News update
  • Caretaker Govt Review Hearing on Supreme Court Cause List     |     
  • Bangladesh Single Window to Launch by March: Lutfey Siddiqi     |     
  • UNRWA chief: Ceasefire is the start, not the solution     |     
  • UNRWA chief: Ceasefire is the start, not the solution     |     
  • Sudan war becomes more deadly: Ethnically motivated attacks up     |     

একাত্তরের যুদ্ধের শেষ দিনগুলোতে ইয়াহিয়া খান কী করছিলেন?

বিবিসি বাংলা খবর 2024-12-17, 10:41am

img_20241217_104050-42dfb445bd495c334db25868313ff0ee1734410485.png




সালটা ১৯৭১। আনুষ্ঠানিকভাবে '৭১-এর যুদ্ধ শুরু হওয়ার একদিন আগে, অর্থাৎ দোসরা ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকার সামরিক আইন প্রশাসকের পক্ষ থেকে তৎকালীন পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে একটা জরুরি সিগন্যাল বার্তা পৌছায়। সেখানে বলা হয়েছিল, ভারতীয় সেনাবাহিনী শেষ পর্যন্ত যশোর দখল করে নিয়েছে।

এই বার্তা দেখা মাত্র ইয়াহিয়া খান তার এডিসি, আর্শাদ সামি খানকে নির্দেশ দেন তিনি যেন অবিলম্বে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হামিদ এবং চিফ অব স্টাফ গুল হাসানকে রাষ্ট্রপতি ভবনে তলব করেন।

এই তিনজনের সঙ্গে দেখা করার পরই ইয়াহিয়া খান তার এডিসি আর্শাদ সামি খানকে জানান, পরের দিনের তার সমস্ত অ্যাপয়েন্টমেন্ট যেন এখনই বাতিল করে দেওয়া হয়।

ওইদিন সকাল নয়টায় সদর দফতরে একটা বৈঠক আহ্বান করা হয়, যেখানে তিনি (ইয়াহিয়া খান) ছাড়াও তৎকালীন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সমস্ত শীর্ষ কর্মকর্তারা অংশগ্রহণ করেছিলেন।

জেনারেল ইয়াহিয়ার খানের এডিসি আর্শাদ সামি খান তার বই 'থ্রি প্রেসিডেন্টস অ্যান্ড অ্যান এইড'-এ লিখেছেন, "জেনারেল গুল হাসান সর্বশেষ ঘটনাবলী সম্পর্কে সবাইকে অবহিত করার পর জোর দিয়ে বলেছিলেন যে পাকিস্তান যেন অবিলম্বে প্রতিক্রিয়া জানায়। তা না হলে ভারত পুরো পূর্ব পাকিস্তানের উপর আক্রমণ করবে এবং পরে তাদের বাহিনীকে পশ্চিম সীমান্তে নিয়ে আসবে যেখানে তাদের বিপুল সংখ্যক সৈন্য।এর জন্য আমাদের চড়া মূল্য চোকাতে হতে পারে।"

"গুল হাসান বৈঠকে উপস্থিত সকলকে মনে করিয়ে দেন যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন যে, পাকিস্তানের এক ইঞ্চি মাটিতেও আক্রমণ করা মানে কিন্তু পুরোদস্তুর যুদ্ধ। সেখানে সবাই এই বিষয়ে একমত হয়েছিলেন, যদিও তারা জানতেন যে যুদ্ধ ঘোষণা করার মতো অবস্থানে তারা নেই। বিশেষত সেই অবস্থায়, যখন যে ভূমির জন্য লড়াই করা হচ্ছিল সেখানকার লোকেরাই আমাদের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছিলেন।"

আর্শাদ সামি খান তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন, "একজন ভাল কমান্ডারের মতোই ইয়াহিয়া খান, তার জেনারেলদের ওই প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়েছিলেন। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, জেনারেল ইয়াহিয়া খান কোথাও একটা ধারণা করেছিলেন যে ওই যুদ্ধে জয়ী হওয়ার মতো অবস্থায় তিনি নেই।"

শকুন পথ আটকেছিল

এরপরই পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার মার্শাল রহিম খান জেনারেল গুল হাসানকে বোঝাতে শুরু করেন যে, পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর অবিলম্বে ভারতীয় বিমান ঘাঁটিগুলোতে বিমান হামলা শুরু করা উচিত যাতে ভারতীয় বিমান ওড়ারই সুযোগ না পায়।

বৈঠক শেষ হওয়ার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, অন্য একটা বৈঠকে ইয়াহিয়া খানকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিকেল চারটের সময় জেনারেল হামিদ নিজেই আসবেন

নির্ধারিত সময়ে জেনারেল হামিদ তার টয়োটা মিলিটারি জিপ নিয়ে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে পৌঁছান।

আর্শাদ সামি খান লিখেছেন, "আমরা জিপে উঠলাম যার চালকের সিটে বসেছিলেন জেনারেল হামিদ, আর জেনারেল ইয়াহিয়া তার পাশে বসেছিলেন। জিপের পিছনে বসে আছি, এমন সময় এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখলাম। কোথা থেকে একটা বিশাল শকুন এসে জিপের পথ আটকে বসে পড়ল। জেনারেল হামিদ হর্ন বাজালেন, কিন্তু সে (বিশালাকায় শকুন) একটুও নড়ল না।"

"জেনারেল ইয়াহিয়া গাড়ি নেমে সেটাকে বেত দিয়ে তাড়ানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু শকুনটা কয়েক পা হাঁটার পর রাস্তার মাঝখানে থেমে যায়। অবশেষে একজন মালী দৌড়ে এসে তার বেলচা দিয়ে শকুনটাকে তাড়ায়। আমরা প্রধান ফটকের কাছে পৌঁছানো মাত্রই ইয়াহিয়া তার মুখ নিচু করে ফেলেন, যাতে নিরাপত্তাকর্মীরা তাকে দেখতে না পায় এবং গাড়ির বহর তাকে অনুসরণ না করে।"

"তারা একটা বড় গেটওয়ালা, গুদামের মতো ভবনে পৌঁছন যেখানে এয়ার মার্শাল রহিম খান তাদের স্বাগত জানান।"

নূরজাহানকে ফোনে গান শোনানোর অনুরোধ

বৈঠক চলাকালীন আকাশে যুদ্ধবিমান ওড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছিল।

সব মিলিয়ে পাকিস্তানের ২৭৮টা যুদ্ধবিমানের মধ্যে ৩২টা তেসরা ডিসেম্বরের ওই হামলায় অংশ নেয়। বিকেল পাঁচটা নয় মিনিট থেকে পাঁচটা ২৩ মিনিটের মধ্যে এই আক্রমণের ঘটনা ঘটেছিল।

পরদিন ব্রিগেডিয়ার গুল মাওয়াজ তার বন্ধু ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে দেখেন তিনি (ইয়াহিয়া খান) ও জেনারেল হামিদ মদ্যপ অবস্থায় রয়েছেন।

পণ্ডিত ও শিক্ষাবিদ হাসান আব্বাস তার বই 'পাকিস্তান'স ড্রিফট ইনটু এক্সট্রিমিজম'-এ লিখেছেন, "ইয়াহিয়া গুল মাওয়াজকে বলেছিলেন, "কমান্ডার হিসেবে আমি যুদ্ধ শুরু করেছি। এখন সমস্ত কিছু জেনারেলদের উপর নির্ভর করছে।"

"কথোপকথনের সময় ইয়াহিয়ার কাছে বিখ্যাত গায়িকা নূরজাহানের ফোন আসে। জাপান থেকে এসেছিল ওই ফোন। ইয়াহিয়া তাকে ফোনে একটা গান শোনাতে বলেন।"

জাতিসংঘে বার্তার খসড়া

পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পরাজয়ের খবর আসতে থাকার সঙ্গে সঙ্গে গভর্নর আব্দুল মালিক যুদ্ধ বন্ধ করে সে সময় চলমান সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টার বিষয়ে সিগন্যাল এবং কয়েকশোবার ফোন কলের মারফত বার্তা পাঠানোর চেষ্টা করতে থাকেন ইয়াহিয়া খানকে।

এরপর, নয় ও দশই ডিসেম্বর গভর্নর মালিক এবং পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান জেনারেল এএকে নিয়াজির তরফে ক্রমাগত বার্তা পাঠানো হয়। বেশিরসভাগ বার্তার সারমর্ম ছিল যে পরিস্থিতির ক্রমশ আরও অবনতি ঘটছে। যদি অবিলম্বে কিছু না করা হয় তাহলে পূর্ব পাকিস্তান দুই দিনের মধ্যে ভারতের হাতে চলে যাবে।

ইয়াহিয়া খান তাদের উত্তর দিয়েছিলেন, "আপনি সেই স্থানে রয়েছেন যেখানে এসব ঘটছে। হতাহতের সংখ্যা কমিয়ে আনতে যা যা করণীয়, তাই করুন।"

ইয়াহিয়া খানের বার্তা পেয়ে গভর্নর মালিক জাতিসংঘ মহাসচিবের উদ্দেশ্যে লেখা একটা প্রস্তাবের খসড়া অনুমোদনের জন্য তাকে (ইয়াহিয়া খানকে) পাঠান। সেখানে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি এবং পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানানো হয়।

ইয়াহিয়া খানের অনুমতি ছাড়াই জাতিসংঘে বার্তা

এই খসড়া পেয়ে ইয়াহিয়া খান বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি তৎক্ষণাৎ জেনারেল হামিদকে ডেকে পাঠালেন।

আর্শাদ সামি খান 'থ্রি প্রেসিডেন্টস অ্যান্ড অ্যান এইড'- বইয়ে লিখেছেন, "ইয়াহিয়া হামিদকে বলেছিল- নিয়াজিকে ডেকে বলো যে যথাযথ পদক্ষেপের অনুমতি দেওয়ার অর্থ এই নয় যে সে আমাদের কূটনৈতিক সিদ্ধান্তে নাক গলাবে।"

"তিনি বলেন, জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে মালিকের প্রস্তাব যাওয়ার অর্থ হল আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। তুমিই ওর সঙ্গে কথা বলো, কারণ আমি যদি কথা বলি তবে আমি আমার রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না। এই সময়ে ধৈর্য হারালে চলবে না।"

এর কিছুক্ষণ পর জেনারেল হামিদ ইয়াহিয়া খানকে একটা দুঃসংবাদ দেন। তিনি জানান, জেনারেল ফরমান আলী রাষ্ট্রপতির অনুমোদন না নিয়েই জাতিসংঘের ঢাকাস্থিত শরণার্থী ও পুনর্বাসন প্রতিনিধির কাছে গভর্নরের ওই বার্তা পাঠিয়ে দিয়েছেন।

ইয়াহিয়া খান তৎক্ষণাৎ পররাষ্ট্র সচিব সুলতান খানকে নির্দেশ দেন যেভাবেই হোক বার্তা যেন প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।

চীনের এড়িয়ে যাওয়া

প্রাথমিকভাবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাফল্যে উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েছিলেন ইয়াহিয়া খান। রাজস্থানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রাথমিক সাফল্য এবং ভারতীয় যুদ্ধজাহাজ খুকরির ডুবে যাওয়ার খবরে তিনি মনে করেছিলেন ভাগ্য তাদের সহায়।

আর্শাদ সামি খানের বইয়ে উল্লেখ রয়েছে, "আইএসআইয়ের তৎকালীন প্রধান তাকে বলেছিলেন যে বিশ্বের বিখ্যাত জ্যোতিষী জিন ডিক্সন ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে তিনি কমপক্ষে দশ বছর শাসক হিসাবে ক্ষমতায় থাকবেন। এই কথা শুনে ইয়াহিয়া খুব খুশি হলেন। কে জানতো দশ বছর তো দূরের কথা, কয়েক দিনেই তিনি আর প্রেসিডেন্ট থাকবেন না।"

জেনারেল ইয়াহিয়া খান আশা করেছিলেন, এই যুদ্ধে চীন প্রকাশ্যে তার পাশে দাঁড়াবে। কিন্তু চীন তা করতে অসম্মত হয়।

পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব সুলতান আহমেদ তার আত্মজীবনী 'মেমোরিজ অ্যান্ড রিফ্লেকশনস অব এ পাকিস্তানি ডিপ্লোম্যাট'-এ লিখেছেন, "চীনের রাষ্ট্রদূত আমাকে বলেছেন যে পাকিস্তানের প্রতি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমর্থন আমরা অব্যাহত রাখব, তবে এই লড়াইয়ে হস্তক্ষেপ করার ক্ষেত্রে আমাদের ক্ষমতা সীমিত এবং যদি আমরা তা করি, তাহলেও এর ফলাফল সংকীর্ণ ফলাফল হতে পারে। তাই এ নিয়ে খুব বেশি আশা করবেন না।"

"পূর্ব পাকিস্তানে ভারতের প্রভাব কমানো জরুরি কিন্তু সীমান্তের পার্বত্য পথে বরফ জমে যাওয়ার কারণে তা করতে কয়েক সপ্তাহ সময় লেগে যাবে।"

ইরানের সরে যাওয়া

পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ডকে ইয়াহিয়া খান চৌঠা ডিসেম্বর জানান যে তার সেনাবাহিনীর জন্য মার্কিন সামরিক সরবরাহ খুবই প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্র যদি নিজে এই সহায়তা দিতে না পারে, তাহলে অন্তত অন্য দেশগুলোকে তা করা থেকে যেন বিরত না রাখা হয়।

এরপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠানোর জন্য জর্ডান, ইরান এবং সৌদি আরবের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইরান কিন্তু পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠায়নি।

ইরানের শাহ, রেজা শাহ পাহলভি মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে জানিয়েছিলেন, পাকিস্তানে ইরানি বিমান ও পাইলট পাঠিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের মুখোমুখি হওয়ার ঝুঁকি নিতে পারেন না তিনি। তবে এমনটা হতে পারে যে ইরান জর্ডানে তাদের বিমান পাঠাবে এবং তার পরিবর্তে জর্ডান পাকিস্তানে তাদের বিমান পাঠাবে। (তেহরান দূতাবাসের ফাইল, নিক্সন প্রেসিডেন্সিয়াল মেটেরিয়াল বক্স পৃষ্ঠা ৬৪৩)

মুহাম্মদ ইউনূস তার 'ভুট্টো অ্যান্ড দ্য ব্রেকআপ অব পাকিস্তান' শীর্ষক গ্রন্থে লিখেছেন, "আসলে পাকিস্তানের সঙ্গে ইরানের একটা গোপন চুক্তি ছিল যে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ হলে করাচীর বিমান নিরাপত্তার দায়িত্ব থাকবে ইরানের। ইয়াহিয়া যখন ইরানের শাহকে সেই চুক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেন, তখন তিনি তা বাস্তবায়ন করতে অস্বীকার করে যুক্তি দিয়েছিলেন যে এটা আর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বিষয় নেই।"

পোল্যান্ডের প্রস্তাব বৃথা গেল

এরপর ছয়ই ডিসেম্বর ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে সমস্ত রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। এরই মাঝে, ভারতীয় বিমানবাহিনী পশ্চিম সেক্টরে আক্রমণ আরও জোরদার করে দেয়।

সুলতান খান লিখেছেন, "তড়িঘড়ি করে রাষ্ট্রপতি ভবনের বাগানে গর্ত খুঁড়ে ভূগর্ভস্থ একটা কক্ষ তৈরি করা হয়। বোমা থেকে বাঁচতে সেই কক্ষের ছাদে বালির বস্তা রাখা হয়েছিল। আমি যখন ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে পরামর্শ করছিলাম সেই সময়ে ওই ভূগর্ভস্থ কক্ষে কমপক্ষে দু'বার ভারতীয় বিমান হামলা করেছিল। বিমান হামলার সাইরেন বেজে উঠেছিল।"

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির জন্য বেশ কয়েকটা প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়েছিল, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন সেই সবকটায় 'ভেটো' দেয়। এরপর পোল্যান্ড অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি, দুই দেশের সেনাবাহিনীকে আন্তর্জাতিক সীমান্তে স্থানান্তর এবং রাজনৈতিক উপায়ে পূর্ব পাকিস্তান যুদ্ধের সমাধানের প্রস্তাব পেশ করে। এর ফলে আশার আলো দেখা দেয়।

এদিকে, সময় ফুরিয়ে যাচ্ছিল এবং পূর্ব পাকিস্তানে পরাজয় স্পষ্টতই দৃশ্যমান ছিল।

তাই ইয়াহিয়া খান নিউ ইয়র্কে পাকিস্তানি প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেওয়া জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে যোগাযোগ করে অবিলম্বে পোল্যান্ডের প্রস্তাব গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

কিন্তু মি. ভুট্টোকে ফোনে পাওয়া যায়নি।

'ওয়ার অ্যান্ড সিসেশন : পাকিস্তান, ইন্ডিয়া অ্যান্ড বাংলাদেশ' শীর্ষক বইয়ে রিচার্ড সিসুন ও লিও রোজ লিখেছেন, "পরে ইয়াহিয়া কোনওভাবে ভুট্টোর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করলে ভুট্টো জবাব দেন-আমি তোমার কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি না।"

"ইয়াহিয়া একাধিকবার নিজের কথা বলতে থাকেন, কিন্তু জবাবে ভুট্টো বলেন- কী বলছ তুমি? আমি কিছুই শুনতে পাচ্ছি না।

"সেই সময় টেলিফোন অপারেটর বাধা দিয়ে বলেন-লাইনটা একেবারে পরিষ্কার… আপনি বলুন।"

"এর জবাবে ভুট্টো চিৎকার করে তাকে (টেলিফোন অপারেটরকে) বলেন-চুপ করুন।"

পোল্যান্ডের ওই প্রস্তাব বিবেচনা হওয়ার আগেই, পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করে ফেলে।

গভীর রাতে নিক্সনের ফোন

এর ঠিক তিন দিন আগে ইয়াহিয়া খান মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে বার্তা পাঠিয়ে জানিয়েছিলেন, তিনি কথা বলতে চান। রাত দু'টোর দিকে নিক্সন ফোন করেন।

আর্শাদ সামি খান লিখেছেন, "আমি প্রেসিডেন্টকে জাগিয়ে তুলি। ঘুম চোখে ইয়াহিয়া কথা বলেন। যেহেতু টেলিফোন লাইন ঘন ঘন কেটে যাচ্ছিল, তাই প্রেসিডেন্ট আমাকে সমান্তরাল লাইনে থাকতে এবং পুরো কথোপকথন শুনতে বলেছিলেন। নিক্সন ইয়াহিয়াকে বলেছিলেন যে তিনি পাকিস্তানের নিরাপত্তা নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।"

"তাই পাকিস্তানকে সাহায্য করার জন্য বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর 'এন্টারপ্রাইজ'কে পাঠাচ্ছে। কথোপকথন শেষ হতেই ইয়াহিয়া আমাকে জেনারেল হামিদকে ফোন করতে বললেন। ফোনটা বেজে উঠতেই ইয়াহিয়া প্রায় চিৎকার করে উঠে বলেন, "হেইম আমরা করে ফেলেছি। আমেরিকানরা আসছে।"

"আমরা মার্কিন নৌবহরের জন্য পরের দু'দিন অপেক্ষা করলাম। মনে হচ্ছিল তারা শামুকের গতিতে এগোচ্ছে। এমন কী ঢাকার পতনের পরও বঙ্গোপসাগরে তার কোনওরকম চিহ্ন ছিল না।"

পুরো যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনার তিন বাহিনীর মধ্যে কোনও সমন্বয় ছিল না।

পরিস্থিতি এমন ছিল যে, নৌবাহিনীর প্রধানকেও পাক হামলার কথা জানানো হয়নি। তিনি রেডিও থেকে খবরটা পেয়েছিলেন। ভারতীয় জলসীমায় মোতায়েন সাবমেরিনগুলোও যুদ্ধের খবর পেয়েছিল রেডিও থেকে।

ইস্টার্ন কমান্ডের জেনারেল নিয়াজী বিবিসির সম্প্রচার থেকে যুদ্ধ শুরুর তথ্য পান। (ক্রসড সোর্ডস : পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও যুদ্ধ, পৃষ্ঠা ২৯৫)

পাক নৌসেনা প্রধান এক সাক্ষাৎকারে আরও অভিযোগ করেন, ভারত যখন পাকিস্তানি জাহাজে হামলা চালায়, তখন বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও তাদের এয়ার কভার দেওয়া হয়নি।

গওহর আইয়ুব খান তার বই 'গ্লিম্পসেস ইনটু দ্য করিডোরস অফ পাওয়ার'-এ বাংলাদেশ যুদ্ধের আগে এক বিমান সফরের সময় চিফ অব জেনারেল স্টাফ জেনারেল গুল হাসানের সঙ্গে তার বৈঠকের কথা উলেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, "জেনারেল গুল আমাকে বলেছিলেন, কেবল মাত্র অলৌকিক কোনও ঘটনাই পূর্ব পাকিস্তানে আমাদের রক্ষা করতে পারে। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম- আপনি কি এই বিষয়ে প্রধানকে বলেছেন?"

"গুল তার চোখ বন্ধ করে উত্তর দিয়েছিলেন- গওহর, তিন মাস ধরে তার (পাক প্রধানের) সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাচ্ছি না।"

"আমি বললাম- আপনি মজা করছেন?"

"গুল বলেছিল- বিশ্বাস করুন, ওর সঙ্গে দেখা করার জন্যও আমাকে এক ধরনের যুদ্ধ করতে হয়।"

"আমি বলেছিলাম তাহলে তো ঈশ্বরই আমাদের রক্ষা করতে পারেন। আমরা চোখ কান খোলা রেখে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।"

সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের খবর শোনা মাত্রই ইয়াহিয়া খান সন্ধ্যা সোয়া সাতটায় রেডিও এবং টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। বার্তায় তিনি বলেন, "এটা সাময়িক ব্যর্থতা। আমরা পশ্চিম সেক্টরে লড়াই চালিয়ে যাব।"

বার্তাটি রেকর্ড করার আগে তিনি তা তার পররাষ্ট্র সচিব সুলতান খানের কাছে তার মন্তব্য জানার জন্য পাঠান।

সুলতান খান লিখেছেন, "পূর্ব পাকিস্তানে আমাদের সামরিক সক্ষমতা জানা সত্ত্বেও আমি অবাক হয়ে দেখলাম প্রেসিডেন্ট তখনও চার্চিলের মতো ছাদে, সমুদ্র সৈকতে ও রাস্তায় শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলছেন। আমার পীড়াপীড়িতে তিনি তার বক্তব্য থেকে এই সমস্ত অনুচ্ছেদ বাদ দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি এই বার্তা বাতিল করার জন্য আমার পরামর্শ গ্রহণ করেননি ।"

আর্শাদ সামি খা লিখেছেন, "এটা আমাদের সবার জন্য খুবই দুঃখের সময় ছিল। আমরা নিজেদের চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি। "

"আমি কুসংস্কারাচ্ছন্ন নই, কিন্তু আমি তেসরা ডিসেম্বরের ওই দৃশ্যটা বারবার মনে করতে থাকি যখন রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে বের হওয়ার সময় একটা শকুন আমাদের পথ আটকয়েছিল। যেন আমাদের বলতে ছেয়েছিল যে এই যুদ্ধে যাওয়া অর্থহীন এবং ফলাফল আমাদের পক্ষে যাবে না।"