বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে দেশজুড়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। প্রাথমিক অবস্থায় মানুষের জানমালের ক্ষতি হলেও দীর্ঘমেয়াদে এ আঘাত দেশের অর্থনীতির প্রধান কয়েকটি খাতে আসতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা।
শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন ঘিরে দেশজুড়ে তাণ্ডব শুরু হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কারফিউ জারির মতো সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। যেখানে বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রধান শর্তই হচ্ছে একটি দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সেখানে দেশ এতটাই অস্থিতিশীল হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় পুরো ব্যাপারটা যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রথম এবং দীর্ঘমেয়াদি আঘাত বৈদেশিক বিনিয়োগের ওপর আসতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান সময় সংবাদকে বলেন, দীর্ঘমেয়াদে বৈদেশিক বিনিয়োগে বড় রকমের ধাক্কা খাবে বাংলাদেশ। এমনিতেই দেশের অর্থনীতির অবস্থা ভালো না। তারমধ্যে দেশে যা ঘটে গেল এর সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বিদেশি বিনিয়োগের ওপর।
বিশ্বব্যাংকের সবশেষ হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ যেখানে জিডিপির দেড় শতাংশের কম, সেখানে মালদ্বীপে বিদেশি বিনিয়োগ ১২ শতাংশের বেশি, আর অর্থনৈতিক সংকট পাড়ি দিয়ে শ্রীলঙ্কায় বৈদেশিক বিনিয়োগও ২০ শতাংশের বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালে মোট বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ৩.০ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২২ সালে ছিল ৩.৪৮ বিলিয়ন ডলার। এতে করে এক বছরের ব্যবধানে বিনিয়োগ কমেছে ১৬ শতাংশ।
এ ব্যাপারে সেলিম রায়হান বলেন, এমনিতেই বাংলাদেশের বিদেশি বিনিয়োগ কমছে। এর ওপরে বিদেশিরা যদি দেখেন বাংলাদেশে রাজনৈতিক নিরাপত্তার অভাব আছে তাহলে এই বিনিয়োগ গিয়ে ঠেকবে তলানিতে। বিদেশি বিনিয়োগের পাশাপাশি সংঘটিত সহিংসতায় বাংলাদেশের রফতানি খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) পক্ষ থেকে জানানো হয়, এ কয়দিনের সংঘাতে দেশের পোশাক খাতে প্রতিদিন দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। সে হিসাবে গত কয়েক দিনে এই এক খাতেই মোট ক্ষতির পরিমাণ ৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
সংঘাতের কারণে কয়েকদিনের জন্য থমকে গিয়েছিল আমদানি-রফতানি কার্যক্রম, বন্ধ ছিল কল-কারখানা। এমনিতেই দেশের পোশাক খাতের প্রবৃদ্ধির নেতিবাচক ধারার মধ্যে আকস্মিক এ আঘাতে রফতানি খাত আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন খাতসংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে বিদেশে বাংলাদেশের পোশাকখাত নিয়ে এত বছর ধরে যে আস্থার জায়গা তৈরি হয়েছিল, সেটিতে ফাঁটল ধরার শঙ্কা করছেন তারা।
দেশে চারদিনের বেশি ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ থাকায় বাণিজ্যিক বন্দরের কার্যক্রম এক রকমের বন্ধ ছিল। এতে করে গড়ে প্রতিদিন কয়েক হাজার চালান আটকে ছিল। চালান আটকে থাকার কারণে বিদেশি ব্যবসায়ীরা ঠিক সময়ে হাতে পণ্য পাবেন না। আর এতে করে ব্যবসায়িক অঙ্গীকারের জায়গাটি নষ্ট হবে।
এ ব্যাপারে সানেমের নির্বাহী পরিচালক বলেন, এ ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকলে বাংলাদেশের ওপরে আর ভরসা রাখতে পারবেন না বিদেশি ক্রেতারা। তখন তারা নতুন বাজার খুঁজতে শুরু করবেন। এমন না শুধু বাংলাদেশই তৈরি পোশাক তৈরি করেন। বাকি যারা বাজারে আছেন তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে হলে বাংলাদেশের বাজারে স্থিতিশীলতা প্রয়োজন, আর বাজারে স্থিতিশীলতা তখনই আসবে যখন রাজনৈতিক পরিবেশ স্বাভাবিক হবে।
তিনি আরও বলেন, বৈদেশিক বিনিয়োগ ও রফতানি বাণিজ্যের বাইরে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি সামাল দেয়া। টানা দুবছর ধরে সরকার যে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে তা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। প্রায় এক বছর ধরে দেশে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপর এবং বেশিরভাগ সময়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সবশেষ বার্ষিক মূল্যস্ফীতির হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ এবং ১২ মাসের মধ্যে সাত মাসেই খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ শতাংশের বেশি। নতুন অর্থবছরেও বাজার পর্যবেক্ষণ করে বোঝা যাচ্ছে, দেশের বাজারে মূল্যস্ফীতি নিয়ে এখনই কোনো সুখবর পাওয়ার ন্যূনতম সম্ভাবনা নেই।
বিশেষ করে টানা এ কয়দিনের আন্দোলন এবং এরপর সরকার ঘোষিত কারফিউয়ের কারণে দেশের সরবরাহ খাতে বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে; যার চিত্র মেলে সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের দিকে তাকালে।
সময় সংবাদের চট্টগ্রাম ব্যুরোর পাঠানো সংবাদের ভিত্তিতে দেখা যায়, গত এক সপ্তাহে খাতুনগঞ্জে বেচাকেনা কমেছে ৯০ শতাংশের বেশি এবং প্রতিদিন ১ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে ইন্টারনেট না থাকার কারণে এবং মহাসড়ক কারফিউয়ের আওতাভুক্ত থাকায় এ কয়দিন খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের এক রকমের বেকার সময় কাটাতে হয়েছে।
খাতুনগঞ্জে এই বেচাকেনা না হওয়ার প্রভাব ঢাকার বাজারে পড়েছে সঙ্গে সঙ্গে। সবজি থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়েছে শঙ্কার চেয়েও বেশি।
এদিকে প্রতিদিন পোল্ট্রিখাতে ১০০ কোটি টাকা ক্ষতি হওয়ার কারণে ব্রয়লার মুরগি আর ডিমের দাম হু হু করে বেড়েছে রাজধানীর বাজারে। কারফিউয়ের সময় কেজিপ্রতি ব্রয়লার মুরগি ও ডজনপ্রতি ডিম এলাকা ভেদে ২০০ টাকায় পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে।
এ বিষয়ে সেলিম রায়হান বলেন, এমনিতেই মূল্যস্ফীতির চাপে পর্যদুস্থ ছিল দেশের অর্থনীতি ও জনজীবন। এর মধ্যে কারফিউ দেয়া এবং শান্তিপূর্ণ আন্দোলন সহিংস রূপ নেয়ায় দেশের বাজারে সরবরাহ ব্যবস্থা এক সপ্তাহের জন্য প্রায় ভেঙে পড়েছিল। এখন পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও এতদিনের সরবরাহ ব্যবস্থার এ শূন্যস্থানের কাফফারা মানুষকে মূল্যস্ফীতির আঘাত সয়ে মেটাতে হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। সময় সংবাদ।