ্যা প্রকাশ করেনি, অর্থাৎ তাদের কতজন যোদ্ধা মারা গেছে, সেই সংখ্যা বলেনি।
যদিও জুন মাসে মংডুতে শুরু হওয়া যুদ্ধের তীব্রতা থেকে অনুমান করা যায়, তাদের শত শত যোদ্ধা নিহত হয়েছে।
অবরোধ চলাকালীন, মিয়ানমারের বিমান বাহিনী মংডুতে অবিরাম বোমাবর্ষণ করে। এতে সেখানকার বেসামরিক নাগরিক পালাতে বাধ্য হয়।
বিমানগুলো রাতে অবরুদ্ধ সেনাদের জন্য খাবার সরবরাহ করতো, কিন্তু তা যথেষ্ট ছিল না।
একটি স্থানীয় সূত্র বিবিসিকে জানায়, বাঙ্কারগুলোতে প্রচুর চাল ছিল, কিন্তু আহতদের চিকিৎসার সুযোগ ছিল না। এতে সৈন্যদের মনোবল ভেঙে পড়ে।
এরপর গত সপ্তাহ থেকে তারা আত্মসমর্পণ করতে শুরু করে।
আরাকান আর্মির ভিডিওতে দেখা যায়, সেনা সদস্যরা শোচনীয় অবস্থায় সাদা কাপড় নাড়িয়ে বেরিয়ে আসছে।
কেউ কেউ ক্রাচে ভর করে খুঁড়িয়ে হাঁটছে, কারও পা কাপড়ে মোড়ানো। বেশিরভাগের পায়ে জুতা ছিল না।
বিধ্বস্ত ভবনগুলোর ভেতরে বিজয়ী বিদ্রোহীরা অনেক মৃতদেহের স্তূপ খুঁজে পায়।
আরাকান আর্মি দাবি করেছে যে এই অবরোধে ৪৫০ জনের বেশি সেনা নিহত হয়েছেন।
তারা বন্দী কমান্ডার, ব্রিগেডিয়ার-জেনারেল থুরেইন টুনসহ তার কর্মকর্তাদের আটক হওয়ার ভিডিও প্রকাশ করে।
সেখানে দেখা যায়, তারা আরাকান আর্মির পতাকার খুঁটির নীচে হাঁটু গেড়ে বসে আছে এবং উপরে বিদ্রোহীদের ব্যানার উড়ছে।
"মিন অং হ্লাইং, তুমি তোমার সন্তানদের কাউকে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বলোনি" এক জন লিখেছেন।
"তুমি কি আমাদের এভাবে ব্যবহার করছো? রাখাইনে এত মৃত্যু দেখে তুমি কি খুশি?" লিখেছেন আরেক জন।
"এমনটা চলতে থাকলে, টাটমাডো (সেনাবাহিনী) থেকে শুধু মিন অং হ্লাইং আর একটি পতাকার খুঁটিই অবশিষ্ট থাকবে," আরেক ব্যক্তি মন্তব্য করেছেন।
বিজিপি-৫ এর দখল প্রমাণ করে যে আরাকান আর্মি (এএ) মিয়ানমারের সবচেয়ে শক্তিশালী বিদ্রোহী দলগুলোর একটি।
এটি গঠিত হয়েছিল ২০০৯ সালে—মিয়ানমারের অন্য বিদ্রোহী দলগুলোর চেয়ে অনেক পরে।
রাখাইন সম্প্রদায়ের তরুণরা এই দলটি তৈরি করেছিল, যারা কাজের খোঁজে দেশের অন্য প্রান্তে চীন সীমান্তে গিয়েছিল।
আরাকান আর্মি হলো থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের অংশ, যারা গত বছর থেকে জান্তার পরাজয়ের সবচেয়ে বড় কারণ।
এই জোটের অন্য দুই দল শান রাজ্যের সীমান্তে অবস্থান করছে।
কিন্তু আরাকান আর্মি আট বছর আগে রাখাইনে ফিরে আসে এবং নিজেদের সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য সেখানে সশস্ত্র লড়াই শুরু করে।
দারিদ্র্য, বিচ্ছিন্নতা আর কেন্দ্রীয় সরকারের অবহেলার কারণে রাখাইন জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে ঐতিহাসিক ক্ষোভ পুঞ্জিভূত ছিল, তার ভিত্তিতেই এই লড়াই শুরু হয়।
আরাকান আর্মি প্রমাণ করেছে যে তাদের নেতারা বুদ্ধিমান, শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং নিজেদের যোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করতে সক্ষম।
তারা রাখাইন রাজ্যের যে বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে, সেটি এমনভাবে পরিচালনা করছে যেন নিজেদের রাজ্যই চালাচ্ছে তারা।
ভালো অস্ত্রও পেয়েছে তারা। কারণ চীন সীমান্তের পুরনো বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে তাদের যোগাযোগ আছে। ধারণা করা হয়, তাদের যথেষ্ট অর্থও রয়েছে।
কিন্তু একটি বড় প্রশ্ন থেকে যায়— বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বিদ্রোহী দলগুলো সামরিক জান্তাকে উৎখাতের লক্ষ্য অর্জনকে কতটা অগ্রাধিকার দেবে?
সামরিক অভ্যুত্থানে যে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে, তাদের সাথে তাল মিলিয়ে তারাও প্রকাশ্যে বলছে, তারা সেটা করতে চায়। ক্ষমতাচ্যুত ওই সরকারের সমর্থনে প্রতিবাদ জানাতে শত শত স্বেচ্ছাসেবী পিপলস ডিফেন্স ফোর্সে যোগ দিয়েছিল।
বিদ্রোহীদের সহযোগিতার জন্য ছায়া সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে তারা একটি নতুন ফেডারেল সিস্টেম বানাবে, যেখানে মিয়ানমারের অঞ্চলগুলো স্বায়ত্তশাসনের সুযোগ পাবে।
কিন্তু ইতিমধ্যে থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের অন্য দুই দল চীনের অনুরোধে যুদ্ধবিরতি মেনে নিয়েছে।
চীন চায় আলোচনার মাধ্যমে গৃহযুদ্ধ বন্ধ হোক, যার কারণে নিশ্চিতভাবে সেনাবাহিনী তাদের ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে।
বিরোধীরা দাবি করছে, সেনাবাহিনীকে সংস্কার করতে হবে এবং রাজনীতি থেকে সরে যেতে হবে।
কিন্তু সামরিক জান্তার কাছ থেকে এত বেশি এলাকা দখলে নেয়ার পরেও জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো হয়তো সামরিক শাসকদের হটানোর পরিবর্তে চীনের মধ্যস্থতায় একটি সমঝোতা করতে চাইবে।
এএ-র বিজয় আরও বড় প্রশ্ন তুলেছে।
"মংডু ও এর আশেপাশের গ্রামগুলোর ৮০ শতাংশ ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে," এক রোহিঙ্গা যিনি সম্প্রতি মংডু থেকে বাংলাদেশে এসেছেন, তিনি বিবিসিকে এ কথা জানান।
"শহর পুরো বিরানভূমি হয়ে গেছে। প্রায় সব দোকানপাট ও ঘরবাড়ি লুট করা হয়েছে।"
গত মাসে জাতিসংঘ সতর্ক করেছিল যে রাখাইনে দুর্ভিক্ষ হতে পারে। কারণ অনেক মানুষ ঘরছাড়া হয়েছে, আর সেনাবাহিনীর অবরোধের কারণে খাবার ও জিনিসপত্র ঢুকতে পারছে না। জাতিসংঘও কোনও সহায়তা নিয়ে যেতে পারছে না।
আরাকান আর্মি নিজের প্রশাসন গঠনের চেষ্টা করছে। কিন্তু যুদ্ধের কারণে ঘরছাড়া কয়েকজন বিবিসিকে জানিয়েছে যে আরাকান আর্মি তাদের খাবার বা থাকার জায়গা দিতে পারছে না।
তাই আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের সাথে কেমন আচরণ করবে, তা এখনও বোঝা যাচ্ছে না। রাখাইনে এখনও প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে। ২০১৭ সালে সেনাবাহিনী সাত লাখ রোহিঙ্গাকে বিতাড়িত করেছিল।
সবচেয়ে বেশি সংখ্যক রোহিঙ্গা উত্তর রাখাইন রাজ্যে থাকে এবং মংডু শহর প্রধানত রোহিঙ্গা অধ্যুষিত। কিন্তু রোহিঙ্গা আর জাতিগত সংখ্যাগরিষ্ঠ রাখাইনদের মধ্যে সম্পর্ক বরাবরই খারাপ ছিল। এই রাখাইনরা আবার আরাকান আর্মির সমর্থক।
এখন এই সম্পর্ক আরও খারাপ হয়েছে, কারণ কিছু রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠী, যারা বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে থাকে, তারা আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে গিয়ে সামরিক বাহিনীর পক্ষে দাঁড়িয়েছে। অথচ এই সেনাবাহিনীই তাদের নির্যাতন করেছিল।
অনেক রোহিঙ্গা এই সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে পছন্দ করে না। আবার রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ বলছে, তারা আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রিত রাখাইন রাজ্যে বাস করতে পেরে খুশি।
কিন্তু আরাকান আর্মি তাদের দখল করা শহরগুলো থেকে হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে উচ্ছেদ করেছে এবং তাদের ফিরে আসতে দিচ্ছে না।
আরাকান আর্মি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে তারা ভবিষ্যতে স্বাধীন রাখাইন রাজ্যে সব সম্প্রদায়কে অন্তর্ভুক্ত করবে। কিন্তু তারা সেই রোহিঙ্গাদের প্রতি নিন্দা জানায়, যারা সেনাবাহিনীর পক্ষে লড়েছে।
বাংলাদেশে থাকা এক রোহিঙ্গা বিবিসিকে জানায়, "আমরা অস্বীকার করতে পারি না যে মিয়ানমার সরকার বহু বছর ধরে রোহিঙ্গাদের নির্যাতন করেছে এবং রাখাইনের জনগণও এতে সমর্থন দিয়েছে।"
তিনি যোগ করেন:"সরকার চায় না রোহিঙ্গারা নাগরিকত্ব পাক এবং রাখাইন জনগণও মনে করে রোহিঙ্গাদের রাখাইন রাজ্যে একেবারেই ঠাঁই দেওয়া উচিত নয়। আমাদের অবস্থা সামরিক জান্তার শাসনামলের চেয়েও খারাপ।"