বিদেশে অর্জিত সম্পদ ও অর্থের ওপর নির্দিষ্ট হারে কর দেয়া হলে ওই সম্পদ ও অর্থের বিষয়ে কোন প্রশ্ন না তোলার যে প্রস্তাব অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বাজেট ঘোষণার সময় দিয়েছেন, তার তীব্র সমালোচনা হয়েছে।
বিশ্লেষকরা একমত, বাংলাদেশ থেকে যে শত শত কোটি ডলার প্রতি বছর পাচার হয়, অর্থমন্ত্রী সেই অর্থ ফিরিয়ে আনতেই এই সুযোগ দিতে চান।
তবে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, সরকারের এ ধরনের প্রস্তাব অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোন থেকেই অনৈতিক।
বৃহস্পতিবার সংসদে আগামী বছরের জন্য যে বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে তাতে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বিদেশে অর্জিত অর্থ দেশে আনার বিষয়ে আয়কর অধ্যাদেশে নতুন বিধান সংযোজনের একটি প্রস্তাব করেছেন।
এই প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বিদেশে অর্জিত সম্পদ দেশে আনা হলে স্থাবর সম্পত্তির জন্য ১৫ শতাংশ, অস্থাবর সম্পত্তির জন্য ১০ শতাংশ এবং নগদ অর্থ আনতে সাত শতাংশ হারে কর দিলে ওই সম্পদের বিষয়ে প্রশ্ন তুলবে না আয়কর কর্তৃপক্ষ।
সংসদের তিনি বলেন, বিদেশে অর্জিত অর্থ মূলস্রোতে এনে বিনিয়োগ ও আর্থিক প্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্য এই প্রস্তাব করেছেন তিনি।
তবে তার এই সিদ্ধান্তকে অনৈতিক উল্লেখ করে এর প্রতি কোন সমর্থন নেই বলে জানিয়েছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি।
বাজেটে বিভিন্ন বিষয় পর্যালোচনা করে শুক্রবার সকালে একটি সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবের তীব্র সমালোচনা করা হয়।
সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, "এই ধরনের উদ্যোগ আসলে কর ন্যায্যতার বিপক্ষে এবং নৈতিকতার পরিপন্থী।"
তার মতে, এমন সিদ্ধান্তের মাধ্যমে একদিকে যেমন সৎ করদাতাদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে, অন্যদিকে, যারা এই অর্থ সম্পদ বাইরে নিয়ে যায় তাদেরকেও প্রকারান্তরে উৎসাহিতই করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, "তারা অন্যায়ভাবে, ব্যাংক ঋণ থেকে বিভিন্ন দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ নিয়ে গেছে। তাদের আবার সুযোগ সুবিধা দিয়ে তাদেরকে স্বাগত জানাচ্ছি। এইটা চরমভাবে একটা অনৈতিক কাজ।"
তার মতে, এর মাধ্যমে কোন অর্থ আসবে না।
কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার সুযোগের বিষয়টি তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয় যে, দীর্ঘদিন ধরে এই সুযোগ চালু থাকলেও আসলে এক্ষেত্রে তেমন একটা সাফল্য তারা দেখতে পাচ্ছেন না।
ওয়াশিংটন ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইনন্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি এর তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯-১৮ সাল পর্যন্ত বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে সোয়া চার লাখ কোটি টাকা পাচার হয়।
আর দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বছর বাংলাদেশে থেকে ১০০০ থেকে ১৫০০ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টাকা পাচার করা বাংলাদেশে একটি অপরাধ এবং এর শাস্তির বিধান রয়েছে। তাদের মতে, কর দেয়ার মাধ্যমে পাচার হওয়া টাকা ফিরিয়ে আনার সরকারের এই পদক্ষেপ আইন বিরোধী।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকারের এই পদক্ষেপ কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।
তিনি বলেন, "অর্থপাচার একটি ঘোরতর অপরাধ বাংলাদেশ এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী। এবং এধরনের ঘোরতর অপরাধকে এরকম ঢালাওভাবে সুযোগ করে দেয়া মাত্র ৭-১৫ শতাংশ কর দিয়ে, সেটা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।"
তার মতে, অর্থমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্ত একই সাথে বৈষম্যমূলকও বটে।
তিনি বলেন, দেশে বা বিদেশে যারা বৈধভাবে আয় করে তাদেরকে ২০ শতাংশ থেকে শুরু করে অনেক ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কর দিতে হয়।
অন্যদিকে এই সিদ্ধান্তের ফলে যারা ঘোরতর অপরাধ করেছে তাদেরকে মাত্র সাত শতাংশ কর দেয়ার সুযোগ দেয়াটা বৈষম্যমূলক।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যারা বিদেশে টাকা পাচার করেছেন তারা সেখানে সম্পদের মালিক হয়েছেন, উপভোগ করছেন, সেগুলো ছেড়ে দিয়ে সেই অর্থ তারা দেশে নিয়ে আসবেন সেটা ভাবাটা খুবই কঠিন।
দেশে টাকা আনার যে আশা নিয়ে সরকার এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সেটা পূরণ হবে না বলেও মনে করেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।
জাতীয় বাজেটের পরদিন অর্থমন্ত্রী প্রথাগত যে সংবাদ সম্মেলন করেন, তাতে মিস্টার কামালকে আজ এ বিষয়েই সবচেয়ে বেশি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। তবে তিনি স্বীকার করেন যে মূলত পাচার হওয়া টাকা দেশে ফিরিয়ে আনতেই তার এই উদ্যোগ।
অর্থমন্ত্রী বলেন, "কখনো কখনো মিসম্যাচ হয়ে যায়। কখনো কখনো বিভিন্ন কারণে টাকা চলে যায়। টাকা পাচার হয় নাই একথা আমি কখনো বলি নাই। এই টাকাগুলো যদি পাচার হয়ে থাকে, এটা আমরা ধারণা করছি যে পাচার হয়ে গেছে।"
পাচার হওয়া এসব অর্থই দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন বলে জানান অর্থমন্ত্রী।
এ ধরনের চেষ্টা এর আগে বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ করে সফল হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, "যদি পাচার হয়ে থাকে তাহলে সেটা এই দেশের মানুষের হক। আমরা এগুলা ফেরত আনার চেষ্টা করতেছি। এখানে বাধা দিয়েন না। বাধা দিলে আসবে না। তাহলে আপনাদের লাভ কী?"
"আপনারা যে বলছেন আসবে না, কেন আসবে না, আসবে। এটাও চেষ্টা করতে হবে," বলেন তিনি।
বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ কী প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশে ফিরতে পারে, সেটি এখনও পরিস্কার নয়।
বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, এ ব্যাপারে একটি আইনি ভিত্তি দেয়া হবে। তথ্য সূত্র বিবিসি বাংলা।