সাধারণত সন্তান জন্মের আগে শিশুটি ছেলে না মেয়ে হবে, তা জানতে বেশ উদ্বেগ নিয়েই বাংলাদেশে আল্ট্রাসনোগ্রাম করে অনেক পরিবার। লিঙ্গ পরিচয় জানতে অনেক সময় চিকিৎসকদের চাপও দেয় রোগীর স্বজনরা।
অনেক ক্ষেত্রেই গর্ভের সন্তান মেয়ে জানার পর গর্ভবতী মায়ের উপর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের উদাহরণও রয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে মাতৃগর্ভে থাকা শিশুর লিঙ্গ পরিচয় প্রকাশ করা যাবে না বলে রোববারই রায় দিয়েছে বাংলাদেশের হাইকোর্ট।
কিন্তু প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এ রায়ের প্রভাব কী হবে? স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এর প্রয়োগই বা কীভাবে করবে?
কারণ চিকিৎসকরা বলছেন, গর্ভবতী মায়ের পরিবার থেকে যে চাপ দেওয়া হয় তার ফলে চিকিৎসকরা বাধ্য হয়ে শিশুর লিঙ্গ পরিচয় প্রকাশ করেন।
ফলে এই রায়টিকে যুগান্তকারী বলে মনে করছেন বাংলাদেশের চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
তারা বলছেন, এ রায়ের ফলে চিকিৎসকদের বিষয়টি না বলার জন্য আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি হল।
আবার রোগীর স্বজনরাও যাতে মাতৃগর্ভে থাকা শিশুর লিঙ্গ পরিচয় না জানতে চায় আইনে সে বিষয়টিও সুস্পষ্ট করার আহ্বান জানাচ্ছেন চিকিৎসকরা।
এক্ষেত্রে যথাযথ শাস্তি ও তা প্রয়োগের বিষয়টিতেও নজরদারি করা উচিত বলে মনে করছেন তারা।
আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, রায় পাওয়ার পরই আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী তা বাস্তবায়নে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হবে।
রায়টি যে প্রভাব ফেলবে
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) কোড অব এথিকস অনুযায়ী, রেজিস্টার্ড চিকিৎসক ছাড়া অন্য কেউ আল্ট্রাসনোগ্রাম করতে পারে না। কেউ যদি তা ভঙ্গ করে তবে লাইসেন্স বাতিল, জরিমানা-সহ নানা ধরনের শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে এই বিধানে।
কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এর ব্যতিক্রম দেখা যায় বলে অভিযোগ করছেন চিকিৎসকরা।
তাদের অভিযোগ, অনেক সময় চিকিৎসক ছাড়াও প্যারামেডিক, নার্সরা আল্ট্রাসনোগ্রাম করছে। তারা হুট করেই রোগীর স্বজনদের শিশুর লিঙ্গ পরিচয় সম্পর্কে জানায়।
এসব ক্ষেত্রে অনেক সময় ভুল আল্ট্রাসনোগ্রাম করার নজিরও রয়েছে।
ফলে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছে তার প্রভাব বেশ সুদূরপ্রসারী বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা। কারণ এ রায়ের ফলে প্যারামেডিক বা নার্সরা আল্ট্রাসনোগ্রাম করতে পারবে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল বিভাগের পরিচালক ডা. আবু হুসাইন মো. মইনুল আহসান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ আইনানুযায়ী প্যারামেডিক বা নার্সরা আল্ট্রাসনো করছে, এমন কোনও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে সাথে সাথেই এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসূতি ও স্ত্রী রোগ বিভাগের অধ্যাপক রেজাউল করিম কাজল এ রায়টিকে বেশ ইতিবাচকভাবেই দেখছেন।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ এখন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে বিএমডিসির আইন অনুযায়ী শাস্তি নিশ্চিতের ব্যবস্থাও করতে হবে। আর বিএমডিসির বাইরে যেসব প্যারামেডিকরা আল্ট্রাসনো করবে তাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শাস্তির আওতায় আনতে পারবে। ফলে আইনটিতে যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা থাকা জরুরি।”
“এ রায়ের ফলে মাতৃগর্ভের শিশুর লিঙ্গ পরিচয় প্রকাশ না করতে চিকিৎসকদের এখন আইনি হাতিয়ার তৈরি হল। স্বজনদের চাপ থেকে তারা নিজেদের রক্ষা করতে পারবেন। তবে, রোগীর স্বজনরাও যাতে লিঙ্গ পরিচয় জানতে না চান সে বিষয়টিও আইনে সন্নিবেশিত করতে হবে”, বলেন মি. করিম।
“কারণ অনেক সময় দেখা যায়, লিঙ্গ পরিচয় বলা নিয়ে চিকিৎসকদের মধ্যেও দ্বন্দ্ব রয়েছে। একজন চিকিৎসক না বললেও রোগীর স্বজনদের চাপে আরেকজন চিকিৎসক বলেন। ফলে রোগীর পরিবার বিষয়টি যাতে জানতে চাইতে না পারে সে বিষয়টি আইনে থাকতে হবে।”
চিকিৎসকরা বলছেন, এ রায়টি একদিকে যেমন রোগীর উপর প্রভাব ফেলবে তেমনি চিকিৎসকদের জন্যও গুরুত্ব বহন করবে।
নারীর গর্ভকালীন সময়ে চার বা পাঁচ মাসে একটি আল্ট্রাসনোগ্রাম করানো হয়। যাতে শিশুর সকল অঙ্গ স্বাভাবিক রয়েছে কিনা পরীক্ষা করা হয়।
চিকিৎসকরা জানান, এ রায়ের ফলে তাতে কোনও প্রভাব পড়বে না। কারণ সাধারণত কোনও ধরনের অস্বাভাবিকতা থাকলে শুধু সে ক্ষেত্রেই তা গর্ভবতী মা বা তার স্বজনদের জানানো হয়।
রায় বাস্তবায়ন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের ২০১৯ সালে করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ২৮ শতাংশ মহিলা প্রথম সন্তান হিসেবে ছেলে চায়। যা পুরুষদের ক্ষেত্রে ২৪ শতাংশ।
১৯৯৩-৯৪ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত দেখা যায়, লিঙ্গ ভিত্তিক পছন্দে ছেলে সন্তান হোক, তা বেশি প্রাধান্য পেয়েছে।
ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, এই ‘জেন্ডার বেইজড সেক্স সিলেকশন’ নারীর মৌলিক অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করে।
অসম শ্রেণির সম্পর্ক, পিতৃতন্ত্র, যৌতুক প্রথা, সাংস্কৃতিক বিশ্বাস, নারীর উপর চাপ, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, ঐতিহ্যগত লিঙ্গ ভূমিকাও বাংলাদেশের মানুষকে ছেলে কামনা করতে বাধ্য করে। একই সাথে মেয়ে শিশুর মূল্যকে ক্ষুণ্ণ করে।
অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, নারীর প্রতি বৈষম্য ও সহিংসতার কারণও ছেলে পছন্দ করার জন্য হয়।
২০১৯ সালের এই গবেষণায় প্রকাশ করা হয়, গর্ভবতী নারীরা অপমান, যত্নের অভাব, অতিরিক্ত চাপ এমন কী শারীরিক সহিংসতা-সহ বিভিন্ন বৈষম্যমূলক আচরণের মুখোমুখি হন।
ফলে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে মেয়ে শিশুর নিরাপত্তায় এ রায় খুব ভালো কাজ করবে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল বিভাগের পরিচালক ডা. আবু হুসাইন মো. মইনুল আহসান।
মি. আহসান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “অনেক সময় মা যদি আগে জেনে যায় গর্ভের সন্তানটি মেয়ে, সে ক্ষেত্রে কখনো কখনো সে সামাজিক বিড়ম্বনার শিকার হয়।"
"ছেলে শিশুকে এখনো বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়। তাই গর্ভকালীন মায়ের নিরাপত্তা, সামাজিক সম্মান রক্ষা ও তাকে যাতে কোনও প্রকার হয়রানি করা না হয় তাই এ রায় বাস্তবায়ন করা জরুরি।”
গর্ভের ভ্রুণ
এ রায়টি কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে জানতে চাইলে মি. আহসান জানান, “আদালত রায়ে যেভাবে নির্দেশনা দেওয়া হবে সেভাবেই অধিদপ্তর রায় বাস্তবায়ন করবে।"
"যদি রায় বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কোনও নির্দেশনা না থাকে, তবে বিজ্ঞপ্তি বা সার্কুলার দিয়ে আলট্রাসনোলজিস্টদের আদালতের রায়ের বিষয়ে জানানো হবে।"
"একই সাথে আল্ট্রাসনো কক্ষের সামনে রোগীর স্বজনদের জন্যও নির্দেশনা লেখা থাকবে। যাতে বলা হবে, পরিচয় জানার জন্য কোনও প্রশ্ন করা যাবে না।”
একই সাথে গর্ভবতী মাদেরকেও সচেতন করে তোলার জন্য চেষ্টা করা হবে বলে জানান মি. আহসান।
তবে মি. আহসানের মতে, মেয়ে শিশু নিয়ে বাংলাদেশের পরিবারগুলোর মনোভাব এখনও 'ততটা বিপদজনক নয়'।
বাংলাদেশে প্রতিবেশী কোনও কোনও দেশের মতো এখনও মেয়ে শিশুর জন্য ততটা বিপদজনক পরিস্থিতি না হলেও নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের যে নজির রয়েছে তাতে এই রায় বেশ যুগান্তকারী বলে মনে করছেন চিকিৎসকরাও।
চিকিৎসকরা বলছেন, গর্ভধারণকালীন সময়ে মা যাতে ভায়োলেন্সের শিকার না হয় তাই এ রায়ের প্রচার খুব জরুরি।
অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলোজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) প্রেসিডেন্ট ডা. রওশন আরা বেগম বলেন, “এ রায়ের ফলে গর্ভবতী মায়ের স্বজনদের তার প্রতি আচরণ পরিবর্তন হবে।"
"কারণ আইনি বাধ্যবাধকতা থাকলে তারা রোগীর প্রতি নেতিবাচক আচরণ পরিহার করবে। একইসাথে চিকিৎসকরাও রোগীর স্বজনদের চাপমুক্ত থাকবে।"
চিকিৎসকরা বলছেন, সঠিকভাবে যদি রায়টি বাস্তবায়ন করা যায়, তবে রোগীর স্বজনরা শিশুর লিঙ্গ পরিচয় জানলেও গর্ভকালীন নয় মাস তার প্রতি কোনও ধরনের অন্যায় আচরণ করবে না।
ভারতে রোগীর স্বজনরা যাতে মাতৃগর্ভে শিশুর লিঙ্গ পরিচয় না জানতে চায় সে বিষয়ে আইন এবং শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে।
এটির উদাহরণ টেনে বিএসএমএমইউএর অধ্যাপক রেজাউল করিম বলেন, “এক্ষেত্রে শুধু আইনে থাকলেই হবে না, ক্লিনিকগুলোর পলিসিতেও লিঙ্গ পরিচয় না জানানোর বিষয়টি থাকতে হবে”।
ফলে রায় বাস্তবায়নকারী সংস্থার এক্ষেত্রে সার্বিক তদারকি ও নজরদারি জরুরি বলে মনে করছেন তিনি।
এর আগে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বেসরকারি চাকুরীজীবী নারী বিবিসি বাংলাকে নিজের গর্ভকালীন তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছিলেন।
সে সময় তিনি জানান, ২০২০ সালে দ্বিতীয়বারের মতো গর্ভধারণ করেছিলেন তিনি। তার স্বামী বাংলাদেশের একজন প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা, যিনি র্যাবের প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত।
“পাঁচ মাসের গর্ভকালীন সময়ে স্বামীর সাথে আমি ঢাকার একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে আল্ট্রাসনোগ্রাম করাতে যাই। তখন আমার স্বামী বার বার ডাক্তারের কাছে জানতে চায় ছেলে হবে না কি মেয়ে। কারণ ছেলে হলে ওই সন্তান রাখবেন নতুবা গর্ভপাত করাবেন।”
ওই ভুক্তভোগী জানান, যখন তাকে বলা হল গর্ভের সন্তান মেয়ে তখন তার স্বামী তাকে জানায় মেয়ে বাচ্চা রাখা যাবে না, নষ্ট করে ফেলতে হবে। এমন কী আল্ট্রাসনোগ্রামের পর বাসায় এসে গর্ভপাত করাতে মানসিক অত্যাচার করা হয়। এক পর্যায়ে শারীরিকভাবেও আঘাত করা হয়।
পরে পুলিশের সহায়তায় রক্ষা পান তিনি। আদালতের দ্বারস্থ হন।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে মাতৃগর্ভে থাকা শিশুর লিঙ্গ পরিচয় নিষিদ্ধ করার জন্য প্রথমে লিগ্যাল নোটিশ পাঠান এই আইনজীবী।
পরে রিট করেন তিনি। যার শুনানি শেষে ২০২০ সালে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ রুল জারি করে গর্ভের শিশুর লিঙ্গ পরিচয় শনাক্ত রোধে নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ দেয়।
চার বছর ধরে সেই শুনানি চলছিল। এর মাঝেই গত ২৯শে জানুয়ারি গর্ভের শিশুর লিঙ্গ পরিচয় শনাক্ত রোধে একটি নীতিমালা তৈরি করে হাইকোর্টে জমা দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
রোববারের রায়ে হাইকোর্ট গর্ভের শিশুর পরীক্ষার রিপোর্টের ডেটাবেজ সংরক্ষণ করতেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছে। বিবিসি বাংলা