Students rally in front of the central Shaheed Minar on 02 August 2024.
২০২৪ সালের ১৬ জুলাই যখন হাসিনা সরকার শিক্ষার্থীদের দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেয় তখন ধীরে ধীরে পরিস্থিতি সরকারের অনুকূলে চলে যায়। পরবর্তীতে শেখ হাসিনার বিশেষ অনুরোধ ও ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টার সরাসরি তদারকিতে বাংলাদেশে ‘র’—এর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৪০০ কর্মকর্তা ঢাকায় আসেন। ‘র’—এর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই ৪০০ কর্মকর্তা কাশ্মীরি কায়দায় আন্দোলন দমন করে ২৮ জুলাই দিল্লি ফিরে যান। ২০২৪ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর দ্য এশিয়া মিররের এক প্রতিবেদনে একথা বল হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কিন্তু পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে ‘র’ ওয়াকিবহাল ছিল না। তাদের ভাষায়, ৫ আগস্ট তারা সিআইয়ের কৌশলের কাছে হেরে যায়। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দিল্লি পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হঠাৎ করে নেয়া হয়নি। ২ আগস্ট প্লান ‘সি’—এর অংশ হিসেবে এই পরিকল্পনা করে রাখেন হাসিনা ও ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল। ভারত দক্ষিণ এশিয়াকে তার নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট অঞ্চল হিসেবে দেখে। ফলে এসব দেশের পরিস্থিতিতে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হস্তক্ষেপ করে থাকেন।
৫ আগস্ট ব্যর্থ হওয়ার পর ১০ আগস্ট ‘র’ সংখ্যালঘুদের সমাবেশের আড়ালে একটি প্রতিবিপ্লব ঘটানোর পরিকল্পনা করে। এ কারণে সেদিন ঢাকায় বিপুল সংখ্যক ভারতীয় সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। ১০ আগস্টের পরিকল্পনা ব্যর্থ হলে ১৫ আগস্ট দ্বিতীয় বার প্রতিবিপ্লব ঘটানোর পরিকল্পনা করা হয়। তবে দ্বিতীয় পরিকল্পনাও ব্যর্থ হয়। আনসার বিদ্রোহের পরিকল্পনা ছিল আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ পরিকল্পনা। এ পরিকল্পনার সঙ্গে দ্য মিরর এশিয়া ‘র’—এর সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পায়নি।
ভারতের পরবর্তী পরিকল্পনা কী হতে পারে তা নিয়ে দ্য মিরর এশিয়া এক সপ্তাহ অনুসন্ধান করেছে। সম্প্রতি হাসিনাকে দক্ষিণ দিল্লির একটি সরকারি আবাসিক ভবনে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। তবে অন্য একটি সূত্র বলছে, হাসিনা বর্তমানে ভারতের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর (আইবি) সুরক্ষিত একটি ভবনে অবস্থান করছেন। অতি সম্প্রতি ভারত তার সঙ্গে ডজনখানেক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেছে। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও ‘র’ প্রধান নিজেরা শেখ হাসিনার তত্ত্বাবধান করছেন এবং তার সঙ্গে প্রায়ই বৈঠক করছেন। মনোবল ফিরিয়ে আনার জন্য হাসিনার সঙ্গে নিয়মিত সাক্ষাৎ করছেন তার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। নিয়মিত যোগব্যায়ামও করছেন হাসিনা। হাসিনার নতুন বাসভবনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা নিয়োগ দেখে দিল্লিতে কর্মরত এক বাঙালি সাংবাদিক দ্য মিরর এশিয়াকে বলেছেন, হাসিনা দিল্লিতে দীর্ঘ সময়ের জন্য থাকবেন।
দ্য মিরর এশিয়া হাসিনা ও ভারতের পরবর্তী পরিকল্পনার দিকে নজর রাখছে। এজন্য দ্য মিরর বাংলাদেশের ওপর নজর রাখেন এমন দুজন সাংবাদিক, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা, থিংক ট্যাংকের দুজন গবেষক ও সিক্রেট সার্ভিসের একজনের সঙ্গে কথা বলেছে। দ্য মিরর এশিয়া জানতে পেরেছে, ভারত এই মুহূর্তে একটি সূক্ষ সূতার ওপর পা রেখে চলতে চায়। প্রথমত: তারা ঢাকার নয়া সরকার ও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের গতিবিধির প্রতি নজর রাখছে। অন্যদিকে, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য কূটনীতিকদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একটি সূত্র বলছে, তারা জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গেও আলোচনা করতে রাজি। তবে জামায়াতের সঙ্গে আলোচনার জন্য তারা ‘দরজা’ খুলতে চান না, ‘জানালা’ খুলতে চান। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন।
দ্য মিরর এশিয়া আরো জানতে পেরেছে, আপাতত দুটি পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। প্রথম পরিকল্পনা পহেলা সেপ্টেম্বর থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত। এই পরিকল্পনার উদ্দেশ্য হলো এটা প্রচার করা যে, বামপন্থীদের মাধ্যমে শিবির, হেফাজত ও হিযবুত তাহরির ইউনূস সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তার করছে। হেফাজতে ইসলামের একটি অংশের সঙ্গে ‘র’—এর দীর্ঘদিনের যোগাযোগ রয়েছে। ‘র’ প্রভাবিত হেফাজতে ইসলামের এই অংশকে বুঝানো হয়েছে যে, ড. ইউনূস সুদখোর, মার্কিন এজেন্ট, তিনি কোনোভাবে একজন ভালো মুসলমান নন। শিগগির এই সরকার সমকামীদের অধিকারকে স্বীকৃতি দেবে। হেফাজতের এই গ্রুপকে জামায়াত অথবা অন্যান্য ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে ঐক্যে না যাওয়ার জন্যও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তবে পরিকল্পনায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে যে, আন্দোলনকারীদের সঙ্গে হিযবুত তাহরীরের সংশ্লিষ্টতা ও তাদের ভাবাদর্শ নিয়ে একটি ভয় তৈরির প্রতি। দ্য মিরর এশিয়া জানতে পেরেছে, ইতিমধ্যে ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী’ তিনজন বামপন্থী সাবেক ছাত্রনেতার সঙ্গে পশ্চিম বাংলায় দিল্লিতে কর্মরত একজন সাংবাদিক দীর্ঘক্ষণ আলাপ করেছেন। এই সাংবাদিক তাদের সঙ্গে ভবিষ্যতে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। অন্যদিকে ‘বাংলা মিশন’ সম্পন্ন করার জন্য বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে ইতিমধ্যে ‘র’—এর অভ্যন্তরে একটি উপ—গ্রুপ গঠন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ নিয়ে গঠিত গোয়েন্দা উপ—টিম ‘বাংলা মিশন’ সম্প্রতি চিকেন নেক নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহর একটি মন্তব্য ও সেভেন সিস্টার নিয়ে সমন্বয়কদের কারো কারো বক্তব্যকেও আমলে নিয়েছে। তাদের প্রত্যেকের ফেসবুক স্ট্যাটাসকে হিন্দি ও ইংরেজিতে অনুবাদ করে ‘ভিক্টর—২’—এর টেবিলে দেয়া হয়েছে। ‘ভিক্টর—২’ হলো ‘র’—এর একটি প্রোটোকল। এ প্রোটোকলকে বাংলাদেশ সম্পর্কিত সর্বশেষ সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও তাদের আদর্শিক ধারণা নিয়ে দিল্লির দুটি ও আসামের একটি গবেষণা সংস্থা গত ২০ দিন ধরে গবেষণা করেছে। তিনটি সংস্থার রিপোর্ট বলা হয়েছে, সমন্বয়করা কোনো দল গঠন করলে সেই দল হবে ভারতবিরোধী একটি রাজনৈতিক দল। বামপন্থী বৈপ্লবিক ধারণা পোষণ করলেও তাদের সঙ্গে ধর্মের কোনো বিরোধ থাকবে না। এই আদর্শের সামনে মূলত দেশের বামপন্থীদের রাজনৈতিক স্পেস একেবারে শূন্য হয়ে যাবে। এতে বামপন্থীদের সঙ্গে তরুণ সমন্বয়কদের একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হবে। এই উদ্বেগ থেকে ‘র’ বামপন্থী ছাত্র নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। এছাড়া সম্প্রতি সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানকে তারা একটি দার্শনিক ও ঐতিহাসিক ভিত্তি দিতে চাইলে বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধের একচ্ছত্র ইতিহাস ক্ষুণ্ণ হবে এবং ঢাকায় ভারতের সফট পাওয়ারকে দুর্বল করে দেবে। এই গণঅভ্যুত্থানের চেতনাকে বৃহত্তর পরিসরে গ্রহণ করা হলে ২০২৫ সালে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনে ‘র’—এর দ্বিতীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অত্যন্ত কঠিন হবে।
দিল্লিভিত্তিক একজন বাংলাদেশি গবেষক দ্য মিরর এশিয়াকে বলেছন, ক্ষমতায় পুনরায় ফিরে আসার হাসিনার ক্ষমতা অসাধারণ। তিনি ১৯৮১ সালে এবং ১৯৯৬ সালে পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে এসেছিলেন। ২০০৪ সালে গ্রেনেড হামলা থেকে বেঁচে গিয়ে ২০০৯ সালে অপ্রতিরোধ্যভাবে ক্ষমতায় ফিরে এসেছেন। এই বাংলাদেশি গবেষক আরো বলেন, ‘আমি মনে করি হাসিনা পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারবেন। তিনি দিল্লি থেকে দল পরিচালনা করবেন। কিন্তু তার দল ফিরতে পারবে। গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাসকে জাতীয় ইতিহাস ও সাহিত্যকর্মের অংশ করা হলে এবং একটি আদর্শিক ভিত্তি তৈরি করা হলে বাংলাদেশে সংকট তৈরি হবে। তাই আমরা ছাত্রদের বেশি সময় দিতে চাই না।’
ভারত মনে করছে, বিএনপি আমলে বরং আওয়ামী লীগ বেশি নিরাপদ থাকবে। বিএনপির অসংখ্য সংকট সামনে চলে এলে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব তৈরি হবে এবং আওয়ামী লীগ একটা রাজনৈতিক সুবিধা পাবে। দ্য মিরর এশিয়ার সঙ্গে আসাম থেকে একজন বাংলাদেশি এক্সপার্ট কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, হাসিনা সেভেন সিস্টারকে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করার স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানে তার এ স্বপ্ন চুরমার হয়ে গিয়েছে। বিএনপি এ ক্ষেত্রে ভারতকে সহযোগিতা করবে না। নতুন রাজনৈতিক দল হবে অনেক বেশি তারুণ্য নির্ভর, তারা কূটনীতির চেয়ে রাজনৈতিক ভাষায় বেশি কথা বলবেন। এমনকি তাদের কিছু সিদ্ধান্ত সেভেন সিস্টারের নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করতে। এই মুহূর্তে ভারতের অগ্রাধিকার হলো তরুণদের কোনো দল গঠনের সুযোগ না দিয়ে বর্তমান সরকারকে নভেম্বরের মধ্যে হিযবুত তাহরির ও শিবির প্রভাবিত সরকার বলে একটা অস্থিরতা তৈরি করা। অন্যদিকে নির্বাচনের পরিবেশের কথা বলে আগামী ছয় মাসের মধ্যে আওয়ামী লীগকে প্রকাশ্য রাজনীতিতে নিয়ে আসা।
(লেখাটি আমার ‘চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান’ থেকে নেয়া। বইটি প্রকাশ করা হবে আগামী ফেব্রুয়ারি বইমেলায়)