News update
  • ৬৪ লাখ টাকা খরচ করেও স্বপ্নই রয়ে গেল ইতালি     |     
  • Stock Market falls 150 points; Is Indo-Pak tension to blame     |     
  • Pakistan claims it has shot down five Indian fighter jets and a drone     |     
  • India says its strikes are of non-escalatory nature: BBC summary      |     
  • Waterways gasp for breath in Feni; 244 rivers, canals dying     |     

ফকির লালন শাহ সম্পর্কে একটি মূল্যবান লেখা

কাজী আজিজুল হক-------- ঐতিহ্য 2023-10-27, 12:48am

kazi-azizul-huq-43b2851149d68a1f2ab49ac751f417471698346115.jpg

Kazi Azizul Huq



ফকির লালন শাহ: অসাম্প্রদায়িক চেতনা 

©জহির আহমেদ*

@মঈন চিশতী**

হাজার বছরের বাংলার ধর্মীয় ইতিহাস সুফিবাদ, সহজিয়া মতবাদ ও বাউল-ফকিরদের ইতিহাস। এই প্রাণের বাংলায়- গানের বাংলায় যুগে যুগে ছিল উদার-অসাম্প্রদায়িক মানুষের বাস। এদেশ চির কালই ফকির-দরবেশ ও মুনি-ঋষি-আউলিয়ার সাধন-ভজন ও এবাদত-বন্দেগীর চারণভূমি।বাবা শাহজালাল, শাহপরান, গেছু দারাজ কল্লা শহীদ, বায়েজিদ বোস্তামী, আমানত শাহ, লালন শাহ, হাসন রাজা, জালাল উদ্দিন,কাজী নজরুল, আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী, নূরী বাবা লালপুরী শাহ,দয়াল বাবা গনি শাহ,মাজ্জুব অলি রাহাত আলী শাহ, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, শ্রীচৈতন্য, বাবা লোকনাথ, রামকৃষ্ণ, রাধারমণ, রামপ্রসাদ, অনুকূল চন্দ্র, বিবেকানন্দ, মনোমোহন, বিজয় সরকার প্রমূখ মহাপুরুষগণ বাঙালীর বিশ্বাস-ভক্তির প্রাণপুরুষ। বর্তমান বিশ্বজুড়ে সাম্প্রদায়িক উগ্রতার বিষবাষ্পের মধ্যে তারা আমাদের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক মানবপ্রেম দিয়ে মানব ধর্মকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। 

লালন ফকির  বাঙালীর অসাম্প্রদায়িক ও মরমী চেতনার প্রাণ পুরুষ। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান, আমির-ফকির ও আশরাফ-আতরাফ নামক সাম্প্রদায়িক ও জাতি-বর্ণের বিভাজনমুক্ত একটি অনুপম মানব সমাজের কথা লালনের মতো হৃদয় নিংড়ানো ভাষায় আর কে বলেছেন?

"এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে-

যে দিন হিন্দু মুসলমান, বৌদ্ধ খ্রিস্টান 

জাতি-গোত্র নাহি রবে।।

শোনায়ে লোভের বুলি 

নেবে না কেউ  কাঁধের ঝুলি

ইতর আতরাফ বলি 

দূরে ঠেলে নাহি দেবে।।

আমির ফকির হয়ে এক ঠাঁই

সবার পাওনা পাবে সবাই

আশরাফ বলিয়া রেহাই 

ভবে কেহ নাহি পাবে।।

ধর্মকুল গোত্র জাতির

তুলবে না গো কেহ জিগির

কেঁদে বলে লালন ফকির 

কেবা দেখায় দেবে?"

আধ্যাত্মিক তত্ত্ব ও সঙ্গীত পিপাসু মানুষের কাছে লালনের নাম কিংবদন্তি হয়ে আছে। 

গান্ধীরও পঁচিশ বছর আগে ভারতবর্ষে প্রথম তাঁকেই মহাত্মা উপাধি দেয়া হয়েছিল। লালন শাহ উনিশ শতকের বাউল গানের আদি রচয়িতাদের একজন এবং বাউলকূল শিরোমণি। তিনি ধর্মগুরু, দার্শনিক ও সমাজ সংস্কারক। 

লালনের জন্ম-ইতিহাস আজো রহস্যঘেরা। তিনি হিন্দু ছিলেন, না মুসলমান ছিলেন? বাউল ছিলেন না ফকির ছিলেন?এসব নিয়ে রয়েছে মতভেদ। লালন ছিলেন এসব মতভেদের উর্ধে।আত্মতত্ত্ব-পরমতত্ত্ব সম্পর্কে তিনি গভীর জ্ঞান লাভ করেছিলেন। 

তিনি ধর্মমত নির্বিশেষে সকল মানুষ নিয়ে একটি উদার অসাম্প্রদায়িক জীবন-যাপন করেছেন এবং গুরু বা মুর্শিদরুপে এক আল্লাহ বা পরমেশ্বরের ভজনা করছেন। 

"যে  মুর্শিদ সেই তো রাসুল, 

তাহাতে নাই কোন ভুল,

খোদাও সে হয়-

লালন বলে না কথা, কোরানে কয়-

এ কথা কোরানে কয়

পাড়ে কে যাবি 

নবীর নৌকাতে আয়।।"

এই লালনই আবার নদীয়ার গৌরাঙ্গের মধ্যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে দেখে বলেন-

"ঐ গোরা, কি শুধুই গোরা 

ওগো নাগরী।

দেখ দেখ চেয়ে দেখ 

কেমন রূপছিরি।।

শ্যাম অঙ্গে গৌরাঙ্গ মাখা

নয়ন দুটি আকাঁ-বাঁকা

মন বুঝে দিচ্ছে দেখা

ঐ ব্রজের বংশীধারী।।"

কিংবা

"সে কি আমার কবার কথা

আপন বেগে আপনি মরি।

গৌর এসে হৃদে বসে

করলো আমার মনচুরি।।

কিবা গৌর রূপ লম্পটে

ধৈর্যের ডুরি দেয় গো কেটে।

লজ্জা ভয় সব যায় গো ছুটে

যখন ঐ রূপ মনে করি।।

ঘুমের ঘোরে দেখলাম যারে

চেতন হয়ে পাইনে তারে।

লুকাইলে কোন শহরে

নব রসের রসবিহারী।।

মেঘে যেমন চাতকেরে

দেখা দিয়ে ফাঁকে ফেরে।

লালন বলে তাই আমারে

করলো গৌর বরাবরই।।

শোনা যায়- লালন নিরক্ষর ছিলেন। কিন্তু তার গানের ভাষা, শব্দ চয়ন, তত্ত্ব ও ভাব বিশ্লেষণ করলে আশ্চর্য হতে হয়। সেগুলো অশিক্ষিত কোন বাউলের গানের মত নয়, বরং মনে হয় স্রষ্টার কৃপা ও গভীর উপলব্ধিজাত। বাউল ও ফকিরী মতবাদের মানুষের কাছে লালন "সাঁইজি" হিসেবে মান্য এবং তার গান "সাঁইজির কালাম" হিসেবে সমাদৃত। তারা বিশ্বাস করেন- এসব অমূল্য বাণী কোন সাধারণ মানুষের লেখা নয়; বরং সাধক লালনের ভাবনা ও মগ্নতার উচ্চদেশ থেকে অবতীর্ণ। তিনি গানের মাধ্যমে প্রেম, ভক্তি ও তত্ত্বসুধা পান করেছেন ও ভক্তদের মাঝে বিলিয়েছেন। মনে গানের ভাব জাগলে সাঁইজি ভক্তদের ডেকে বলতেন,

"ওরে, তোরা কে কোথায় আছিস, আমার পোনা মাছের ঝাঁকেরা এসেছে।"... 

তিনি একের পর এক গান গাইতেন, আর ভক্তরা সেগুলো লিখে রাখতো। আজও লালনের গানের সুর ও বাণীর যাদুশক্তিতে লক্ষ-কোটি ভক্তশ্রোতা তত্ত্বজ্ঞানে মুগ্ধ ও ভক্তিরসে আপ্লুত হয়। ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কার ও সাম্প্রদায়িকতার বিষয়গুলোও তার গানে উঠে এসেছে। 

যেমন-

চিরদিন পোষলাম এক অচিন পাখি-

ও যার আপন খবর, আপনার হয় না- 

বড় সংকটে পড়িয়া দয়াল-

সময় গেলে সাধন হবে না-

জাত গেল জাত গেল বলে--, 

এ সব দেখি কানার হাট বাজার-

আমি অপার হয়ে বসে আছি-

বলি মা তোর চরণ ধরে-

তিন পাগলের হলো মেলা--, 

খাঁচার ভিতর অচিন পাখি-

বাড়ির কাছে আরশিনগর-

পাড়ে কে যাবি নবীর নৌকাতে আয়-

ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার-

কে বানাইলো এমন রং মহলখানা-

মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি -

সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন-

মিলন হবে কত দিনে- ইত্যাদি অসংখ্য গান

আত্মতত্ত্ব-পরমতত্ত্ব, ভক্তিরস ও দার্শনিকতায় সমৃদ্ধ।

ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সোচ্চার এমন অসংখ্য জনপ্রিয় গানের রচয়িতা বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ।

লালন ছিলেন ওয়াহদানিয়াতে বিশ্বাসী বা একেশ্বরবাদী। তিনি সাকারে নিরাকার বা মানুষরূপেই আল্লাহ বা ঈশ্বরকে ভেবেছেন। রাসুল বা অবতারগণ ধর্মের শরীয়তের আইন প্রণেতা ও প্রচারক, কিন্তু নেপথ্যে এক আল্লাহ বা পরমেশ্বরই।

"মুখে পড় রে সদায় 

লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ

আইন ভেজিলেন রাসুলুল্লাহ।।

নামেরও সহিত রূপও 

ধিয়ানে রাখিয়া জপো,

বে-নিশানায় যদি ডাকো, 

চিনবি কী রূপ কে আল্লাহ?

লা-শরিক জানিয়া তাঁকে, 

পড় কালাম দিলে-মুখে,

মুক্তি পাবি থাকবি সুখে, 

দেখবি রে নূর তাজেল্লা।।

বলেছেন সাঁই আল্লাহ নূরী, 

এ জেকেরের দরজা ভারি,

সিরাজ সাঁই তাই কয় ফুকারি, 

শোন রে লালন বে-লিল্লা।।"

মানুষের দেহ যেন একটি খাঁচা, আর প্রাণরূপ পরমেশ্বর হলেন সে খাঁচার পাখি। দেহ খাঁচার ভিতরে প্রাণপাখি দিনে একুশ হাজার ছয়শত বার আসা-যাওয়া করে। কিন্তু সে অচিন পাখিকে ধরা যায় না, চিনা যায় না। তবু পায়ে মনভেরি পরিয়ে চিরদিনের অচিন পাখিকে লালন আপন করতে চায়।

তাই তিনি গেয়ে উঠেন-

"খাঁচার ভিতর অচিন পাখি 

কেমনে আসে যায়?

তারে ধরতে পারলে 

মনভেরি দিতাম পাখির পায়।"

পিতার 'হাড়-রগ-মণি-মগজ' ও মাতার 'গোস্ত-পোস্ত-লোম-খুন'- এই আট বস্তুতে মানব দেহ তৈরি। এই হলো আট কুঠুরি।

দুই চোখ, দুই কান, দুই নাক, মুখ বিবর, লিঙ্গ ও গুহ্য- এই হলো দেহের নয় দরজা। আর মস্তিষ্ক হলো মানুষের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সদর কোঠা। এখানেই আছে সাধকের আরশিনগর বা আয়নামহল। এ মহলেই হয় আত্মা ও পরমাত্মা দর্শন।

"আট কুঠুরি নয় দরোজা আটা, 

মধ্যে মধ্যে ঝরকা কাটা,

তার উপরে সদর কোঠা,

আয়নামহল তায়।"

কিন্তু বেভুলা মানুষের দেহ একদিন ধ্বংস হবে জেনেও মাটির খাঁচার আকর্ষণেই পড়ে থাকে, অচিন পাখিকে চিনতে চায় না।  তাই ফকির লালনের আক্ষেপ করে বলেন-

"মন তুই রইলি খাঁচার আশে,

খাঁচা যে তোর কাঁচা বাঁশে।

কোন দিন খাঁচা পড়বে খসে,

ফকির লালন কেঁদে কয়।"

মানুষ অন্তরে যা ধারণ করে,ভাষায় প্রকাশ করে ও কর্মে প্রমাণ করে তাই তার ধর্ম। নাম যা-ই হোক;  মানব ধর্ম, প্রেমধর্ম বা শান্তির ধর্মই হলো সত্যধর্ম। অনাদি-অনন্ত-অখন্ড-অব্যয়-অজ্ঞেয় পরম সত্ত্বার প্রতি বিশ্বাস, আত্মতত্ত্ব ও পরমতত্ত্ব সম্পর্কে জানা, সত্য ও সুপথে চলে সৃষ্টিজগতে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ধর্মের মূল বিষয়। ফকির লালন বলেন-

"সত্য বল, সুপথে চল, 

ওরে আমার মন,

সত্য সুপথ না চিনিলে 

পাবিনা মানুষের দরশন।"

নবী, রাসুল, অবতার, আউলিয়াগণ মানুষে-মানুষে কোন বিভেদ করেন না। অথচ ধর্মের নামেই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশী অধর্ম হয়। অথচ পবিত্র কোরানে ঘোষিত হয়েছে ,

"নিশ্চয়ই এই মানব জাতি এক জাতি। আর আমি তোমাদের রব। তাই আমারই উপাসানা কর। এবং মানুষ তাদের কার্যকলাপ দ্বারা পারস্পরিক বিষয়ে মতভেদ সৃষ্টি করে। নিশ্চয়ই আল্লাহর দিকে হবে প্রত্যেকের প্রত্যাবর্তন"।

এক একেশ্বরের সৃষ্টি সারাজাহান ও কুল মাখলুকাত। কিন্তু সীমাবদ্ধ জ্ঞানীরা মানুষের মধ্যে ধর্মবর্ণের বিভিন্ন বিভাজন সৃষ্টি করে রাখে। 

লালনের ব্যক্তিগত জাত-ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন উঠলে এ বিষয়ে তিনি গানে বলেন-

"ওরে আমি কারে কী বা বলি 

আরে দিশে না মেলে

লোকে বলে লালন ফকির 

কোন জাতের ছেলে

শ্বেতদণ্ড জরায়ু ধরে

এক একেশ্বর সৃষ্টি করে

আরে আগম নিগুম চরাচরে

তারে ভিন্ন জাত বলে

সবে বলে লালন ফকির 

কোন জাতের ছেলে।

কারে বা কি বলি 

ওরে দিশে না মিলে।

জাত বলতে কী হয় বিধান,

হিন্দু-যবন-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান,

জাতের আছে কীবা প্রমাণ 

শাস্ত্র খুঁজিলে।

মানুষের নাই জাতের বিচার 

একেক দেশে একেক আচার

লালন বলে জাত ব্যবহার 

গিয়েছি ভুলে।” 

বেশধারী, আচারসর্বস্ব, লোভী ও স্বার্থবাদীরা নিজের ধর্মমতকেই একমাত্র সত্য ও অন্যান্য সকল ধর্মকে বাতিল মনে করে। তারা সব সময়ই নিজ ধর্ম ও মতের প্রশংসা ও পরধর্ম ও মতের নিন্দা-কুৎসা ছড়ায়। সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় বক্তাদের দম্ভ, আস্ফালন ও অন্যের ধর্মমতের বিরুদ্ধে কুৎসা শুনতে শুনতে মানুষ ধর্মের নামে অন্ধ ও অহংকারী হয়ে উঠে। কিন্তু সত্যিকারের ধার্মিক কখনো পরধর্মের নিন্দা করেন না। 

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা  বলেন:

“নিশ্চয়ই মুসলমান, ইহুদী, নাসারা  ও সাবেঈন তাদের মধ্য থেকে যারা ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি ও শেষ দিবসের প্রতি এবং সৎকাজ করে, তাদের জন্য রয়েছে পুরস্কার  তাদের পালনকর্তার কাছে। আর তাদের কোনই ভয়-ভীতি নেই, তারা দুঃখিতও হবে না।”

মহামানবগণ চিরকালই মানবতাবাদী ও অসাম্প্রদায়িক হয়ে থাকেন। লালন শাহ বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অসাম্প্রদায়িক মানুষ। লালনের একটি জনপ্রিয় গানের বানী:-

"সব লোকে কয় 

লালন কী জাত সংসারে,

ফকির লালন বলে- 

জাতের কী রূপ

দেখলাম না এ নজরে।

যদি সুন্নত দিলে হয় মুসলমান,

নারী জাতির কী হয় বিধান।

ব্রাহ্মণ চিনি পৈতায় প্রমাণ,

ব্রাহ্মণিরে চিনি কী করে?”

লালন গীতি বাংলা সঙ্গীত ভাণ্ডারের এক অমূল্য সম্পদ। তাঁর গান মারেফতি তত্ত্ব ও মরমিয়া ভাবে সমৃদ্ধ। বাঙালীর অসাম্প্রদায়িক মনোজগত গঠনে লালনের জীবন ও গানের বিপুল প্রভাব রয়েছে। 

ইংরেজ কবি অ্যালেন্স গিন্সবার্গ, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, বিদ্রোহীকবি নজরুল, পল্লীকবি জসীম উদদীনসহ অনেকের মধ্যেই ফকির লালন শাহর ব্যাপক প্রভাব লক্ষণীয়। তিনিই বাঙালির অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির পুরোধা। গিন্সবার্গ "আফটার লালন" নামে একটি কবিতাও লিখেছিলেন। বর্তমানে অনেক বিদেশীকে লালন সাঁইয়ের তত্ত্ব ও দর্শনের চর্চা করতে দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথ ইংল্যাণ্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে লালনের ভূয়সী প্রশংসা করে বক্তব্য দিয়েছিলেন। তিনি অনেকগুলো বাউল আঙ্গিকের গানও লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথ সরাসরি বলেছেন, "আমি বাউলের দলে।"

রবীন্দ্রনাথ লালন সম্পর্কে বলেছেন, "লালন ফকির নামে একজন বাউল সাধক হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মের সমন্বয় করে কী যেন একটা বলতে চেয়েছেন আমাদের সবারই সেদিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।"  

কাজী নজরুল ইসলাম শ্রেষ্ঠ অসাম্প্রদায়িক  আধুনিক বাঙালি কবি। তিনি বলেছেন, 

"যার নিজের ধর্মের প্রতি বিশ্বাস আছে,সে অন্যের ধর্মকে ঘৃণা করতে পারে না"। তিনিও বেশ কিছু বাউল ঘরানার গান লিখেছেন। তার এক গানে আছে- 

"আমি এক ক্ষ্যাপা বাউল,

 আমার দেউল আমারই এই আপন দেহ।" 

"মদীনায় রাসুল নামে

কে এলোরে ভাই

কায়াধারী হয়ে কেন

তারই ছায়া নাই।--"

লালনের উপরের গানটির অনুকরণে পল্লীকবি জসীম উদদীন লিখেছেন--

"রাসুল নামে কে এলো রে মদীনায়,

ওরে আকাশেরো চন্দ্র কেড়ে 

ও কে আনলো দুনিয়ায়।.." এই গানটি।

শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য পৃথিবীতে ধর্ম এসেছে। ধর্মের মূল বিষয় হলো সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা এবং সে বিশ্বাসে অটল থেকে শান্তি লাভ করা। অন্যকে বিশ্বাস এবং শান্তির পথে আহবান করা।

কিন্তু প্রেমহীনতা, স্বার্থপরতা, চিন্তাশূন্যতা, অশিক্ষা ও গোঁড়ামির কারণে অধিকাংশ মানুষ ধর্মের মৌলিক বিষয়গুলো বুঝতে পারে না। তারা সার্বজনীন ঐশ্বরিক ধর্মে ব্যক্তিগত সাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যা বা মতবাদ ঢুকিয়ে দেয়। সেজন্যই বিশ্বজুড়ে ধর্মীয় হানাহানি বেড়ে চলছে। কিন্তু মহামানবগণ যুগে-যুগে ভক্তি-প্রেমের যে বাণী প্রচার করছেন, তা জাতিধর্ম নির্বিশেষেই। ফকির লালন সাঁই তাঁর এক গানে বলেছেন-

"সহজ মানুষ ভজে 

দেখনা রে মন দিব্য জ্ঞানে, 

পাবি রে অমূল্য নিধি বর্তমানে। 

ভজ মানুষের চরণ দুটি,

নিত্য বস্তু হবে খাঁটি।" 

আসুন এই খাঁটিকে জীবনে ধারণ করতে খাটি মানুষের সঙ্গী হয়ে যাই তবে আল্লাহর বানী ইয়া আইয়্যুহাল্লাজিনা আমানু ইত্তাক্বুল্লাহা ওয়া কুনু মা'আস সাদেক্বীন( হে বিশ্বাসীরা প্রকৃত বিশ্বাস ধারণ করো এবং তা লাভ করতে সত্যনিষ্ঠদের সঙ্গী হয়ে থাকো)

আল্লাহ আমাদেরকে দ্বীনের প্রকৃত শিক্ষা জীবনে বাস্তবায়নের তৌফিক দান করুন।আমিন।

© মঈন চিশতী 

১০ কার্তিক ১৪৩০বাং, ১০ রবিউসসানী ১৪৪৫ হি, ২৬ অক্টোবর ২০২৩ ই আস্তানা ই লালপুরী,লালপুর বাজার, গৌরীপুর,কুমিল্লা

* জহির আহমদ,অধ্যাপক বাংলা বিভাগ, মদিনাতুল উমুল কামিল মাদ্রাসা,তেজগাঁও, ঢাকা।

** মঈন চিশতী, ধর্মচিন্তক ও কলামিস্ট, দৈনিক যুগান্তর, ঢাকা।

গদীনশীন পীর ও পরিচালক লালপুরী দরবার শরীফ কমপ্লেক্স, নুনেরটেক, সোনারগাঁ,নারায়ণগঞ্জ।