News update
  • Bumper harvest of Jujube in Ramu Upazila     |     
  • Govt urged to offer scholarships to Palestinian students     |     
  • Caretaker Govt Review Hearing on Supreme Court Cause List     |     
  • Bangladesh Single Window to Launch by March: Lutfey Siddiqi     |     
  • UNRWA chief: Ceasefire is the start, not the solution     |     

ডেঙ্গু রোগের নামকরণ হয়েছিল যে বিচিত্র উপায়ে

গ্রীণওয়াচ ডেস্ক রোগবালাই 2024-07-10, 12:59pm

rreyeryer-32ea3abd51bfd4f263ca72c20f5174171720594766.jpg




ভাইরাসের নামকরণ সাধারণত যে প্রাণীর শরীরে তার উপস্থিতির কথা প্রথমবার জানা গিয়েছিল তার নামানুসারে রাখা হয়, কিংবা সেই জায়গায় যেখানে তা আবিষ্কার হয়েছিল। যে বিজ্ঞানী এই ভাইরাস আবিষ্কার করেছিলেন, তার নাম অনুযায়ীও রাখা হতে পারে।

কিন্তু সব ক্ষেত্রে তেমনটা হয়নি, যেমন ডেঙ্গু!

এই ভাইরাসের নামকরণের নেপথ্যের কাহিনী বেশ রোমাঞ্চকর।

ষোড়শ শতকের শেষ দশকে, ডাক্তাররা বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়া এক নতুন সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাবের কথা জানাতে শুরু করেছিলেন।

ফিলাডেলফিয়া, পুয়ের্তো রিকো, জাভা এবং কায়রোতে বহু মানুষ সে সময় একই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হন। সবারই লক্ষণ ছিল এক - সর্বাঙ্গে তীব্র যন্ত্রণা এবং জ্বর, যাকে তারা ‘ব্রেক-বোন ফিভার’ (বা ল্যাটিন আমেরিকাতে কেবেরান্তা হুইসোস) বলে চিহ্নিত করেছিল।

তার বেশ কয়েক বছর পর, ১৮০১ সালে মাদ্রিদে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ায় তাতে আক্রান্ত হন তৎকালীন স্পেনের রানি মারিয়া লুইসা দে পারমা।

সুস্থ হয়ে ওঠার পর তার লেখা একটা চিঠিতে রানি ওই রোগের কয়েকটি লক্ষণ এবং নাম বর্ণনা করেছেন যা আমাদের কাছে বেশ পরিচিত । রোগটা ছিল ডেঙ্গু।

চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, “আমি আগের চেয়ে ভালো বোধ করছি, কারণ যাকে তারা ডেঙ্গু বলে থাকে, তার প্রকোপ কমেছে।”

"গতকাল থেকে রক্ত বেরোচ্ছে, যা আমাকে অস্বস্তিতে ফেলছে এবং কিছুক্ষণ কথা বলার পরে গলা ব্যথা করছে।”

ডেঙ্গুর জন্য আসলে দায়ী চারটে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত ভাইরাসের গ্রুপ, যা ‘ফ্ল্যাভিভাইরাস’ নামে পরিচিত।

এডিস ইজিপ্টি এবং এডিস অ্যালবোপিকটাস প্রজাতির মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু বিশ্বের গ্রীষ্মন্ডলীয় এবং উপক্রান্তীয় অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।

এই রোগের প্রকোপ সেই সমস্ত অঞ্চলেই দেখা যায় যেখানে এই বিশেষ প্রজাতির মশার প্রাকৃতিক ভাবে আধিপত্য রয়েছে। বিপুল সংখ্যক মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে তারা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের প্রথম চার মাসেই গোটা বিশ্বে ৭৬ লক্ষ মানুষ ইতিমধ্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। এই রোগে ইতিমধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৩০০০ জনের।

গত বছরে মোট আক্রান্তের সংখ্যা নথিভুক্ত করা হয়েছিল ৬৫ লক্ষ। অর্থাৎ, গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম চার মাসেই আক্রান্তের সংখ্যা পেরিয়ে গিয়েছে।

এদিকে চলতি বছরের জুলাই মাসের শুরুতেই ডব্লিউএইচও-র 'গ্লোবাল ডেঙ্গু সার্ভিলেন্স সিস্টেমে' ৯৬ লক্ষ রোগী শনাক্ত হয়েছে, যা এখনও পর্যন্ত সর্বোচ্চ রেকর্ড। বিশ্বব্যাপী মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫,৩৬৬।

২০২৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ডেঙ্গুতে ৭,৩০০ জনের মৃত্যু হয়েছিল।

গত পাঁচ বছরে এই রোগের প্রকোপ দ্রুত বেড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং এল নিনো আবহাওয়াকে উষ্ণ ও আর্দ্র করে তুলেছে যা রোগের ভাইরাস বহনকারী মশাকে সুযোগ করে দেয় নতুন নতুন এলাকায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে দিতে আর সংক্রমণকে প্রশস্ত করতে।

২০২৪ সালে বিশ্বের ৯০টা দেশে এই ভাইরাস সক্রিয়ভাবে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ছড়িয়েছে। এর মধ্যে ৩১টা দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সংখ্যক আক্রান্তের সংখ্যা নথিভুক্ত করা হয়েছে।

সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ২০২৪ সালের জুন মাসে 'সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন'-এর তরফে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডেঙ্গু ভাইরাস সংক্রমণের বর্ধিত ঝুঁকি সম্পর্কে সতর্কতা জারি করেছে।

কিন্তু ডেঙ্গুর নামকরণ কীভাবে হয়েছিল, সেই গল্পটা বেশ আকর্ষণীয় এবং ভাইরাসের নামকরণের পদ্ধতির বিষয়ে একটা ধারণা দেয়।

উপসর্গের উপর ভিত্তি করে ভাইরাসের নামকরণ করা হতে পারে। কোনও ভাইরাসের নাম আবার যে জায়গায় আবিষ্কার হয়েছিল তার নাম অনুসারে কিংবা যে প্রাণীর দেহে প্রথম খোঁজ মিলেছিল সেই প্রাণীর নাম অনুযায়ী।

কারও ব্যুৎপত্তি আবার সময়ের জালে হারিয়ে গিয়েছে।

অ্যানালিটিক্যাল টেকনিক বা বিশ্লেষণাত্মক কৌশল আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ভাইরাস শনাক্ত করা সহজ হয়ে উঠছে।

তাই পরিচিত ভাইরাসের তালিকাও দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে ৷ বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন যাতে ভাইরাসকে শ্রেণিবদ্ধ করে তোলার ক্ষেত্রে কিছুটা শৃঙ্খলা আনা যায়।

তারা নিয়মতান্ত্রিক নামকরণ পদ্ধতির বিকাশ ঘটাতে চাইছেন যার সাহায্যে নতুন ভাইরাসের উৎপত্তির সঙ্গে সঙ্গে যাতে শনাক্ত ও শ্রেণিবদ্ধ করে তোলা যায়।

বর্তমানে ১৪৬৯০টা পরিচিত প্রজাতির ভাইরাস রয়েছে যেগুলোকে সরকারীভাবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু পুরো পৃথিবীতে কত ভিন্ন ভিন্ন ভাইরাসের অস্তিত্ব রয়েছে তার কোনও স্পষ্ট চিত্র বিজ্ঞানীদের কাছে নেই।

উদাহরণস্বরূপ, শুধুমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণীদের দেহে ৩লক্ষ ২০হাজার ধরনের ভাইরাস রয়েছে বলে অনুমান করা হয়।

সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গিয়েছে, মানুষের অন্ত্রে ১ লক্ষ ৪০হাজার ব্যাকটেরিওফাজের সন্ধান মিলেছে। এটা এক ধরনের ভাইরাস যা ব্যাকটেরিয়া কোষকে সংক্রামিত করে।

পরিচিত প্রজাতির মধ্যে প্রায় ২৭০টা ভাইরাস মানুষকে সংক্রামিত করে বলে এখনও পর্যন্ত জানা গিয়েছে। নতুন রোগের প্রকোপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই তালিকাও দীর্ঘ হচ্ছে । তালিকায় জুড়েছে সার্স-কোভ-২, জিকা ভাইরাস এবং এমপক্স-এর মতো ভাইরাস, যা সংক্রমণ ব্যাধির সৃষ্টি করে।

ডেঙ্গু নামের সঠিক উৎপত্তি ঠিক কোথা থেকে তা কিছুটা অনিশ্চিত। তবে এর নামের সঙ্গে রোগের লক্ষণের সঙ্গে যোগ রয়েছে বলে মনে করা হয়।

ডেঙ্গুতে আক্রান্তরা হাড় এবং পেশীতে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করেন যার ফলে নড়াচড়া করা কঠিন হয়ে যায়।

ডেঙ্গু নাম কীভাবে এল, তার একটা তত্ত্ব হলো সোয়াহিলি শব্দের স্প্যানিশ সংস্করণ থেকে এই নামের উৎপত্তি। 'কি ডেঙ্গা পেপো' যার অর্থ হল 'অশুভ আত্মা দ্বারা হঠাৎই আক্রান্ত হওয়া', সেখান থেকেই এসেছে এই নাম।

অন্য একটা তত্ত্ব বলছে, ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে লোকেরা যেভাবে 'ড্যান্ডি' শব্দটা উচ্চারণ করে থাকে সেখান থেকেও ডেঙ্গুর উৎপত্তি হতে পারে। ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে এই সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি দেখা যেত।

অথবা স্প্যানিশ সংস্করণ 'ডেঙ্গেরুও' যা আক্রান্তদের অসমন্বিত চলাচলের সঙ্গে সম্পর্কিত, তা থেকেও এই নামের উৎপত্তি হতে পারে।

এখানে শেষ তত্ত্বটা অপেক্ষাকৃত মজার। এই নামকে রসিকতার ছলে কোনও 'কদর্য' রোগকে বর্ণনা করার একটা ধরন বলে মনে করা যেতে পারে।

ডেঙ্গু ভাইরাস কিন্তু ভাইরাসের একটা বিশেষ গ্রুপের অন্তর্গত যা হেমোরেজিক ফিভার ভাইরাস নাম পরিচিত।

হেমোরেজিক ফিভার ভাইরাস কিছু ক্ষেত্রে মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

একজন মানুষের শরীর থেকে অন্য মানুষের শরীরে সংক্রমণ হতে পারে, যদি সংক্রমিত ব্যক্তির রক্ত এবং দেহরসের সঙ্গে সরাসরি সংস্পর্শে কেউ আসেন।

সব ক্ষেত্রেই লক্ষণ প্রায় এক - তীব্র জ্বর, মাথাব্যথা, গাঁটে এবং মাংসপেশীতে ব্যথা, ডায়রিয়া এবং বমি। আর পাশাপাশি শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে হঠাৎ ক্ষত এবং রক্তপাত।

তবে সব ক্ষেত্রেই যে ভাইরাল হেমোরজিক ফিভারে আক্রান্ত ব্যক্তির রোগের লক্ষণ চোখে পড়বে এমনটা নয়। এই রোগ খুবই ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করতে পারে।

একই তালিকায় রয়েছে ইবোলা, নিপাহ এবং মারবুর্গ ভাইরাস, যেসব ভাইরাসে আক্রান্ত রোগে মৃত্যুর হার বেশি।

ভাইরাল হেমোরেজিক ফিভার (ভিএইচএফ)-এর নামকরণের বিষয়টা বেশ উল্লেখযোগ্য। এর বেশ কিছু উপসর্গ আবার ডেঙ্গুর মতো।

আরও একটা মশাবাহিত রোগ আছে যা ভাইরাল হেমোরেজিক ফিভার গোত্রের অন্তর্গত এবং যকৃৎকে প্রভাবিত করে আর রোগীর দেহে জন্ডিসের সৃষ্টি করে। এই রোগ 'ইয়োলো ফিভার' নাম পরিচিত।

এই নাম কেন এসেছে সে বিষয়ে আশ্চর্য হওয়ার অবশ্য কিছু নেই।

এর সূত্র ধরে আমাদের সামনে একটা নতুন সমস্যা এসে পড়ে আর সেটা হল রোগের উপসর্গের ভিত্তিতে ভাইরাসের নামকরণ। কারণ বিভিন্ন রোগের উপসর্গ কিন্তু কাছাকাছি হতে পারে।

যকৃতের সংক্রমণের কারণে অনেকের জন্ডিস হতে পারে। এই রোগে চোখের সাদা অংশ, প্রস্রাব এবং মাঝে মাঝে ত্বকও হলুদ হয়ে যায়। উদাহরণ হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ডি এবং ই ভাইরার।

আবার এপস্টাইন-বার ভাইরাস, যা গ্রন্থিজনিত জ্বর সৃষ্টি করে তার নাম এসেছে আবিষ্কারক দুই বিজ্ঞানীর নাম থেকে - প্যাথলজিস্ট মাইকেল এপস্টাইন এবং ভাইরোলজিস্ট ইভন বার। এই রোগেও যকৃতের ক্ষতি হয়, জন্ডিস হতে পারে।

জার্মান হামের কারণ রুবেলা ভাইরাস। এর নাম এসেছে রোগের উপসর্গের উপর ভিত্তি করে। আক্রান্তদের শরীরে লাল ফুসকুড়ি দেখা দেয়। সেই লক্ষণের উপর ভিত্তি করে 'লিটল রেড' বা সামান্য লাল-এর ল্যাটিন সংস্করণ থেকে এসেছে ওই নাম।

তবে বিরল কিছু ক্ষেত্রে, বিশেষ করে আক্রান্ত নবজাতকদের মধ্যে এই রোগে যকৃতের সমস্যা দেখা গিয়েছে।

উপসর্গ-ভিত্তিক ভাইরাসের মধ্যে রয়েছে চিকুনগুনিয়া। মশাবাহিত এই ভাইরাস জ্বর এবং গাঁটে গাঁটে গুরুতর ব্যথার সৃষ্টি করে।

পূর্ব আফ্রিকার তানজানিয়ায় এই রোগ প্রথম চিহ্নিত হয়। এই রোগে আক্রান্তদের তীব্র যন্ত্রণার কারণে বসা বা চলাচলের ভঙ্গি বদলে যায়।

স্থানীয় ভাষা কিমাকোন্ডে থেকে অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, 'যা (যে রোগ) বাঁকিয়ে দেয়"। ভাইরাসের নামও সেই থেকে।

ও'নিয়ং'নিয়ং হলো আরও একটা সম্পর্কিত ভাইরাস যা আক্রান্তের শরীরে চিকুনগুনিয়ার মতোই লক্ষণের সৃষ্টি করে।

উপসর্গভিত্তিক এই ভাইরাসের নাম উত্তর উগান্ডার আচোলি উপভাষা থেকে এসেছে। অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘অস্থিসন্ধির তীব্র বেদনাদায়ক দুর্বলতা’।

এরপর আসা যাক সেই ভাইরাসের তালিকায়, যাদের নামকরণ করা হয়েছে সেই স্থানের অনুসরণে যেখানে এই ভাইরাস প্রথম শনাক্ত করা হয়েছিল।

যেমন বলিভিয়ার হেমোরেজিক জ্বরের সাথে যুক্ত ভাইরাস, মাচুপো ভাইরাসের নাম এসেছে বলিভিয়ার সান জোয়াকিনে একটা নদীর নামানুসারে। ১৯৫৯ সালে ওই অঞ্চলে প্রথমবার এই ভাইরাস চিহ্নিত করা হয়েছিল।

কিন্তু কিছু ভাইরাসের নাম এসেছে দুটো ভিন্ন জায়গা থেকে। এই দুই জায়গার মধ্যে হয়তো দূরত্ব হাজার হাজার মাইল।

১৯৬৭ সালের গোড়ার দিকে বিজ্ঞানী এবং ডাক্তারদের একটি দল বর্তমানের কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে কাজ করার সময় এই অঞ্চলে একটা রহস্যময় ভাইরাল হেমোরেজিক জ্বরের জন্য দায়ী ভাইরাসের কথা জানিয়েছিলেন। এই ভাইরাসের প্রকোপে ওই অঞ্চলে ১৯৫০ সাল থেকে দেখা যেত।

১৯৬৭ সালের পরের দিকে এক রাশিয়ান ভাইরোলজিস্ট একটা ভাইরাসের বিষয়ে তথ্য প্রকাশ্যে আনেন যা টিক-বাহিত রক্তক্ষরণজনিত জ্বরের লক্ষণ সৃষ্টি করে। ১৯৪০ থেকে এই একই উপসর্গ দেখা যেত ক্রিমিয়া উপদ্বীপে সোভিয়েত সামরিক বাহিনীর মধ্যে।

কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করার পর এই দুই ভাইরাসকে অভিন্ন বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। যে কারণে এর নাম হয় ক্রিমিয়ান-কঙ্গো হেমোরেজিক ফিভার।

২০২২ সালের প্রথমার্ধে ইরাকে এই ভাইরাসের সংক্রমণের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ক্রিমিয়ান-কঙ্গো হেমোরেজিক জ্বরের ২১২ টা ঘটনা নথিভুক্ত হয়। প্রাণ হারিয়েছিলেন ২৭জন।

আশঙ্কা করা হয়েছিল যে এই রোগ নতুন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই ভাইরাস বহনকারী টিক ছড়িয়ে পড়তে পারে উত্তরে ইউরোপের কিছু অংশে যেমন ফ্রান্স, ইতালি, বলকান এবং স্পেনে।

আবিষ্কারের পর দেওয়া ভাইরাসের নাম বিভ্রান্তিকর হতে পারে। এমপক্স এমন একটা রোগ যা কোনও প্রাণীর শরীর থেকে মানুষের শরীরে সংক্রমিত হতে পারে - যা জুনোসিস নামে পরিচিত।

২০২২ সাল পর্যন্ত মাঙ্কিপক্স নামে পরিচিত ছিল এই ভাইরাস। নামটা কলঙ্ক ছড়াতে পারে, এই আশঙ্কা জানিয়ে পরে নাম পরিবর্তনের সুপারিশ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

এই ভাইরাসের নাম আগে মাঙ্কিপক্স রাখার কারণ ছিল কারণ এটা প্রথমে লক্ষ্য করা গিয়েছিল গবেষণার জন্য আফ্রিকা থেকে ইউরোপে আমদানি করা বানরের মধ্যে।

কিন্তু বাঁদর এই ভাইরাসের 'ন্যাচারাল হোস্ট' বা প্রাকৃতিক ধারক নয়, বরং 'অ্যাক্সিডেন্টাল হোস্ট' বা ঘটনাচক্রে হওয়া ধারক।

এই ভাইরাসের প্রাকৃতিক হোস্ট হলো আফ্রিকার এক বিশেষ ধরনের কাঠবিড়ালি-সহ ইঁদুর জাতীয় প্রাণী।

এমপক্স ভাইরাস কিন্তু গুটিবসন্ত (অর্থোপক্সভাইরাস ) শ্রেণিবিভাগের মধ্যে পড়ে। কিন্তু নামে 'পক্স' শব্দের উল্লেখ রয়েছে এমন সমস্ত ভাইরাস কিন্তু একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।

চিকেনপক্স ভাইরাস, যাকে আরও আনুষ্ঠানিকভাবে ভেরিসেলা-জোস্টার ভাইরাস বলা হত, আসলে হারপিস সিমপ্লেক্স ভাইরাসের সঙ্গে সম্পর্কিত।

চিকেনপক্সের সম্পর্ক মুরগির সঙ্গে নেই। বরং এর নামের সম্পর্ক রোগের উপসর্গের সঙ্গে রয়েছে। চিকেনপক্সে চানা বা ছোলার মতো দেখতে ফোস্কা দেখা যায় (যদিও অন্যান্য তত্ত্ব আবার বলে আক্রান্ত শিশুদের দেখে মনে হতো মুরগি ঠুকরেছে)।

আনুষ্ঠানিক ভাবে এই ভাইরাসের নাম 'ভেরিসেলা' (ল্যাটিন) এসেছে 'দাগ' (চিকেনপক্সে সারা শরীরে তরল ভর্তি ফোস্কা) এবং 'জোস্টার' মানে বেল্ট, যা ইঙ্গিত করে আক্রান্তের দেহে দাগ রয়েছে, এমন ব্যান্ডকে।

কিন্তু গত ৪০ বছর ধরে এর শনাক্তকরণের ক্ষেত্রে পরিমার্জনা এলেও আনুষ্ঠানিক নাম 'ভেরিসেলোভাইরাস হিউম্যানালফা ৩' - যা কিছুটা অদ্ভুত শোনায়।

এ থেকে সাম্প্রতিক সময়ে ভাইরাসের নামকরণের পদ্ধতি কীভাবে রূপান্তরিত হয়েছে, সে সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়।

উপসর্গ বা স্থানের নাম অনুসারে ভাইরাসের নামকরণের ক্ষেত্রে একটি অদ্ভুত ধরনের 'রোমান্টিক' আবেদন থাকতে পারে কিন্তু ভাইরাসকে শ্রেণিবদ্ধ করার পদ্ধতি হিসাবে এতে যুক্তি ও শৃঙ্খলার অভাব রয়েছে যা ভাইরোলজিস্টদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো এবং 'অ্যান্টি-ভাইরাল' চিকিৎসার বিকাশের জন্য ভাইরাসের জৈবিক সম্পর্ক বিজ্ঞানীদের বোঝা প্রয়োজন। যাতে ভবিষ্যতে এই ভাইরাস কী প্রভাব ফেলতে পারে এবং তার চিকিৎসা সম্পর্কে আলোকপাত করা যায়।

আর তাই 'ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অন ট্যাক্সোনোমি অব ভাইরাস' বা আইসিটিভি-র (একটি কমিটি যা অনুমোদিত নাম সহ ভাইরাসগুলির তালিকার তৈরি করে) বিজ্ঞানীরা ভাইরাসের নামকরণের ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা আনার বিষয়ে আরও বেশি করে জোর দিচ্ছেন।

জেনেটিক সিকোয়েন্সিং টেকনোলজির অগ্রগতির ফলে ভাইরাসগুলো একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত কি না, তা নির্ধারণ করা সহজ হয়েছে।

দুটো একেবারে ভিন্ন ধরনের ভাইরাস একই রকমের উপসর্গের সৃষ্টি করছে এমন হতেই পারে। যেমন ভাইরাল হেমোরেজিক ফিভারস ভাইরাসের চারটি স্বতন্ত্র ভাইরাসের গোষ্ঠীর কারণে হতে পারে।

তাদের কীভাবে শ্রেণিভুক্ত করা হচ্ছে তা জেনেটিক মেক-আপের উপর নির্ভর করে।

ডিএনএ-এর আন্তঃজড়িত স্ট্র্যান্ড অর্থাৎ সেই 'ডাবল হেলিক্স' আমাদের নিজেদের শরীরে, অন্যান্য প্রাণী, গাছপালা থেকে শুরু করে ব্যাকটেরিয়াতেও দেখা যায়।

কিন্তু ভাইরাসের জগতে এই বিষয়টা অতটা সহজ নয়। কিছু ভাইরাসের ডিএনএ-তে এই ডাবল স্ট্র্যান্ড থাকে, কিন্তু অন্যদের থাকে মাত্র একটা।

ভাইরাল হেমোরেজিক ফিভার, কোভিড-১৯ এবং ফ্লু ভাইরাসের মতো রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাস-সহ অনেক ভাইরাস, আরএনএ নামক একটা ভিন্ন জেনেটিক উপাদান ব্যবহার করে। এর মধ্যে কারও আরএনএ-র দুটি স্ট্র্যান্ড থাকে, আর কারওবা মাত্র একটা।

এই উচ্চ স্তরের জেনেটিক পার্থক্য ভাইরাসগুলোর মধ্যে সম্পর্ক বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। এবং একে ভিত্তি করে ভাইরাসের শ্রেণিবিন্যাসও করা হয়ে থাকে যার সূচনা করেছিলেন ক্যালটেক-এর ভাইরোলজিস্ট ডেভিড বাল্টিমোর।

বিষয়টি এখানেই শেষ হয়ে যায় না। যেমন দুটো এমন ভাইরাসের কথা ধরা যাক, যারা একই ধরনের উপসর্গের সৃষ্টি করে আক্রান্তের শরীরে।

যেমন ডেঙ্গু ভাইরাস হলো 'পজিটিভ আরএনএ ভাইরাস', আর চিকুনগুনিয়াও তাই। কিন্তু আমরা যদি তাদের জেনেটিক কোডের বিস্তারিত বিবরণ দেখি, তাহলে স্পষ্ট হয়ে যাবে যে তারা এক নয়।

কোনও ভাইরাস চেনার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা মিলের চেয়ে অমিল বেশি খোঁজেন। এই দিক থেকে সমস্ত একক-স্ট্র্যান্ডেড পজিটিভ সেন্স-আরএনএ যুক্ত ভাইরাসের গ্রুপ সহায়ক হতে পার। কিন্তু এটাও বেশ বিস্তৃত।

পরিপূরক শ্রেণিবিন্যাস পদ্ধতি হিসাবে সুইডিশ জীববিজ্ঞানী কার্ল লিনিয়াসের একটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি চালু করেন।

এই প্রসঙ্গে আইসিটিভির ভূমিকা বেশ উল্লেখযোগ্য৷ এই কমিটি ভাইরাসকে সুসংগঠিত ভাবে শ্রেণিবদ্ধ করে৷

আইসিটিভির বিশেষজ্ঞদের কমিটিগুলি বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ভাইরাসগুলির গ্রুপিং নিয়ে আলোচনা ও মূল্যায়ন করে এবং সেই অনুযায়ী তাদের শ্রেণিবিন্যাস পরিবর্তন করে।

প্রসঙ্গত, ভাইরাসের আনুষ্ঠানিক নাম ছাড়াও আইসিটিভির শ্রেণিবিন্যাসে বিশেষ নামকরণ করা হয়ে থাকে তাদের।

যেমন আইসিটিভির একটা স্টাডি গ্রুপ ২০১৯ সালে করোনভাইরাসের নাম 'সার্স-কোভ-২' রেখেছিল।

মেরিল্যান্ডের ফোর্ট ডেট্রিকের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস ইন্টিগ্রেটেড রিসার্চ ফ্যাসিলিটির প্রধান ভাইরোলজিস্ট এবং ইবোলা ভাইরাসের বিশেষজ্ঞ জেন্স কুহন বলেছেন, "ভাইরাসগুলি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে চমৎকার।”

নতুন যে ভাইরাস আবিষ্কার হচ্ছে তার শ্রেণিবিন্যাসের দায়িত্বে থাকা আইসিটিভির উপকমিটির চেয়ারম্যানও তিনি।

জেন্স কুহন বলেন, "প্রতিটা নতুন ভাইরাস আবিষ্কার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই কাজ আরও জটিল হয়ে উঠছে।"

একই সঙ্গে বেশ কয়েকটা ভাইরাসের নতুন ভাবে নামকরণও হয়েছে।

ইবোলার আনুষ্ঠানিক নাম আইসিটিভি রেখেছে 'অর্থোইবোলাভাইরাস জাইরেন্সে'। আর ডেঙ্গু?

তার নামও পরিবর্তন করা হয়েছে। ২০২২ সালে আইসিটিভি এর নামকরণও করেছে। ডেঙ্গুর নাম এখন অর্থোফ্লাভিভাইরাস ডেঙ্গুই, হয়তো বৈজ্ঞানিক দিক থেকে আরও সংগঠিত কিন্তু ততটা আকর্ষণীয় নয়!

এই নতুন নাম কিন্তু বেঁচে থাকলে স্পেনের সেই রানি (মারিয়া লুইসা দে পারমাকে) লেখার সময় হোঁচট খেতে বাধ্য করত, যার চিঠিতে ডেঙ্গু রোগের উল্লেখ পাওয়া গিয়েছিল। বিবিসি বাংলা