পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সঙ্গে তার স্ত্রী বুশরা বিবিকে গত ৩১শে জানুয়ারি তোষাখানা মামলায় ১৪ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছে দেশটির একটি আদালত।
তার আগের দিন মি. খানকে রাষ্ট্রীয় গোপন নথি ফাঁসের মামলায় ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয় ইসলামাবাদের দুর্নীতিবিরোধী আদালত।
মি. খান অবশ্য আগে থেকেই কারাগারে আছেন।
মামলার রায়ে ইমরান খানের স্ত্রী বুশরা বিবির নাম যুক্ত হওয়ার পর তাকে নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।
আপাদমস্তক বোরখায় ঢাকা, কালো নেকাবের বাইরে কেবল একজোড়া চোখই দেখা যায় বুশরা বিবির। রীতিমত পর্দানশিন বুশরা বরাবরই ছিলেন কোনরকম আলোচনার বাইরে।
বুশরা বিবিকে কোন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে দেখা যায়নি কখনো, এমনকি স্বামীর নির্বাচনী প্রচারণাতেও তার উল্লেখ করার মত উপস্থিতি দেখা যায়নি কখনো।
ফলে ইমরান খানের তৃতীয় স্ত্রীকে নিয়ে গুজব ছড়াতে খুব বেশি সময় লাগেনি। আর বুধবার স্বামীর সাথে দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ার পর থেকেই বিশ্বব্যাপী মানুষ বুশরা বিবির বিষয়ে গুগলে সার্চ করছে।
প্রথমত, বিয়ের আগে বুশরা মানেকা নামে পরিচিত এ নারী পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেট অধিনায়ক ও রাজনীতিবিদ ইমরান খানের প্রাক্তন দুই স্ত্রীর থেকে একেবারেই আলাদা।
যেখানে কেতাদুরস্ত ব্রিটিশ পত্নী জেমিমা গোল্ডস্মিথ এবং সাংবাদিক রেহাম খানের ম্যাগাজিন এবং টেলিভিশনের পর্দায় ছিল সরব উপস্থিতি, সেখানে বুশরা মানেকা বরাবরই ছিলেন পর্দার আড়ালে।
এমনকি ২০১৮ সালে ব্রিটিশ দৈনিক মেইলকে দেয়া সাক্ষাৎকারে মি. খান গর্বের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘বিয়ের আগে তিনি তার স্ত্রীর চেহারাও দেখেননি’ - যা ছিল আশির দশকে তুমুল সফল ও জনপ্রিয় ক্রিকেটার ইমরান খানের পরিচিত ব্যক্তিত্বের বিচারে একেবারেই ‘অচিন্তনীয়’ একটি ব্যাপার।
ইমরান খান বলেছিলেন, বুশরার বুদ্ধিমত্তা এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই তাকে তার প্রতি আকৃষ্ট করেছে।
কিন্তু সেসব নিয়ে লোকের অত আগ্রহ ছিল না, বরং বুশরার রহস্যময়তাই যেন তাকে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসে।
বুশরা বিবি নামে সবার কাছে পরিচিত এ নারীকে আসলে 'আধ্যাত্মিক ক্ষমতার অধিকারী' বলে মনে করেন অনেকে। আধ্যাত্মিক বিষয়ে পরামর্শদাতা হিসেবে তার কিছু অনুসারীও আছে, যারা তাকে আলাদা সম্মান দেন।
পাকিস্তানে কেউ কেউ বলেন বুশরা বিবি সুফি ভাবধারার সঙ্গে যুক্ত। যদিও অনেকেই আবার সে বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন।
ইসলামিক রহস্যে ঘেরা সুফিবাদ স্রষ্টার অনুসন্ধান এবং পার্থিব বিষয় ত্যাগের উপর জোর দেয়। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ইমরান খান এই ধারার প্রতি আগ্রহী।
একদা প্লেবয় হিসেবে পরিচিত ইমরান খানের ক্রিকেট খেলাকালীন সময় কিংবা পরে বিয়ে করে সামাজিকভাবে স্থিত হবার সময়েও তিনি লাইমলাইটে ছিলেন - যা কিনা সুফিবাদের ধারণার চেয়ে অনেকটাই আলাদা।
প্রায় দুই দশক আগে ১৯৯৫ সালে ব্রিটিশ নাগরিক জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। তখন তার বয়স ৪৩ বছর আর জেমিমার বয়স ছিল ২১ বছর। মিজ গোল্ডস্মিথের বাবা সেসময় বিশ্বের সবচেয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের একজন ছিলেন।
নয় বছর স্থায়ী সে সংসারে তাদের দুটি পুত্র সন্তান আছে।
এরপর ২০১৫ সালে সাংবাদিক এবং বিবিসির সাবেক আবহাওয়া উপস্থাপক রেহাম খানের সঙ্গে মি. খানের দ্বিতীয় বিয়ে টিকেছিল এক বছরেরও কম সময়।
রেহাম খানের দাবি, ইমরান খানের সমর্থকরা তাকে হেনস্তা করেছিল এবং এ নিয়ে পরে একটি বইও লেখেন তিনি।
এর বিপরীতে, ইমরান খানের ২০১৮ সালের বিয়ে ছিল খুবই সাদামাটা।
পর্যবেক্ষকদের মতে, তাদের বিয়ে ইসলামের প্রতি ইমরান খানের আনুগত্যকে জনগণের সামনে বেশ ভালোভাবে উপস্থাপন করেছিল।
বলা হয়ে থাকে, একবার ইমরান খান ১৩ শতকে নির্মিত এক দরগায় পরামর্শের জন্য গিয়েছিলেন পাঁচ সন্তানের মা বুশরা বিবির কাছে। তখনও বুশরা বিবি তার প্রথম স্বামীর সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কে ছিলেন।
কথিত আছে, এসময় একদিন বুশরা বিবি স্বপ্নে দেখেন যে কেবল তাদের বিয়ে হলেই ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন।
এরপর তারা বিয়ে করেন এবং ছয় মাস পর মি. খান দেশটির প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
তবে, বর্তমানে ৪০ বছর বয়সী বুশরা বিবি ২০১৮ সালের অক্টোবরে তার দেয়া একমাত্র টিভি সাক্ষাৎকারে এ বিষয়টির সত্যতা নাকচ করে দেন।
তবে ইমরান খানের অধীনে দ্রুতই পাকিস্তান উন্নতি করবে বলে উপস্থাপককে আশ্বস্ত করেন তিনি। যদিও তেমনটা ঘটেনি।
ইমরান খানের সময়কালে দেশটির অর্থনীতি ধসে পড়েছিল, জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে গিয়েছিল, তার বিরোধীপক্ষের অনেককে জেলে যেতে হয়েছিল।
এছাড়া গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়েছিল এবং মানবাধিকার ক্ষুণ্ণ হওয়া ও সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনা বেড়ে গিয়েছিল।
রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রকাশ্যে ইমরান খান উদারনীতির সমর্থন করে সাফল্য পান, একইসঙ্গে ইসলামী মূল্যবোধ এবং পশ্চিমা বিরোধী মনোভাব পোষণ করেন।
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল বলা হলেও পরবর্তী সময়ে তাদের অনুগ্রহ হারান তিনি।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার চার বছরের মধ্যেই মি. খানের রাজনৈতিক জীবনে ঝামেলা শুরু হয়।
এক পর্যায়ে ২০২২ সালে তাকে সংসদ়ে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। পরের বছর তাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং বেশ কিছু মামলায় তাকে জেলে পাঠানো হয়।
এখনপাকিস্তানের সাবেক ফার্স্ট লেডিকেও কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ক্ষমতায় থাকাকালে তারা দুজনই অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় উপহার বিক্রির মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে ১৪ বছরের সাজা পেয়েছেন।
তবে, এ মামলা ছাড়াও বুশরা বিবির আরো আইনি জটিলতাও রয়েছে।
তার প্রাক্তন স্বামীর নাম খাওয়ার মানেকা। সর্বশেষ ২০১৭ সালের বিবাহবিচ্ছেদের আগে তাদের ২৮ বছরের সংসার ছিল। তিনিও বুশরার নামে আদালতে মামলা করেছেন।
পাকিস্তানের সংবাদপত্র ডন এ প্রকাশিত খবরে বলা হয়, সরকারী কর্মচারী এবং সুপরিচিত এক রাজনীতিবিদের ছেলে খাওয়ার মানেকা। নভেম্বরে তিনি বুশরার নামে ‘বিয়েতে প্রতারণা এবং ব্যভিচারের’ অভিযোগ দায়ের করেন।
ব্যভিচারের অভিযোগ বাতিল করলেও প্রতারণার অভিযোগটি আমলে নেয় আদালত।
মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী, স্বামীর মৃত্যু বা বিবাহ বিচ্ছেদের পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নারীরা আবারও বিয়ে করতে পারেন না।
কিন্তু খাওয়ার মানেকার সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের পর নির্ধারিত সময় পূর্ণ হবার আগেই বুশরা বিবি ইমরান খানকে বিয়ে করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
আসন্ন পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন, যেখানে ইমরান খান অংশ নিতে পারছেন না- তার মাত্র এক সপ্তাহ আগে রাষ্ট্রীয় উপহারে বিক্রির মামলায় তাদের এই সাজা দেয়া হলো। তবে এই মামলায় বুশরা বিবির ভূমিকা কী ছিল তা স্পষ্ট নয়।
ক্ষমতায় থাকাকালীন সহযোগীদের মাধ্যমে দুবাইতে পারফিউম, ডিনার সেট এবং হীরার গহনাসহ বিভিন্ন দামি উপহার বেআইনিভাবে বিক্রির অভিযোগ আনা হয় বুশরা ও তার স্বামীর বিরুদ্ধে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, এই উপহারগুলোর মূল্য ছিল পাঁচ লাখ ডলারের বেশি।
মি. খানের দল, পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছে। তার আইনজীবীরা বলছেন, মামলাগুলো রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
পিটিআইয়ের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও আইনজীবী গওহর আলি খান বলেছেন, বুশরা বিবির সাজা সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপর চাপ সৃষ্টির আরেকটি প্রচেষ্টা।
স্থানীয় একটি টেলিভিশন নেটওয়ার্ককে তিনি বলেছেন, “এই মামলার সঙ্গে বুশরা বিবির কোনো যোগসূত্র নেই।”
তবে তার এ বক্তব্যে, বুশরা বিবির বন্দি হিসাবে বছরের পর বছর কারাগারে থাকার যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে তার কোন ব্যত্যয় ঘটবে না।
বুধবার গভীর রাতে প্রকাশিত একটি সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত ইসলামাবাদে তাকে তার বাসভবনে গৃহবন্দি রাখা হবে। বিবিসি