
ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ভ্লাদিমির পুতিনের বৈঠকের দিকে তাকিয়ে ছিলো পুরো বিশ্ব। দুই নেতার বৈঠকের বিষয়টি চূড়ান্ত হওয়ার পর থেকেই আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোতে ব্যাপক কাভারেজ পেয়েছে। অবশেষে প্রতীক্ষিত বৈঠকটি হয়ে গেলো যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায়। বৈঠকের মূল আলোচ্য বিষয় ছিলো ইউক্রেন। তবে বৈঠকে যুদ্ধবিরতি কিংবা কোনো চুক্তিতে পৌঁছতে পারেননি তারা। যদিও বৈঠক ফলপ্রসূ হয়েছে বলে দুই নেতাই বলেছেন।
বৈঠকের পর মিডিয়ার সামনে কথা বলেন পুতিন এবং ট্রাম্প। তবে সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্ন তারা নেননি।
বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে পুতিনের বক্তব্য:
আমাদের আলোচনা গঠনমূলক ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে। (আলোচনা) ছিল খুবই বিস্তারিত ও ফলপ্রসূ। আবারও আমি আমার মার্কিন সহকর্মীকে ধন্যবাদ জানাতে চাই আলাস্কায় আসার প্রস্তাব দেওয়ার জন্য— এখানে সাক্ষাৎ করা বেশ যুক্তিসঙ্গত। কারণ, আমাদের দেশ দুটি মহাসাগর দ্বারা আলাদা হলেও প্রকৃতপক্ষে কাছের প্রতিবেশী। আর যখন আমরা দেখা করলাম, আমি বিমান থেকে নেমে বলেছিলাম, ‘শুভ অপরাহ্ণ, প্রিয় প্রতিবেশী! আপনাকে সুস্থ ও সজীব দেখে আমি সত্যিই খুব আনন্দিত।’
এটিও গুরুত্বপূর্ণ যে, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আলাস্কার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এর সঙ্গে রয়েছে অনেক ইতিবাচক ঘটনা। উদাহরণস্বরূপ, রাশিয়ান আমেরিকা যুগের (যখন আলাস্কা রাশিয়ার অধীনে ছিল) সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আজও এখানে সংরক্ষিত রয়েছে— অর্থোডক্স চার্চ এবং অসংখ্য (সাতশ’রও বেশি) রুশ উৎস থেকে আগত ভৌগোলিক নাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও আলাস্কাতেই শুরু হয়েছিল কিংবদন্তি বিমানপথ, যার মাধ্যমে লেন্ড-লিজ চুক্তির আওতায় যুদ্ধবিমান ও অন্যান্য সরঞ্জাম সরবরাহ করা হতো।
এটি ছিল বিস্তীর্ণ বরফাচ্ছন্ন অঞ্চলের ওপর দিয়ে এক বিপদসংকুল, কঠিন রুট। কিন্তু দুই দেশের পাইলট ও বিশেষজ্ঞরা বিজয়কে আরও কাছে আনতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন। তারা ঝুঁকি নিয়েছিলেন, এমনকি এক যৌথ বিজয়ের জন্য জীবনও উৎসর্গ করেছিলেন। আমি সম্প্রতি রাশিয়ার মাগাদান শহরে গিয়েছিলাম, যেখানে রুশ-আমেরিকান পাইলটদের স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে— সেখানে রয়েছে একটি মার্কিন পতাকাও।
আমরা সবসময় সেই অন্যান্য ঐতিহাসিক উদাহরণগুলোকে স্মরণ করব, যখন আমাদের দুই দেশ সামরিক ভ্রাতৃত্ব ও জোটের চেতনায় একসঙ্গে সাধারণ শত্রুদের পরাজিত করেছিল এবং একে অপরকে সহায়তা ও সমর্থন দিয়েছিল। আমি নিশ্চিত, এই ঐতিহ্য আমাদেরকে নতুন পর্যায়ে পারস্পরিকভাবে লাভজনক ও সমতার ভিত্তিতে সম্পর্ক পুনর্গঠন ও গড়ে তুলতে সহায়তা করবে— এমনকি সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতেও।
যেমনটি সবারই জানা, রুশ-আমেরিকান শীর্ষ বৈঠক গত চার বছরেরও বেশি সময় ধরে অনুষ্ঠিত হয়নি। এটি অনেক দীর্ঘ সময়। এই সময়ে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত কঠিন। সত্যি বলতে গেলে, সম্পর্ক নেমে গিয়েছিল শিতল যুদ্ধের পর থেকে সবচেয়ে নিচু পর্যায়ে। আর এটি আমাদের দুই দেশের জন্য তো বটেই, পুরো বিশ্বের জন্যও ভালো নয়। স্পষ্টতই, আগে অথবা পরে পরিস্থিতি সংশোধন করা দরকার ছিল— সংঘাত থেকে সংলাপে আসা জরুরি ছিল। আর সে প্রেক্ষাপটে দুই রাষ্ট্রপ্রধানের সরাসরি সাক্ষাৎ অনেক আগেই প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। অবশ্যই শর্ত ছিল গুরুত্ব সহকারে এবং ধৈর্যশীল প্রস্তুতির— সেই কাজ সামগ্রিকভাবে সম্পন্ন হয়েছে।
আমাদের (মার্কিন) প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে সরাসরি খুব ভালো যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমরা বারবার খোলাখুলি ফোনে কথা বলেছি। মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিশেষ প্রতিনিধি (স্টিভ) উইটকফ আমাদের রাশিয়ায় একাধিকবার এসেছেন, আর আমাদের সহযোগী ও পররাষ্ট্র নীতির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারাও নিয়মিত যোগাযোগে ছিলেন।
আপনারা ভালোভাবেই জানেন ও বোঝেন, আলোচনার অন্যতম কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল ইউক্রেনকে ঘিরে পরিস্থিতি। আমরা দেখছি, মার্কিন প্রশাসন এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ব্যক্তিগতভাবে ইউক্রেন সংকট সমাধানে ভূমিকা রাখতে আগ্রহী— তারা বিষয়টির গভীরে যেতে এবং এর উৎপত্তি বোঝার চেষ্টা করছেন। আমি একাধিকবার বলেছি, রাশিয়ার জন্য ইউক্রেনে সংঘটিত ঘটনাগুলো আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার মৌলিক হুমকির সঙ্গে জড়িত। তাছাড়া, আমরা সবসময় ইউক্রেনের জনগণকে—এবং আমি একাধিকবার এটা বলেছি— ভ্রাতৃপ্রতিম মনে করেছি এবং করি, আজকের পরিস্থিতিতে এটি যতই অস্বাভাবিক শোনাক না কেন। আমাদের একই শিকড়, আর সেখানে যা ঘটছে আমাদের জন্য এক গভীর বেদনা ও ট্র্যাজেডি। তাই আমাদের দেশ আন্তরিকভাবে এই পরিস্থিতির অবসান চায়।
কিন্তু একদিকে আমরা আশ্বস্ত যে, ইউক্রেনের বিষয়টি স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য সঙ্কটের সমস্ত মূল কারণ— যা বারবার আলোচনা করা হয়েছে— অপসারণ করতে হবে, রাশিয়ার সব বৈধ উদ্বেগ বিবেচনায় নিতে হবে এবং ইউরোপ ও সমগ্র বিশ্বের নিরাপত্তা ক্ষেত্রে একটি ন্যায়সঙ্গত ভারসাম্য পুনঃস্থাপন করতে হবে। আমি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে একমত— তিনি আজ এ বিষয়ে কথা বলেছেন— নিশ্চিতভাবেই ইউক্রেনের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে হবে। অবশ্যই, আমরা এ বিষয়ে কাজ করতে প্রস্তুত। আমি আশা করতে চাই, যে বোঝাপড়া আমরা অর্জন করেছি তা আমাদেরকে এই লক্ষ্য পূরণের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে এবং ইউক্রেনে শান্তির পথ খুলবে। আমরা আশা করি, কিয়েভ এবং ইউরোপীয় রাজধানীগুলো এটিকে গঠনমূলকভাবে গ্রহণ করবে, কোনো বাধা সৃষ্টি করবে না বা প্রবর্তনশীল অগ্রগতিকে ধ্বংস করতে কোনো ধরনের উস্কানি বা গোপন ষড়যন্ত্রের চেষ্টা করবে না।
আমি আমাদের যৌথ কাজের জন্য এবং বন্ধুত্বপূর্ণ ও বিশ্বাসমূলক আলাপের ধরণের জন্য মি. ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। মূল বিষয় হলো উভয় পক্ষই ফলাফলের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। আমরা দেখছি, মার্কিন প্রেসিডেন্টের স্পষ্ট ধারণা আছে তিনি কী অর্জন করতে চান, তিনি আন্তরিকভাবে তার দেশের সমৃদ্ধি নিয়ে চিন্তিত এবং একই সঙ্গে রাশিয়ার জাতীয় স্বার্থ বোঝার প্রতিও সচেতনতা দেখান। আমি আশা করি, আজকের চুক্তিগুলো শুধু ইউক্রেন সমস্যার সমাধানের জন্য একটি দিশারী হয়ে থাকবে না বরং রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ব্যবসাসুলভ, বাস্তবমুখী সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের সূচনা হিসেবেও চিহ্নিত করবে।
ট্রাম্পের বক্তব্য:
“আমি মনে করি, আমাদের খুবই ফলপ্রসূ বৈঠক হয়েছে। অনেক অনেক বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি, বেশিরভাগ বিষয়ে, আমি বলতে পারি কয়েকটি বড় বিষয় আছে যা এখনো সম্পূর্ণভাবে সমাধান হয়নি, তবে আমরা কিছু অগ্রগতি করেছি। সুতরাং, চুক্তি তখনই কার্যকর হবে যখন চুক্তি সম্পন্ন হবে। আমি কিছুক্ষণ পর ন্যাটো-কে কল করব, বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক ব্যক্তিদের কল করব এবং অবশ্যই প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে কল করে আজকের বৈঠকের কথা জানাব। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত তাদের উপরই নির্ভর করে। তাদেরকে মর্কো (রুবিও, স্টেট সেক্রেটারি), স্টিভ (উইটকফ, বিশেষ দূত) এবং ট্রাম্প প্রশাসনের কিছু ব্যক্তির সাথে একমত হতে হবে, যারা এখানে এসেছেন— স্কট (বেসসেন্ট, ট্রেজারি সেক্রেটারি) এবং জন র্যাটক্লিফ (সিআইএ ডিরেক্টর), তাদের ধন্যবাদ।
আমাদের কিছু সত্যিই দুর্দান্ত নেতা আছেন, যারা অসাধারণ কাজ করছেন। এখানে আমাদের কিছু অসাধারণ রাশিয়ান ব্যবসায়ী প্রতিনিধিও আছেন। আমি মনে করি, সবাই আমাদের সঙ্গে চুক্তি করতে চায়। খুব অল্প সময়ে আমরা বিশ্বের সবচেয়ে “হট” দেশ হয়ে উঠেছি। আমরা সেই সুযোগের অপেক্ষায় আছি। আমরা চুক্তি করার জন্য অপেক্ষা করছি। আমরা আজ সত্যিই অনেক অগ্রগতি করেছি। আমি সবসময় প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে অসাধারণ সম্পর্ক বজায় রেখেছি, ভ্লাদিমিরের সঙ্গে। আমাদের অনেক কঠিন বৈঠক হয়েছে, তবে ভাল বৈঠকও হয়েছে।
“রাশিয়া, রাশিয়া, রাশিয়া” বলে মিথ্যা কেলেঙ্কারির ধোয়া তুলে আমাদের কাজ বিঘ্নিত করা হয়েছে। এটি আমাদের কাজকে কিছুটা কঠিন করেছে, তবে তিনি এটি বুঝেছেন। আমি মনে করি, তার পুরো ক্যারিয়ারজুড়ে তিনি (পুতিন) এমন অনেক কিছু দেখেছেন। তিনি সব দেখেছেন। কিন্তু আমাদেরকে “রাশিয়া, রাশিয়া, রাশিয়া” কেলেঙ্কারি সহ্য করতে হয়েছে। তিনি জানতেন এটি একটি মিথ্যা অভিযোগ এবং আমিও জানতাম এটি মিথ্যা। তবে যা হয়েছে তা বেশ অপরাধমূলক এবং এটি আমাদের দেশের ব্যবসায়িক কার্যক্রমে সমস্যার সৃষ্টি করেছে।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, আমি কিছু ফোন কল শুরু করব এবং তাদের জানাব কী হয়েছে। তবে আমাদের বৈঠক অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে, অনেক বিষয়ের ওপর একমত হয়েছি। মাত্র কয়েকটি বিষয় বাকি রয়েছে, সেগুলো তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে একটি বিষয় সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে আমাদের ঐক্যমত্যে পৌঁছানোর ভালো সুযোগ রয়েছে। আমরা এখনো পৌঁছাতে পারিনি, তবে সেখানে পৌঁছানোর ভালো সুযোগ আছে।
আমি প্রেসিডেন্ট পুতিন এবং তার পুরো টিমকে ধন্যবাদ জানাই, যাদের অনেককে আমি চিনি অথবা পত্রিকায় তাদের চেহারা আমি সবসময় দেখি। আপনারা প্রায় আপনাদের বসের (পুতিনের) জনপ্রিয়, বিশেষ করে এই ব্যক্তি (রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেইল ল্যাভরভের দিকে ইঙ্গিত করে)। বছরের পর বছর ধরে আমাদের কিছু ভাল বৈঠক হয়েছে, ফলপ্রসূ বৈঠক হয়েছে। আমরা আশা করি ভবিষ্যতেও হবে। এখনই সবচেয়ে ফলপ্রসূ বৈঠকটি করা যাক। আমরা প্রতি সপ্তাহে হাজার হাজার মানুষকে হত্যার হাত থেকে বাঁচাতে যাচ্ছি। প্রেসিডেন্ট পুতিনও সেটাই চাচ্ছেন যেমনটা আমি চাই। তাই, পুনরায়, মি. প্রেসিডেন্ট, আপনাকে ধন্যবাদ জানাই এবং খুব শিগগিরই আবার কথা বলব এবং সম্ভবত আবার দেখা হবে।”
ট্রাম্পের কথার জেরে ভ্লাদিমির পুতিন ইংরেজিতে বলেন, নেক্সট টাইম ইন দ্যা মস্কো, অর্থাৎ পরের বার মস্কোতে দেখা হবে।