উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং আন আগামী সপ্তাহে বেইজিংয়ে এক সামরিক কুচকাওয়াজে অংশ নেবেন বলে জানিয়েছে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ধারণা করা হচ্ছে, এটাই তার প্রথম আন্তর্জাতিক পর্যায়ের শীর্ষ বৈঠক।
জাপানের বিরুদ্ধে চীনের যুদ্ধের ৮০ বছর পূর্তি এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির স্মরণে এই 'বিজয় দিবস' এর কুচকাওয়াজ পালন করা হবে। ১৯৫৯ সালের পর এই প্রথম উত্তর কোরিয়ার কোনো নেতা চীনের সামরিক কুচকাওয়াজে যোগ দেবেন।
এটি কিমের প্রথম বহুপাক্ষিক আন্তর্জাতিক বৈঠক, যা এই অনুষ্ঠানকে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের জন্য একটি কূটনৈতিক বিজয়ে পরিণত করেছে, কারণ তিনি বেইজিং-নেতৃত্বাধীন একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থার জন্য জোর দিচ্ছেন।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনসহ মোট ২৬ জন রাষ্ট্রপ্রধান এই কুচকাওয়াজে যোগ দেবেন বলে আশা করা হচ্ছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাদের মধ্যে থাকছেন না।
এই প্যারেডে চীন তার সর্বশেষ অস্ত্রভাণ্ডার প্রদর্শন করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে শত শত এয়ারক্রাফট, ট্যাংক এবং অ্যান্টি-ড্রোন সিস্টেম থাকবে।
অত্যন্ত সুশৃঙ্খল এই প্যারেডে হাজার হাজার সামরিক সদস্য তিয়েনআনমেন স্কয়ারে যোগ দেবেন।
এতে চীনের সামরিক বাহিনীর ৪৫টি ইউনিটের সৈন্যদের পাশাপাশি প্রবীণ যোদ্ধারাও অংশ নেবেন।
প্রায় ৭০ মিনিটের এ কুচকাওয়াজ চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং পর্যবেক্ষণ করবেন।
বিশ্লেষকরা এবং পশ্চিমা শক্তিগুলোও এই প্যারেড নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ সম্মেলনে পিয়ংইয়ংয়ের ঘনিষ্ঠতম মিত্রদের অন্যতম বেইজিং তাদের প্রতিবেশীকে দশকের পর দশক ধরে চলা 'ঐতিহ্যবাহী বন্ধুত্বের' জন্য প্রশংসা করেছে।
দুই দেশ ভবিষ্যতেও 'আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা' রক্ষায় একসাথে কাজ করবে বলে জানিয়েছে।
২০১৫ সালে চীনের সবশেষ বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজে পিয়ংইয়ং তাদের শীর্ষ কর্মকর্তাদের একজন চো রিয়ং হে কে পাঠিয়েছিল। ফলে এবার কিমের উপস্থিতিকে বড় ধরনের একটি অগ্রগতি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এছাড়া কয়েকদিন আগে ডোনাল্ড ট্রাম্পও কিম জং আনের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।
বেইজিংয়ের কেন্দ্রে আয়োজিত কুচকাওয়াজে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের পাশে কিমের দাঁড়ানো নিঃসন্দেহে এক বিশেষ ছবি হয়ে উঠবে।
চীনের এই পদক্ষেপ এখানে ইঙ্গিত দিচ্ছে, এই খেলার ভূ-রাজনৈতিক কার্ড তার হাতেই। দুই নেতার ওপরই তার প্রভাব রয়েছে, যদিও তা সীমিত।
সময়ের বিষয়টিও এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানের জন্য পুতিনের সঙ্গে একটি চুক্তি করার চেষ্টা করছেন।
আবার কয়েকদিন আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প কিম জং আনের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।
এর মধ্যে এমন এক সময়ে এই প্যারেড হচ্ছে যখন হোয়াইট হাউস ইঙ্গিত দিয়েছে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এশিয়ার এই অঞ্চলে থাকতে পারেন, যদিও সফর এখনো নিশ্চিত করা হয়নি। অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি বাণিজ্য চুক্তি নিশ্চিত করতে শি জিনপিং এর সঙ্গে এসময় তার দেখা করার আগ্রহ রয়েছে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
ফলে কিম ও পুতিনের সংস্পর্শে পূর্ণাঙ্গ ব্রিফিং নিয়ে চীনা নেতা শি জিনপিং আরও বেশি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ট্রম্পের সঙ্গে বসতে পারবেন বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
কিম জং আন সর্বশেষ চীন সফর করেছিলেন ছয় বছর আগে, ২০১৯ সালে। দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৭০তম বার্ষিকী উদযাপনের সময় তিনি বেইজিং সফর করেছিলেন।
এরও আগে উত্তর কোরিয়ার এই নিভৃতচারী নেতা ২০১৮ সালে তিনবার বেইজিং সফর করেছিলেন।
যেহেতু তিনি খুবই কম বিদেশ সফর করেন তাই ওই বছর ছিল তার জন্য আন্তর্জাতিক সফরের ক্ষেত্রে ব্যস্ততম বছর।
এদিকে, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়ান নেতা পুতিনের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে বেশিরভাগ পশ্চিমা নেতার এই প্যারেডে যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা নেই।
'জাপানবিরোধী বার্তা' উল্লেখ করে জাপান এর আগেও বিদেশি নেতাদের এই কুচকাওয়াজে যোগ না দিতে আহ্বান জানিয়েছিল।
এখন প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট লি জে মিয়ং কি এই প্যারেডে যোগ দেবেন?
এটা হলে ২০১৯ সালে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার নেতাদের জন্য প্রথম সাক্ষাতের সুযোগ তৈরি হবে।
লিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি। তার পরিবর্তে সরকার একজন নিম্নপদস্থ রাজনীতিবিদকে পাঠানোর পরিকল্পনা করছিল।
তবে গত জুনে নির্বাচিত হওয়া লি বারবারই বলেছেন তিনি কিম জং আনের সাথে কথা বলতে চান এবং উত্তর কোরিয়ার সাথে একটি শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করতে চান।
গত সোমবার ওভাল অফিসে যখন লি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাথে দেখা করেছিলেন তখন তিনি ট্রাম্পকে কোরীয় উপদ্বীপে শান্তির জন্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করার অনুরোধ জানান।
লি আরও বলেছেন, তিনি বেইজিং এর সাথে সম্পর্ক জোরদার করতে চান।
কিন্তু উত্তর কোরিয়া তার সব ধরনের উদ্যোগ প্রত্যাখ্যান করে বারবার তার সমালোচনা করেছে।
গতকালই মাত্র দেশটির রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা কেসিএনএ লিকে 'সংঘাতপ্রিয় উন্মাদ' বলে অভিহিত করেছে।
যদি লি এই প্যারেডে অংশ নেন তবে শারীরিকভাবে তার কিমের কাছাকাছি আসবেন, কিন্তু এটা ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ হবে।
যদি কিম এই দক্ষিণ কোরিয়ার নেতাকে অথবা অন্য কোনো রাজনীতিবিদকে প্রকাশ্যে উপেক্ষা অথবা প্রত্যাখ্যান করেন তবে এটা বড় রকমের বিব্রতকর ঘটনা হবে।
রাশিয়া, বেলারুশ এবং ইরানের প্রেসিডেন্টদের পাশে লিকে দাঁড়াতে দেখার বিষয়টি দক্ষিণ কোরিয়া এড়িয়ে যেতে চাইতে পারে।
লি এই প্যারেডে যোগ দেবেন কিনা দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের কার্যালয় তা আজ পর্যন্ত জানায়নি।
কুচকাওয়াজে অংশগ্রহণকারী নেতাদের তালিকাও চীনের উত্থান এবং বিশ্বের সাথে তার পরিবর্তিত সম্পর্কের প্রতিফলন করে।
ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট এবং মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী সেখানে থাকবেন, যা প্রতিবেশী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে সম্পর্ক জোরদার করার জন্য বেইজিংয়ের সমন্বিত প্রচেষ্টার আরও প্রমাণ। তবে সিঙ্গাপুরের মতো অন্যান্য দেশ নিম্ন-স্তরের প্রতিনিধি পাঠাচ্ছে।
এতে যোগ দেবেন মিয়ানমারের সামরিক শাসক মিন অং হ্লিয়াং, আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন একজন ব্যক্তি যিনি চীনা বাণিজ্য ও সাহায্যের ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্মকর্তাদের সংখ্যা কম থাকবে, শুধু স্লোভাকিয়ার প্রধানমন্ত্রী রবার্ট ফিৎসো উপস্থিত থাকবেন। বুলগেরিয়া ও হাঙ্গেরি তাদের প্রতিনিধি পাঠাবে।