News update
  • UNRWA Report on the Humanitarian Crisis in Gaza & West Bank     |     
  • Rail link with Khulna cut off as train derails in Chuadanga     |     
  • 3 killed, 10 injured in Pabna Bus-truck collision     |     
  • UN Chief Appalled as Gaza Crisis Deepens, Aid Blocked     |     
  • Dhaka’s air quality ‘moderate’ also on Friday morning     |     

কলকাতায় ‘রাতের রাস্তা’ই যেভাবে নারীর প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠছে

বিবিসি বাংলা মানবাধিকার 2024-09-03, 2:33pm

reteryery-06e0d233284024e2e38ed7e773ae92311725352385.jpg




কলকাতার আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ক্ষোভে ফুঁসছে পশ্চিমবঙ্গ। দোষীদের শাস্তি এবং নারী নিরাপত্তার দাবি জানিয়ে আন্দোলনে সামিল হয়েছেন ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ, সামিল হয়েছে অন্য দেশের নাগরিক সমাজও।

ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই বারেবারে রাস্তায় নেমেছে জনতা - নারী, পুরুষ, শিশু ও প্রবীণ নির্বিশেষে।

তবে প্রতিবাদ জানিয়ে গর্জে ওঠার ঘটনা এই রাজ্যে নজিরবিহীন নয়। নতুন নয় কলেজ স্কোয়্যার, ধর্মতলা, অ্যাকাডেমি চত্বর বা অন্যান্য জায়গায় স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বিপুল জনতার জমায়েতও। মিছিলে, স্লোগানে এর আগেও মুখর হয়েছে রাজপথ।

কিন্তু আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসককে খুন ও ঘটনার পর শুরু হওয়া এই আন্দোলন যেন একটা ভিন্ন দিক তুলে ধরেছে। যেখানে রাজনীতির ছোঁয়াচ বাঁচাতে মরিয়া মানুষ। মরিয়া প্রতিবাদের আগুন জ্বালিয়ে রাখতেও।

ঠিক সেই কারণেই রোববার তারই মতো বাকি প্রতিবাদীদের সঙ্গে কলকাতার রাস্তায় রাত জেগেছিলেন অঙ্কিতা পাল। যেমনটা জেগেছিলেন গত ১৪ই আগস্ট ‘রাত দখলের কর্মসূচি’তে।

তিনি বলেন, “আমরা বিচার চাই। আরজি করের ঘটনায় অভিযুক্তদের সকলের শাস্তি চাই। কিন্তু এই প্রতিবাদ তারপরেও চলবে যতদিন না এই রেপ কালচার বন্ধ হয়, ধর্ষকরা ভয় পায়। লোকে বুঝতে পারে আমার সম্মতির অর্থ, আমার স্বাধীনতার অর্থ।”

রোববার শহরের একাধিক কর্মসূচির মধ্যে একটি ছিল ‘আমরা তিলোত্তমা’ নামক একটি মঞ্চের কর্মসূচি। পহেলা সেপ্টেম্বর দুপুরে কলেজ স্কোয়্যার থেকে হেঁটে একটি মিছিল ধর্মতলায় আসে। কলকাতার শিল্পীদের ডাকা এই জমায়েতে সামিল হয়েছিলেন সাধারণ মানুষ।

মিছিল শেষে প্রশাসনের কাছে তাদের দাবি জানিয়ে প্রশাসনের উত্তরের অপেক্ষায় রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে ধর্নায় বসেন তারা। ধর্না চলে সকাল পর্যন্ত, যদিও প্রশাসনের তরফে কোনও সদুত্তর মেলেনি।

তৃণাঙ্কুর দাশ নামে এক কলেজ পড়ুয়াও ছিলেন ওই ধর্নায়। তিনি বলেন, “এর আগে রাতের রাস্তায় মেয়েদের এমন নিশ্চিন্ত জমায়েত আগে দেখিনি। ১৪ই আগস্ট রাত দখল আমাদের প্রথম সাহস জুটিয়েছিল। তারপর ধীরে ধীরে প্রতিবাদে রাত সামিল হচ্ছে। প্রতিবাদ কর্মসূচি কিন্তু এখন শুধুমাত্র দিনের বেলাতেই আটকে নেই, রাতেও হচ্ছে।”

গত কয়েক সপ্তাহে রাতে মেয়েদের জমায়েত, গণ আদালতের ডাক-সহ একাধিক কর্মসূচির সাক্ষী থেকেছে এই রাজ্য। আগামী চৌঠা সেপ্টেম্বর আবার ‘রাত দখলের’ ডাক দেওয়া হয়েছে। তার পরদিনই সুপ্রিম কোর্টে এই মামলা সংক্রান্ত শুনানি হওয়ার কথা।

রাতের রাস্তায় নিজেদের উপস্থিতি জানান দেওয়াই কী তাহলে প্রতিবাদের নতুন ভাষা হয়ে উঠছে?

এই প্রসঙ্গে সমাজকর্মী শবনম হাসমি বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “রাত কিন্তু মেয়েদের নিরাপত্তার লড়াইয়ে প্রতীক হয়ে উঠছে। কারণ সেই সময় রাস্তা-ঘাট জনশূন্য থাকে। শুধু রাস্তাই নয়, মেয়েদের সংখ্যা রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সর্বত্র কমতে থাকে। তাদের পরিখা হয়ে দাঁড়ায় নিজেদের বাড়ি এবং এই বিধি নিষেধ মেয়েদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়।”

প্রতিবাদে সামিল রাতও

‘রাত দখল’ কর্মসূচির সঙ্গে শুরু থেকে সামিল রয়েছেন সম্প্রীতি মুখার্জী।

তিনি বলেন, “মেয়েদের যে বারবার বলে দেওয়া হয়, কখন, কোথায় থাকবে তার উপরে নির্ভর করবে তোমার নিরাপত্তা। অর্থাৎ তার স্বাধীনতাকে নজরদারিতে রাখা হয়, নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কিন্তু প্রশাসন বা অবকাঠামোগত উন্নতির মাধ্যমে সেটাকে কীভাবে নিশ্চিত করা যায় সেটা দেখা হয় না।”

“গণপরিসরে যতক্ষণ নারী এবং প্রান্তিক লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছি না, ততক্ষণ সমাজকে সুরক্ষিত পরিসর হিসাবে গড়ে তুলতে পারব না। সেই জন্য শুধু একদিন রাস্তায় একদিন রাত জাগা নয়। দিনের পর দিন রাত জাগতে হবে, রাতের দখল আদায় করে নিতে হবে।”

এবং সেই কারণেই এই ‘অধিকার আদায়’ করে নিতেই কি রাতের রাজপথ নারী সুরক্ষার দাবিতে শুরু এই প্রতিবাদের ভাষা হয়ে দাঁড়াচ্ছে?

এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “রাত দখল সত্যিই আস্তে আস্তে প্রতিবাদ ও স্বাধীনতার ভাষা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। একটা ক্ষোভের জায়গা থেকে প্রথমবার রাত দখল করতে রাস্তায় নেমেছিল মানুষ ... যে তাদের আর কত দমিয়ে রাখা হবে! আজ সেটাই প্রতিবাদের ভাষা। তাই একের পর এক কর্মসূচি রাতে হচ্ছে।”

পেশায় নার্স সুকন্যা গোস্বামীর মতে মেয়েরা দিনের যে কোনও সময়েই সুরক্ষিত নন। কিন্তু তাও প্রতিবাদের জন্য রাতের সময়কে বেছে নেওয়ার পিছনে বিশেষ অর্থ আছে।

তার কথায়, “মেয়েরা কিন্তু ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কখনওই সুরক্ষিত নয়। ৯ই আগস্ট আরজি কর হাসপাতালের ঘটনা ঘটার পর থেকে একাধিক যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে এবং সেটাও দিনের বেলায়।”

“কিন্তু রাতকেই যে প্রতিবাদের ভাষা বলে বেছে নেওয়া হয়েছে তার কারণ দু’টো। প্রথমত ওই চিকিৎসক তার কর্মক্ষেত্র হাসপাতালে রাতে সুরক্ষিত ছিলেন না, আর দ্বিতীয়ত মেয়েদের উপর চাপিয়ে দেওয়া নিয়মকানুন। ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি সন্ধ্যের আগে বাড়ি ফিরতে হয়।”

রাতই যখন প্রতীক

চিকিৎসককে খুনের ঘটনার পরপরই একটি বাংলা সংবাদমাধ্যমের জন্য কলম ধরেছিলেন শিক্ষিকা ও ফেমিনিস্ট অ্যাক্টিভিস্ট শতাব্দী দাশ। ডাক দিয়েছিলেন মেয়েদের রাত দখলের।

যদিও সেখানে দিনক্ষণের উল্লেখ ছিল না। রিমঝিম সিনহা, শতাব্দী দাশ এবং তাদের মতো আরও কয়েকজন সমবেত হয়ে সমাজমাধ্যমে সেই বার্তা দেন। তারপর ১৪ই আগস্টের ছবিটা সবার জানা।

১৯৭৭ ইংল্যান্ডের লিডস্ শহরে ‘রিক্লেম দ্য নাইট’ আন্দোলনের মতোই নিজেদের অধিকার বুঝে নিতে ওই রাতে রাস্তায় নামেন নারীরা। নেমেছিলেন পুরুষরাও।

শতাব্দী দাশ বলেন, “রাত আর রাস্তা এই দু’টো টাইম (সময়) আর স্পেসকে (স্থান) বোঝাচ্ছে। এই যে কিছু সময় ও স্থান বেঁধে দিয়ে বলা হয় এই সময়ে এই জায়গায় তুমি সুরক্ষিত এর বাইরে তোমার দায়িত্ব নিচ্ছি না, এটা বন্ধ হওয়া দরকার। এই দৃষ্টিভঙ্গিটা পিতৃতান্ত্রিক এবং সেখান থেকেই রাত দখলের ভাবনাটা এসেছিল।”

রাত দখলের ডাকের এমন সাড়া পাবেন কল্পনা করেননি তিনি বা অন্যান্য আহ্বায়করা।

রাতকে প্রতিবাদের ভাষা হিসাবে বেছে নেওয়ার অন্য একটা কারণও জানিয়েছেন তিনি। বলেছেন, “একজন নারী তিনি রাতে হাসপাতালেই কর্মরত হন বা পার্টি করতেই যান, একজন নাগরিক হিসাবে তিনি সুরক্ষিত থাকবেন না কেন? আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমরা সমস্ত স্থান এবং কালকে রিক্লেম করছি সবার জন্য।”

শক্তি ও স্বাধীনতার পরিচয়

এই প্রসঙ্গে নিজের মতামত জানিয়েছেন সমাজকর্মী ও অধ্যাপক শাশ্বতী ঘোষ। তিনি বলেন, “মেয়েদের বরাবর বলা হয় তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবে, বেশি দেরি যেন না হয় ইত্যাদি। তাই রাতটা মেয়েদের কাছে বরাবরই অধরা।”

“রাতকে বিপজ্জনক বলা হয় কিন্তু বাড়িতেও তো বিপদ হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে হাসপাতালে এক নাবালিকাকে যৌন হেনস্থার ঘটনা-সহ একাধিক ঘটনা কিন্তু রাতে ঘটেনি।”

তারপরেও রাতই প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রতিবাদের।

মিজ ঘোষ বলেন, “রাতটা ভয়ঙ্কর বলা হয় এবং ভয়ঙ্করকেই দখল করতে হবে। ভয়ঙ্করকে দখল করার মধ্যে যে শক্তি রয়েছে সেটাই দেখাতে চাইছে মেয়েরা।”

“মেয়েদের চারপাশে যে গণ্ডি টেনে দেওয়া হয় সেটা অস্বীকার করে স্বাধীনতা খুঁজে পেতে চেয়েছে মেয়েরা। তাই এই রাস্তায় রাত জাগা”, বলছেন তিনি।

রাজনীতি নয়

আরজি কর হাসপাতালে চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার পর থেকেই যে আন্দোলন চলছে সেখানে আরও একটা উল্লেখযোগ্য দিক হল রাজনৈতিক ছোঁয়াচ থেকে দূরে থাকতে চাইছে প্রতিবাদী মঞ্চগুলো।

“রাজনীতি এলেই কিন্তু প্রতিবাদ তার দিশা হারিয়ে ফেলবে। আমরা বুঝতেও পারব না কখন পুরো বিষয়টাই হাত থেকে বেরিয়ে যাবে। তাই ছাত্র হিসাবে আমি মনে করি এই প্রতিবাদের আগুনকে যে করে হোক বাঁচিয়ে রাখতে আর আর রাজনীতির রঙও লাগতে দেওয়া যাবে না,” বলছেন কলেজ পড়ুয়া মৈনাক দত্ত।

তিনি প্রথমবার যাদবপুরে রাত জেগেছিলেন। রোববার রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে ধর্নায় সামিল ছিলেন।

একই কথা জানিয়েছেন মিজ দাশ। তিনি বলেন, “রাত দখলের কর্মসূচির সময় দেখেছিলাম মানুষ বারবার জানতে চাইছিলেন এটা রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি নয় তো? তখন আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক কোনও দলকে চাইছে না। আর আমাদের চাওয়াটাও একই।”

রাতের রাস্তায় প্রতিবাদের ঘটনা কী নজিরবিহীন?

সমাজকর্মী শবনম হাসমি জানিয়েছেন, রাতের রাস্তায় এমন প্রতিবাদ এর আগেও ভারতে দেখা গিয়েছে।

সেই প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি টেনে আনেন ২০০৯ সালের দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের ম্যাঙ্গালোরের একটি পাবের ঘটনা। যেখানে একটি পাবে উপস্থিত মেয়েদের উপর হামলা চালানোর অভিযোগ উঠেছিল। হামলাকারীদের যুক্তি ছিল পানশালায় উপস্থিত নারীরা ভারতীয় সংস্কৃতির বিরুদ্ধাচারণ করেছেন।

সেই প্রসঙ্গ টেনে এই প্রবীণ সমাজকর্মী বলেন, “রাতেও এই বেরোনোর দাবি জানিয়ে প্রতিবাদ আগেও হয়েছে ভারতে, যখন ম্যাঙ্গালোরের একটি পানশালায় মেয়েদের উপর হামলা করা হয়েছিল। সেই সময় মেয়েরা রাতের রাস্তায় প্রতিবাদস্বরূপ বেরিয়ে পড়েন। এটা বোঝাতে যে তারা স্বাধীন। কিন্তু প্রতিবাদের তীব্রতা এতটা ছিল না।”

“কলকাতার ঘটনাকে (আরজি কর হাসপাতালের ঘটনা) কেন্দ্র করে যে প্রতিবাদের ভাষা বেছে নিয়েছে আন্দোলনকারীরা, বিশেষত মেয়েরা, তা নজিরবিহীন।”

লড়াই কতটা কঠিন?

নারী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাত ও রাজপথের দখল নেওয়া যে সহজ হবে না তা মেনে নিয়েছেন সবাই। সুঁটিয়া, কামদুনি, মধ্যমগ্রাম-সহ পশ্চিমবঙ্গের একাধিক ঘটনা তার প্রমাণ।

সম্প্রীতি মুখার্জী বলেন, “রাত দখলের কর্মসূচি যে দিন ছিল সে দিনও তো হেনস্থার ঘটনার ঘটেছে। সেখান থেকে স্পষ্ট হয়েছে যে রাতের সেই দখল আমরা এখনও আদায় করতে পারিনি। তাই লড়াই চলবে।”

অন্যদিকে, শবনম হাসমি জানিয়েছেন আন্দোলন দীর্ঘদিন চালিয়ে নিয়ে যাওয়া কঠিন।

তার কথায়, “দীর্ঘদিন ধরে কোনও আন্দোলন সঠিক দিশায় চালিয়ে নিয়ে যাওয়া কঠিন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এবং পশ্চিমবঙ্গে একাধিক ঘটনার ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি এক সময় তীব্র আন্দোলন হয়েছে আবার তা স্তিমিতও হয়েছে। তাই সামনের পথ সহজ নয়।”