শেষ হতে যাচ্ছে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসের বাংলাদেশ অধ্যায়। এরই মধ্যে বাংলাদেশে নতুন রাষ্ট্রদূত হিসেবে স্যাংশন ডিপার্টমেন্টের সাবেক কর্মকর্তা ডেভিড মিলের নাম ঘোষণা করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। দেশটির সরকারের নানা পর্যায়ের শুনানি এবং সিনেটে অনুমোদনের পর ডেভিড মিলের পদায়ন কার্যকর হতে সময় লাগবে আরও কয়েক মাস। এই মিল এক সময় কাজ করেছেন ঢাকার মার্কিন দূতাবাসেও।
আসা যাক বিদায়ী রাষ্ট্রদূত পিটার হাস প্রসঙ্গে। মার্শা ব্লুম বার্নিকাটের পর ২০২২ সালের মার্চে বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব নিয়ে আসেন পিটার হাস। দায়িত্ব নেয়ার পর প্রথম কয়েক মাস স্বাভাবিক নিয়মে রুটিন কাজ করে গেছেন তিনি। তবে ২০২২ সালের ডিসেম্বর থেকে তাকে দেখা যায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নানা বিষয়ে নাক গলাতে।
২০২২ সালের ১৪ ডিসেম্বর গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের সংগঠন মায়ের ডাকের সঙ্গে বৈঠক করতে তেজগাঁওয়ের শাহীনবাগে বিএনপির নিখোঁজ নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বাড়িতে যান তিনি। ওই বাড়িতে রাষ্ট্রদূতকে ঘিরে ধরে স্মারকলিপি হাতে তুলে দেয়ার চেষ্টা করে মায়ের কান্না নামের আরেকটি সংগঠনের কর্মীরা। যাদের স্বজনরা ১৯৭৭ সালে সামরিক বাহিনীর কথিত বিদ্রোহ দমনের নামে হত্যাকাণ্ডের স্বীকার হয়েছিলেন। তখন তড়িঘড়ি করে পিটার হাস সেখান থেকে চলে আসেন। এ ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
এর প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র্রের পররাষ্ট্র দফতর থেকে বলা হয়, ঢাকায় রাষ্ট্রদূত ও দূতাবাসের কর্মকর্তারা ১৪ ডিসেম্বর একটি বৈঠক দ্রুত শেষ করেছেন নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগের কারণে। আমরা আমাদের উদ্বেগের বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে জানিয়েছি।
পিটার হাসও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে জরুরি বৈঠক করে নিরাপত্তা উদ্বেগের কথা জানান। ১৫ ডিসেম্বর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক অনুষ্ঠানে প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন জানান, শাহীনবাগে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে হওয়া অপ্রীতিকর ঘটনাকে নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঢাকা ও ওয়াশিংটনের সম্পর্কের অবনতি ঘটারও কোনো আশঙ্কা নেই।
এরপরের বছর অর্থাৎ ২০২৩ সাল পুরোটাই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে নাওয়া খাওয়া ভুলে দৌড়ঝাঁপ করেন পিটার হাস। বেশির ভাগ সময় বাংলাদেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো প্রকাশ্যে, কখনো গোপনে পিটার হাসের সঙ্গে বৈঠক করেন। এমনকি যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন হারানো জামায়াতে ইসলামের সঙ্গেও মিলিত হন পিটার হাস।
এছাড়া সরকারি দল আওয়ামী লীগের সঙ্গেও দেখা করে নানা বিষয়ে কথা বলেন তিনি। সব মিলিয়ে কূটনীতিক নয় বরং অনেকটাই রাজনৈতিক কর্মীর মতো ছিল তার আচরণ। এ সময় আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে শর্তহীন সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়ে ডোনাল্ড লু ও পিটার হাস চিঠি দিলেও তাতে সাড়া দেয়নি কোনো দলই।
গেলো বছরের ২৪ মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের পুরনো ভিসানীতি নতুন করে ঘোষণা দিয়ে জানায়, সুষ্ঠু নির্বাচন ও গণতন্ত্র বিকাশের অন্তরায় হবেন যারা তারাই পড়বেন ভিসানীতির আওতায়। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের এই ঘোষণার পর আগ বাড়িয়ে পিটার হাস মন্তব্য করেন গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমকর্মীরাও পড়তে পারেন ভিসানীতির আওতায়। পরে অবশ্য মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে এনিয়ে প্রশ্ন করা হলে পিটারের দাবির সত্যতা পাওয়া যায়নি।
এভাবে সময় গড়াতে গড়াতে আসে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতির আলোচিত দিন ২৮ অক্টোবর। ওইদিন ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ শান্তিপূর্ণ সকাল দিয়ে শুরু হলেও বেলা গড়িয়ে শেষ হয় চরম সহিংসতার মধ্যদিয়ে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গণমাধ্যমকর্মীদের ব্যাপক মারধর। এক পুলিশ সদস্য হত্যা। প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলাসহ নজিরবিহীন তাণ্ডব দেখে ঢাকা।
এই ঘটনার কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে যান পিটার হাস। এ সময় শ্রীলঙ্কা হয়ে নিজ দেশ সফরের পর আর বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো কথা বলতে দেখা যায়নি তাকে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ধুয়া তুলে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বুলি আওড়াচ্ছিল। বিএনপি কিংবা তার সমমনাদের মতো নির্বাচনকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা মুখে না বললেও, নিজেদের পছন্দ মতো সুশীলদের দিয়ে একটি সরকার গঠনের পাঁয়তারা ছিল তাদের – এমন মত অনেক বিশ্লেষকের। আর এই কাজে ২০০৭ সালে পিটার হাসের পূর্বসূরী প্যাট্রেসিয়া বিউটেনিস সফল হয়েছিলেন। গণতন্ত্রের বুলি আওড়ে এনেছিলেন সেনা সমর্থিত অনির্বাচিত সরকার। প্রকাশ্যে যার পরিচালনায় ছিলেন মার্কিনপন্থি সুশীলরা।
অনেক বিশ্লেষকের মতে, পিটার হাসও তেমন অ্যাসাইনমেন্ট পেয়েছিলেন তার দেশ থেকে। আর লক্ষ্যে সিজিএস- এর মতো মার্কিন সুবিধভোগী কিছু এনজিও ও সুশীল দিয়ে চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃঢ়তায় সফল হয়নি পিটার হাসের সেই মিশন। সময় সংবাদ।