পুঁজিবাজারের মন্দাভাব যেন কাটছেই না। দেশের প্রধান এ বাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জও (ডিএসই) যেন ভাসছে লেনদেনের ভাটায়। রাজধানীর মতিঝিল থেকে নিকুঞ্জ নিয়ে আলিশান এক ভবন বানিয়েছে ঠিকই; কিন্তু তাতে মিলছে না ব্রোকারেজ হাউজের দেখা। অনেকেই আবার অফিস বন্ধ করে ছাড়ছে ডিএসইর নিকুঞ্জ ভবন। এমন বাস্তবতায় বছর ব্যবধানে সংস্থাটির আয় কমেছে ৪৪ কোটি টাকার বেশি।
দীর্ঘদিন ধরে আস্থার সংকট, লেনদেনে ভাটা, বিনিয়োগকারীদের বাজার ছেড়ে যাওয়া, আর ব্রোকারেজ হাউজগুলোর ব্যবসার মন্দায় টালমাটাল পুঁজিবাজারে এখন খোদ ডিএসই এখন ক্ষতির মুখে। এ অবস্থায় আস্থা ফেরাতে কীভাবে কাজ করবে সংস্থাটি -- এমন প্রশ্ন বিনিয়োগকারীসহ বাজার সংশ্লিষ্টদের। তবে ডিএসই চেয়ারম্যান হাফিজ মুহাম্মদ হাসান বাবু বলছেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটসহ নানা কারণে তারা পরিস্থিতির স্বীকার। শিগগিরই এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠবে বলে আশা তার।
২০১৯ সালের অক্টোবরে রাজধানীর মতিঝিল ছেড়ে নিকুঞ্জে আসে ডিএসই। যদিও তা খুব একটা সুফল বয়ে আনেনি দেশের পুঁজিবাজারের জন্য। এক লাখ ৪৭ হাজার বর্গফুটের ভবনটিতে বর্তমানে ভাড়ায় রয়েছে ৯৯টি ব্রোকারেজ হাউজ, যার মধ্যে ফাঁকা পড়ে আছে ৮০টিরও বেশি। আবার ব্যয় মেটাতে না পারায় ছেড়ে চলে যাচ্ছে কিছু প্রতিষ্ঠান, যার একটি প্রাইলিংক সিকিউরিটিজ লিমিটেড।
সরেজমিনে দেখা যায়, বিনিয়োগকারীর অভাবে ফাঁকা পড়ে আছে হাউজটি। একজন মাত্র লোক দিয়ে চলছে কার্যক্রম। কাঙ্ক্ষিত আয় না আসায় দুবছর আগে নিকুঞ্জে খোলা শাখা অফিসটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। নাম প্রকাশ না করা শর্তে প্রাইলিংক সিকিউরিটিজ লিমিটেডের ইনচার্জ বলেন, ‘বিনিয়োগকারী নেই; তাই আমাদের ব্যবসাও নেই। ক্ষতির মুখে পড়ে তাই এ শাখা অফিসটি বন্ধ করে দিয়ে উত্তরা অফিসে চলে যাচ্ছি। সেখানে আমরা কার্যক্রম চালাব।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ শাখায় আমাদের কিছু অনলাইন ক্লায়েন্ট আছে, তবে এখানে ভাড়া বেশি। সব খরচই বেশি। তাই চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।’
এরই মধ্যে ডিএসইর নিকুঞ্জ ভবন ছেড়ে চলে গেছে শাকো সিকিউরিটিজসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। শুধু তাই নয়, ভবনটি উদ্বোধনের পাঁচ বছর পরেও ফাঁকা পড়ে আছে ৮০টির বেশি ব্রোকারেজ হাউজ। অথচ বিলাসী ভবনটির বিদ্যুৎ বিলসহ বাৎসরিক খরচ মেটাতেই চলে যাচ্ছে প্রায় দেড়শ কোটি টাকা।
হিসাব বলছে, ব্যবসা মন্দায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে ডিএসইর আয় ৪৪ কোটি ১০ লাখ টাকা কমে নেমেছে ৮০ কোটি ৬০ লাখ টাকায়। ফলে সরকারও হারাচ্ছে বড় অঙ্কের রাজস্ব।
ডিএসইর বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য, ২০২১-২২ অর্থবছরের সংস্থাটির আয় এসেছে ৩২১ কোটি ৩০ লাখ টাকা, আর ব্যয় হয়েছে ১৪১ কোটি টাকা। ট্যাক্স পরিশোধের আগে তাদের নিট আয় থাকে ১৮০ কোটি ৩০ লাখ টাকা, আর ট্যাক্স পরিশোধের পর থাকে ১২৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা। অন্যদিকে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ডিএসইর আয় ছিল ২৩৮ কোটি ২০ লাখ টাকা, ব্যয় ছিল ১৩১ কোটি ২০ লাখ টাকা। ট্যাক্স পরিশোধের আগে নিট আয় ১০৭ কোটি টাকা, আর ট্যাক্স পরিশোধের পর ৮০ কোটি ৬০ লাখ টাকা। অর্থাৎ বছর ব্যবধানে ডিএসইর আয় কমেছে ৪৪ কোটি ১০ লাখ টাকা।
ব্রোকার্সদের সংগঠন ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম সময় সংবাদকে বলেন, এতোদিন পর ডিএসইর এমন অবস্থা হবে, তা প্রত্যাশিত নয়। তারা নিজেরাই নিজেদেরকে স্বাধীন ভাবে না, স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। গুরুত্বপূর্ণ এমডি পদ খালি পড়ে থাকে। বর্তমান শেয়ার বাজারে যে অবস্থা তার দায় ডিএসই এড়াতে পারে না।
নিকুঞ্জ ভবনে এসেও কোনো পরিবর্তন নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, বরং এমন বিলাসী ভবন চালাতে হলে এখন প্রতিদিন অন্তত ৩ হাজার কোটি টাকার টার্নওভার দরকার। অথচ হাজার কোটিও লেনদেন ছাড়াতে পারছে না ডিএসই। এমন মন্দাবস্থায় আছে ব্রোকারেজ হাউজগুলোও। তারা ব্যয় মেটাতে না পেরে শাখা বন্ধ করে চলে যাচ্ছে।
এ বাস্তবতায় সবকিছু ছাপিয়ে ডিএসইর নিকুঞ্জ ভবনকে পুঁজিবাজারের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করাটাকেই বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন ডিএসই চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, পুঁজিবাজারে যে ক্রান্তিকাল চলছে, তার ঘা ডিএসইতেও লেগেছে।
তবে এখান থেকে কীভাবে উত্তরণ ঘটানো যায়, সে বিষয়ে চেষ্টা চলছে জানিয়ে হাফিজ মুহাম্মদ বলেন, ‘দুই-একটি হাউজ চলে গেছে এটা ঠিক, তবে আবার নতুন করে অনেকে আসছেও। ব্রোকারেজ হাউজ বাদেও আমরা ভবনে অন্যান্য করপোরেট প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আশা করি, আমরা এ পরিস্থিতি থেকে শিগগিরই ঘুরে দাঁড়াতে পারব।’ সময় সংবাদ