News update
  • UPDF activist shot dead in Khagrachhari     |     
  • Uncertainty across the Atlantic: Europe worries about its own security     |     
  • Quota protest: Nahid, 2 other coordinators in DB custody     |     
  • Nationwide mayhem was a conspiracy to destroy economy: PM     |     

'টাঙ্গাইল শাড়ির' উৎপত্তি ভারতে দাবি করায় বাংলাদেশে বিস্ময় ও বিতর্ক

গ্রীণওয়াচ ডেস্ক বিবিধ 2024-02-04, 8:06am

uryeueu-a0d40e03e67f58886cfbbe4827181bf71707012420.jpg




'টাঙ্গাইল শাড়ি' বাংলাদেশে বহুল পরিচিত একটি বিষয়। ঢাকার কাছে টাঙ্গাইল জেলার সাথে এর নাম জড়িয়ে আছে। কিন্তু সম্প্রতি ভারত দাবি করেছে 'টাঙ্গাইল শাড়ি' তাদের পণ্য। বিষয়টিতে বাংলাদেশে অনেক বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।

বৃহস্পতিবার দুপুরে ভারত সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ফেসবুক পেইজে একটি পোস্টে টাঙ্গাইল শাড়িকে পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্য উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, এটি এই অঞ্চলের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের বহিঃপ্রকাশ।

ওই পোস্টের নিচে অনেক বাংলাদেশি ব্যবহারকারীকে প্রতিবাদ জানাতে দেখা যায়। তাদের বক্তব্য টাঙ্গাইল বাংলাদেশের একটি জেলার নাম এবং ওই শাড়িটির উৎপত্তি এই জেলায়।

কিন্তু এই বিতর্কের প্রেক্ষাপট রচিত হয়েছে আরো এক মাস আগে।

চলতি বছরের জানুয়ারির দুই তারিখে টাঙ্গাইল শাড়িকে পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক নির্দেশকপণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।

ভারতের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন পেটেন্ট, ডিজাইন অ্যান্ড ট্রেড মার্কস বিভাগের পক্ষ থেকে এই সিদ্ধান্ত জানানো হয়।

সুন্দরবনের মধুও এই রাজ্যটির নিজস্ব পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন রেজিস্ট্রি’র তথ্য বলছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হস্তশিল্প বিভাগ এর জন্য আবেদন করেছিলো ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে।

টাঙ্গাইল শাড়িকে ধরা হয় নদীয়া ও পূর্ববর্ধমানের পণ্য হিসেবে। একইসাথে মুর্শিদাবাদের গরদ ও করিয়াল নামে আরো দুটি শাড়িও যুক্ত হয় জিআই নিবন্ধিত তালিকায়।

পাঁচই জানুয়ারি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এসব শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের অভিনন্দন জানিয়ে বার্তা দেন।

বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অবশ্য জিআই’র তালিকায় টাঙ্গাইল শাড়ির উপস্থিতির কথা শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।

টাঙ্গাইল শাড়ির উৎপত্তিস্থল

বিভিন্ন গবেষণা এবং এই শিল্পের আদি ধারার সাথে সম্পৃক্তদের বয়ানে এই শাড়ির উৎপত্তিস্থল হিসেবে সুনির্দিষ্টভাবে উঠে আসছে পাথরাইল, নলশোধা, ঘারিন্দাসহ টাঙ্গাইলের এমন বাইশ-তেইশটি গ্রামের নাম।

“একসাথে বাইশগ্রাম বলে চিহ্নিত করা হতো। এসব গ্রামই ঠিকানা ছিলো তাঁতীদের। যাদের পদবি ছিল ‘বসাক’।”

বলছিলেন হরিপদ বসাক, যিনি ওই তাঁতীদের বংশধর। জন্ম ও বেড়ে ওঠা ‘পূর্ব বাংলায়’ হলেও বর্তমানে বসবাস করছেন পশ্চিম বঙ্গের নদীয়ায়।

উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগের ব্রিটিশ ভারতে টাঙ্গাইল ছিল ময়মনসিংহ জেলার এক মহকুমা।

মি. হরিপদ বসাক বিবিসি বাংলাকে জানান, “১৮৫০ সাল বা তার কাছাকাছি সময়ে তৎকালীন ধামরাই এবং চৌহট্ট নামে দুটি গ্রামে মসলিনের উত্তরসূরী কিছু তাঁতি বসবাস করতেন।

সন্তোষ, করটিয়া, দেলদুয়ারে জমিদারি পত্তনের সময় অন্যান্য পেশাজীবীদের পাশাপাশি ওই তাঁতিদেরও সেসব জায়গায় নিয়ে বসতি স্থাপন করা হয়।”

এসব গ্রামের মানুষেরা যে শাড়ি বয়ন করতেন তাই ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’ নামে পরিচিতি লাভ করে।

নদীয়া বা পূর্ব বর্ধমানে প্রচলন যেভাবে

২০১৪ সালে টাঙ্গাইল জেলার তাঁতীদের নিয়ে একটি গবেষণা করেন মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন গবেষক সুব্রত ব্যানার্জি, মো. মনিরুজ্জামান মুজিব ও সুমনা শারমিন।

গবেষণায় দেখা যায়, পাকিস্তান পর্বে তো বটেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরেও বসাক সম্প্রদায়ের পরিবারের সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পেতে।

নলশোধা গ্রামের উদাহরণ টেনে উল্লেখ করা হয়, স্বাধীনতার পর পুরো গ্রামেই বাড়িতে বাড়িতে তাঁত থাকলেও ২০১৪ সালে সরেজমিনে তারা দেখতে পান মাত্র ২২ টি পরিবার এই পেশায় যুক্ত আছে।

বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁতশিল্প নিয়ে গবেষণা করেন নিলয় কুমার বসাক। তিনিও ওই তন্তুবায় সম্প্রদায়ের উত্তর প্রজন্ম।

মি. নিলয় বিবিসি বাংলাকে বলেন, “১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর বসাক সম্প্রদায়ের বড় অংশই ভারতে চলে যান। তাদের ভিড়টা বেশি হয় নদীয়া জেলার ফুলিয়া গ্রাম এবং পূর্ব বর্ধমানের ধাত্রী গ্রাম ও সমুদ্রগড়ে।”

তাদের বদৌলতে নদীয়া ও পূর্ব-বর্ধমানে ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’ পরিচিতি লাভ করে, যোগ করেন তিনি।

হরিপদ বসাকও প্রায় একই রকম তথ্য দিলেন। সঙ্গে যুক্ত করলেন, “এই বিদ্যেটা জানা ছিলো বলে আমাদের উদ্বাস্তু জীবনের বোঝা বইতে হয়নি।”

জিআই’র সম্পর্ক স্থানের সঙ্গে না ব্যক্তির সঙ্গে?

২০১১ সালেও একবার টাঙ্গাইল শাড়ির জন্য জি আই আবেদন করা হয়েছিল বলে জানান মি. বসাক। বলেন, “সেই আবেদনটি বাতিল হয়ে গিয়েছিল।”

তারপরও চেষ্টা চালিয়ে গেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ। ফল পেয়েছে ২০২৪ সালে এসে।

কিন্তু, প্রশ্ন উঠছে উৎপত্তিস্থল টাঙ্গাইলের নাম ধারণ করার পরও ভৌগলিকভাবে অন্য স্থানের পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা যায় কি না?

এর জবাবে, হরিপদ বসাক সামনে নিয়ে আসছেন পশ্চিমবঙ্গেরই বালুচরী শাড়ির উদাহরণকে।

তার ভাষ্য, “অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে মুর্শিদাবাদ জেলার বালুচর নামক স্থানে এই শাড়ির জন্ম হলেও পরবর্তীকালে বন্যার কারণে বালুচরী তাঁতিরা বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরে চলে আসেন। পরবর্তীতে সেখানে এই শাড়ির প্রসার ঘটে।”

“স্থানান্তরিত হলেও বালুচরী শাড়ি ‘বিষ্ণুপুরি’ বা অন্য কোনও নাম পরিগ্রহ করেনি, বরং বালুচরী নামেই জিআই পেয়েছে।” বলেন এই তাঁতশিল্প গবেষক।

আর নিলয় বসাক উল্লেখ করেছেন, “দেশভাগের বলি হয়ে ভারতে চলে এলেও ‘টাঙ্গাইল’ শব্দটি ছিল বসাক তাঁতিদের অস্থিমজ্জাগত। ফলে উদ্বাস্তু এই তাঁতিরা নিজেদের বয়নীকৃত শাড়ির নাম বা বয়ন কৌশল পরিবর্তন করার কথা কল্পনাও করেননি।”


কিন্তু এ ব্যাপারে ভিন্ন মত পোষণ করেন বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন, বিসিক এর বিপণন শাখার মহাব্যবস্থাপক অখিল রঞ্জন তরফদার।


ঢাকাই জামদানি, রংপুরের শতরঞ্জি ও শীতলপাটির মত পণ্যগুলোর জিআই প্রাপ্তির সময় এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মি. অখিল রঞ্জন।

তিনি এ খবরে ‘বিস্মিত’ হয়েছেন বলে মন্তব্য করেন।

বিবিসি বাংলাকে বলেন, এটা যৌক্তিক নয়। এটার নামই কিন্তু জিওগ্রাফিক্যাল, অর্থাৎ, ভৌগোলিক অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে এই পণ্যটার একটা স্বীকৃতি।

“এখানে ব্যক্তির কোনো বিষয় নেই। যারা আগে চলে গেছে, তারা এমন দাবি করে করলে এটা একটু খটকাই লাগে,” যোগ করেন বিসিকের এই কর্মকর্তা।

বলেন, “শাড়িটার যেহেতু টাঙ্গাইলেই উৎপত্তিস্থল, এখানেই উৎকর্ষ। এই স্থানের ভিত্তিতেই কিন্তু এটার স্বীকৃতি হওয়া উচিত।”

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালেয়ের গবেষকদের সুব্রত ব্যানার্জি ও সুমনা শারমিনও এই ধারণাটাকেই সমর্থন করেন।

অবশ্য, নিলয় কুমার ও হরিপদ বসাকও এ বিষয়ে বিতর্কের অবকাশ থেকে যায় বলে মনে করেন।

তাঁত শিল্পী ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জানা যাচ্ছে, টাঙ্গাইলের শাড়ির সুতা মিহি ও চিকন হয়।

সুতা টেকসই হয়, ফলে দীর্ঘদিন ব্যবহার নৈমিত্তিক ব্যবহারের উপযোগী থাকে।

এ ধরনের শাড়ি তপ্ত আবহাওয়ায়ও আরামদায়ক হয়।

তাতিদের স্থান পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শাড়িতেও বিভিন্ন পরিবর্তন যুক্ত হয়েছে বলে জানালেন মি. হরিপদ বসাক।

বিবিসি বাংলাকে বলছেন, “টাঙ্গাইল ঘরানার ওপর কাজ করে এটাতে বৈচিত্র্য আনা হয়েছে। বাজারের চাহিদা অনুযায়ী কালার বা ডিজাইনে ঘটানো হয়েছে পরিবর্তন।”

বাংলাদেশের বাজার ভারতের শাড়িতে সয়লাব বলে মন্তব্য করেছেন ব্যবসায়ী নাজমুল হাসান।

ভারত থেকে যেসব ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’ আসে সেগুলো একটু ‘সিল্ক টাইপের’ হয় বলে মত দেন তিনি।

টাঙ্গাইলে ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’র হালহকিকত

বসাকদের বাইরেও অনেকেই এই পেশার সঙ্গে যুক্ত আছেন দীর্ঘদিন ধরে।

তেমনই এক তাঁতবস্ত্র ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান নাজমুল হাসান। আগে বল্লারামপুর গ্রামে নিজেদের তাঁত থাকলেও করোনা মহামারীর অভিঘাত পার করে এখন আর সরাসরি উৎপাদন না করে বিপণনের সঙ্গে যুক্ত আছেন।

মি. নাজমুল বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমার ছোটবেলায় দেখছি রমরমা বিজনেস ছিল। এখন সেই বিজনেসটা আর নাই।

হাতের তাঁতগুলো উঠে গিয়ে এই শিল্প পাওয়ার লুমের দিকে ধাবিত হচ্ছে বলে জানান তিনি। তবে দাবি করেন, মেশিনেও কাপড়ের মান মোটামুটি একইরকম থাকে।

“করোনার পর এই অঞ্চলের অর্ধেক তাঁত নাই হয়ে গেছে। আমাদের ৫০ টা তাঁত ছিলো। ২০-৩০ লাখ টাকা লস দিয়ে হলেও সেগুলো একেবারে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছি।”

এখন মি. নাজমুল অন্যান্য উৎপাদকদের কাছ থেকে কিনে শো-রুম ও অনলাইনের মাধ্যমে বিক্রি করেন।

পশ্চিম বঙ্গের নদীয়া বা বর্ধমানেও হ্যান্ডলুমের জায়গা দখল করে নিয়েছে পাওয়ার লুম। ফলে, জি আই স্বীকৃতি মিললেও হস্তচালিত তাঁতে বোন টাঙ্গাইল শাড়ির ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা আছে সেখানকার বসাকদেরও।

সর্বশেষ ২০২৩ সালে নিবন্ধিত জি-আই পণ্য হল - নাটোরের কাঁচা গোল্লা।

বাংলাদেশের শীতলপাটি, রাজশাহী সিল্ক, রংপুরের শতরঞ্জি, কালিজিরা চাল, দিনাজপুরের কাটারীভোগ চাল এবং নেত্রকোনার সাদামাটি ২০১৭ ও ’১৮ সালে এই তালিকায় স্থান পায়।

আরও স্থান পায় বাগদা চিংড়ি, বগুড়ার দই, শেরপুরের তুলশিমালা ধানা, চাপাই নবাবগঞ্জের ল্যাংড়া ও আশ্বিনা আম।

এর আগে, বাংলাদেশে প্রথম বারের মতো জি-আই পণ্য হিসাবে ২০১৬ সালে স্বীকৃতি পেয়েছিল জামদানি। এরপর ২০১৭ সালে ইলিশ, ২০১৯ সালে খিরসাপাতি আম, ২০২০ সালে ঢাকাই মসলিনকে স্বীকৃতি দেয়া হয়।

এরপর থেকে এই পণ্যগুলো বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য হিসাবে বিশ্বে পরিচিতি পাচ্ছে।

কোনো একটি দেশের পরিবেশ, আবহাওয়া ও সংস্কৃতি যদি কোনো একটি পণ্য উৎপাদনে ভূমিকা রাখে, তাহলে সেটিকে ওই দেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

কোন পণ্য জি-আই স্বীকৃতি পেলে পণ্যগুলো বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ডিং করা সহজ হয়। এই পণ্যগুলোর আলাদা কদর থাকে। ওই অঞ্চল বাণিজ্যিকভাবে পণ্যটি উৎপাদন করার অধিকার এবং আইনি সুরক্ষা পায়।

আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব বিষয়ক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল প্রোপার্টি রাইটস অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউআইপিও) নিয়ম মেনে বাংলাদেশের শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে পেটেন্টস, ডিজাইন এবং ট্রেডমার্ক বিভাগ (ডিপিডিটি) এই স্বীকৃতি ও সনদ দিয়ে থাকে।

যে ব্যক্তি/ প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা জি-আই এর জন্য আবেদন করেন সেটার মেধাস্বত্ত্ব তাদের দেয়া হয়।

২০১৩ সালে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন হয়। ২০১৫ সালে আইনের বিধিমালা তৈরির পর জি-আই পণ্যের নিবন্ধন নিতে আহ্বান জানায় ডিপিডিটি।

ডিপিডিটি'র ভৌগলিক নির্দেশক পণ্যের জার্নাল থেকে বাংলাদেশের ১৭ টি জি-আই পণ্যের বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। বিবিসি নিউজ